বছরে ১০ লাখ বেল ভারতীয় তুলা রফতানি হবে বাংলাদেশে। দুই দেশের সরকারি পর্যায়ে এ নিয়ে স্বাক্ষর হবে সমঝোতা স্মারক। ভারতীয় গণমাধ্যমে উঠে আসা এমন খবরে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশের তুলা বাণিজ্যসংক্রান্ত সরকারি ও বেসরকারি খাতের প্রতিনিধিরা। তারা বলছেন, এ ধরনের একটি চুক্তির বিষয়ে আলোচনা হলেও তা বেশ পুরনো।
খাতসংশ্লিষ্টদের দাবি, আপত্তি থাকায় তুলা আমদানির বিষয়ে আলোচনার কোনো অগ্রগতি নেই। কাজেই শিগগিরই এ বিষয়ে চুক্তি হওয়ার কোনো তথ্য তাদের কাছে নেই। আর তুলার বাণিজ্যে ভারতকে মন্দা মোকাবেলা করতে হচ্ছে বেশ কিছুদিন ধরে। আর পণ্যটির বড় রফতানি গন্তব্য বাংলাদেশের বাজারও ক্রমেই সংকুচিত হয়ে আসছে। এ প্রেক্ষাপটে তুলার বাণিজ্য ও বাজার পুনরুদ্ধারে নতুন করে বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনার আগ্রহ প্রকাশ পাচ্ছে সরকারি পর্যায়ে চুক্তির খবরে।
দ্য হিন্দু বিজনেস লাইনসহ ভারতীয় একাধিক গণমাধ্যমের সাম্প্রতিক সংবাদে বলা হয়েছে, ভারত থেকে বছরে ১০ লাখ বেল তুলা বাংলাদেশে রফতানির লক্ষ্যে দুই দেশের মধ্যে চুক্তