শিল্পায়ননির্ভর অর্থনীতির টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। বিগত চার দশকে একটি স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হওয়ার পেছনে আমাদের যে যাত্রা তার মূলে রয়েছে শিল্পের অভাবনীয় বিকাশ, বিশেষ করে শ্রমনির্ভর ম্যানুফ্যাকচারিং খাত।
৭০ দশকের শেষের দিকে যাত্রা শুরু করে ইতোমধ্যে বিশ্ববাজারে আমরা দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে নিজেদের অবস্থান তৈরি করেছি। প্রায় ৪.৪ মিলিয়ন মানুষের প্রত্যক্ষ কর্মসংস্থান এবং পরোক্ষভাবে প্রায় এক কোটি মানুষের জীবিকার প্রধান উৎস এই শিল্পের জিডিপিতে অবদান ১১%। দেশের সামগ্রিক আর্থসামাজিক উন্নয়নে অব্যাহত অবদান রাখার পাশাপাশি, নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত, শ্রমিকের ক্ষমতায়ন এবং সবুজ শিল্পায়নেও অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে এই শিল্প। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক অডিট প্রতিষ্ঠান কিউআইএমএ বাংলাদেশের পোশাক খাতকে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ এথিক্যাল ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্প হিসেবে চিহ্নিত করেছে। পরিবেশবান্ধব সবুজ শিল্পায়নেও আমরা অগ্রণী ভূমিকা রাখছি। বর্তমানে আমাদের দেশে ১৪৩টি লিডারশিপ ইন এনার্জি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ডিজাইন (লিড) সার্টিফাইড সবুজ গার্মেন্ট কারখানা রয়েছে এবং বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় প্রথম ১০০টি সবুজ কারখানার মধ্যে ৩৯টি এ দেশে অবস্থিত। ইউএস গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিল (ইউএসজিবিসি) তাদের লিডারশিপ ইন এনার্জি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ডিজাইন বা লিড রেটিং সিস্টেমের মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে পরিবেশবান্ধব স্থাপনার লিড সনদ প্রদান করে থাকে। তবে ক্রম পরিবর্তনশীল আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থেকে প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনে শিল্পের ভূমিকার বিষয়টিকেও আমাদের নজর রাখতে হচ্ছে। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন এবং জলবায়ু পরিবর্তনের যুগে বিশ্ব বাণিজ্য ব্যবস্থায় পরিবেশ ও জলবায়ুর বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। বাংলাদেশ তার ব্যতিক্রম নয়। পরিবেশ-সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোকে বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরতে প্রতি বছরের মতো এবারও ৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস হিসেবে পালিত হবে। জাতিসংঘ কর্তৃক এ বছরের পরিবেশ দিবসের প্রতিপাদ্য হিসেবে নির্ধারিত হয়েছে ‘ইকোসিস্টেম রেস্টোরেশন’। বিদ্যমান সময়ের প্রেক্ষাপটে যা অত্যন্ত সময়োপযোগী এবং সবারই এ বিষয়ে অংশগ্রহণ করার সুযোগ রয়েছে, বিশেষ করে শিল্প ও সংশ্নিষ্ট খাতগুলোর উৎপাদন ও শিল্প উন্নয়নের পাশাপাশি ইকোসিস্টেমের সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষা করা অতীব প্রয়োজনীয়। চলমান কভিড-১৯ মহামারি শুধু আমাদের সামগ্রিক উন্নয়নের মূলেই আঘাত করেনি, পরিবেশ নিয়ে আমাদের অর্জনগুলো ধরে রাখতে নতুন করে ভাবতে হচ্ছে। পরিবেশবান্ধব স্থাপনার বিভিন্ন নির্ণায়কের মধ্যে রয়েছে- টেকসই নির্মাণ ভূমি, জ্বালানি দক্ষতা, নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার, নিরাপত্তা, পানি ব্যবহারের দক্ষতা, কর্মবান্ধব পরিবেশ, অভ্যন্তরীণ পরিবেশগত মান, কারখানার অভ্যন্তরে বায়ুর মান, প্রযুক্তির ব্যবহার, অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা, দুর্ঘটনা মোকাবিলার সক্ষমতা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি। এই নির্ণায়কগুলোর মূল্যায়নের ভিত্তিতে কারখানাকে ১ থেকে ১১০ এর মধ্যে একটি নম্বর প্রদান করা হয় এবং প্রাপ্ত নম্বর অনুযায়ী প্লাটিনাম, গোল্ড, সিলভার এবং লিড সার্টিফাইড লেভেলে বিভক্ত করা হয়। ৪০ থেকে ৪৯ নম্বর পেলে লিড সার্টিফাইড লেভেলের সনদ প্রদান করা হয়; ৫০ থেকে ৫৯ লিড সিলভার, ৬০ থেকে ৭৯ লিড গোল্ড এবং ৮০ বা তদূর্ধ্ব নম্বর অর্জনকারীকে সম্মানজনক লিড প্লাটিনাম সনদ প্রদান করা হয়। একটি পরিবেশবান্ধব পোশাক কারখানায় উৎপাদনের প্রতিটি ধাপে পানি, বিদ্যুৎ, রং এবং বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবহার পরিবেশবান্ধব উপায়ে হচ্ছে কিনা তা দেখা হয়। অধিকাংশ পোশাকশিল্প কারখানা ইটিপি ব্যবহারের ক্ষেত্রে গতানুগতিক ইটিপির পরিবর্তে বায়োলজিক্যাল ইটিপি ব্যবহার করছে, যা আমাদের সবুজ বিপ্লবেরই একটি ইতিবাচক ইঙ্গিত।
বিশ্ববাজারে টিকে থাকতে হলে টেকসই উন্নয়নের বিকল্প নেই। তাই বিশ্ববাজারে নিজেদের অবস্থান আরও সুদৃঢ় করে তুলতে পরিবেশবান্ধব উৎপাদন ব্যবস্থায় মনোযোগী হতে হবে। পরিবেশবান্ধব শিল্পায়নে অর্থায়নের পাশাপাশি এনভায়রনমেন্টাল, সোশ্যাল ও করপোরেট গভর্ন্যান্স (ইএসজি) প্রণয়ন ও বাস্তবায়নকে আরও গুরুত্ব সহকারে দেখতে হবে। বিশ্বব্যাপী ভোক্তাদের টেকসই ও স্বল্প কার্বনফুট প্রিন্ট সম্পন্ন পোশাকের প্রতি আগ্রহ ক্রমশ বেড়ে চলেছে এবং জনপ্রিয় ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলোও পরিবেশবান্ধব পোশাক তৈরির নিত্যনতুন প্রতিশ্রুতি নিয়ে কনজুমারদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছে। বাংলাদেশ পৃথিবীর একটি অন্যতম স্বল্প কার্বন নিঃসরণকারী দেশ, তথাপি নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারকারী দেশ হিসেবে বিশ্বে পরিচিতি লাভ করছে। বাংলাদেশের রয়েছে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক সোলার হোম সিস্টেম। বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। বিজিএমইএ ইতোমধ্যে ইএনএফসিসির উদ্যোগ ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি চার্টার ফর ক্লাইমেট অ্যাকশনে স্বাক্ষর করেছে, যার মাধ্যমে ২০৩০ সাল নাগাদ পোশাক খাতের গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণ ৩০% কমানোর লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের সহজলভ্যতা নিশ্চিতে বিজিএমইএ এবং টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (স্রেডা) মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে স্বল্পন্নোত দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে। বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে বিশ্ব নেতৃত্বে অগ্রণী ভূমিকা রাখছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি জলবায়ু ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর আন্তর্জাতিক ফোরাম সিভিএফের চেয়ারপারসন নির্বাচিত হয়েছেন। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে জলবায়ু পরিবর্তনের নীতিগত বিষয়গুলোতে অবদান রাখার জন্য ২০১৫ সালে চ্যাম্পিয়ন অব দ্য আর্থ পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রীর বিচক্ষণ নেতৃত্বে উদ্বুদ্ধ হয়ে বাংলাদেশের পোশাক শিল্প পরিবেশ রক্ষায় সহায়ক উৎপাদন পদ্ধতি অনুসরণ করছে। পোশাক শিল্পে সার্কুলার ফ্যাশন প্রণয়নে বিজিএমইএ, গ্লোবাল অ্যাকশন এজেন্ডা, রিভার্স রিসোর্সেসের সঙ্গে সার্কুলার ফ্যাশন পার্টনারশিপ তৈরি করেছে, পিফোরজির অর্থায়নে এই উদ্যোগের মাধ্যমে পোশাক কারখানায় উৎপাদিত উচ্ছিষ্ট রিসাইকেলের মাধ্যমে পুনর্ব্যবহার উৎসাহিত করা হচ্ছে এবং এ বিষয়ে আমরা শিল্পের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য কাজ করছি। এ ছাড়া বিজিএমইএ এলেন ম্যাকআর্থার ফাউন্ডেশনের সঙ্গে মেকিং ফ্যাশন সার্কুলার শীর্ষক নীতিমালা প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। পোশাক শিল্পের কেমিক্যাল ব্যবহারের নীতিমালা প্রণয়নে বিজিএমইএ বাংলাদেশ সরকার ও জিআইজেডের সঙ্গে কাজ করছে, যার মাধ্যমে শিল্পে ব্যবহূত কেমিক্যালগুলোর সঠিক ব্যবস্থাপনার বিষয়টি আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে সমন্বয় করে নিশ্চিত করা হবে। বিজিএমইএ জার্মান সরকার কর্তৃক প্রণীত পোশাক শিল্পের পরিবেশ ও সামাজিক মান সংরক্ষণের জন্য গৃহীত উদ্যোগ ‘গ্রিন বাটন’কে স্বাগত জানিয়েছে এবং কারখানাগুলোকে এই উদ্যোগের সঙ্গে সম্পৃক্ত করার জন্য কাজ করছে। পরিশেষে বলতে চাই, বাংলাদেশ তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশ হওয়া সত্ত্বেও পোশাক শিল্পে সবুজ বিপ্লবের মশাল হাতে এগিয়ে চলেছে। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব আমরা বিভিন্ন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মাধ্যমে উপলব্ধি করছি। পরিবেশ ও বাস্তুসংস্থান পুনরুদ্ধারে আমাদের সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। জাতিসংঘের এ বছরের প্রতিপাদ্য ‘ইকোসিস্টেম রিস্টোরেশন’-এর সঙ্গে আমরা একাত্মতা ঘোষণা করছি এবং পোশাক শিল্পে সবুজ ও টেকসই উন্নয়নের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে বলে আমি মনে করি।
সভাপতি, বিজিএমইএ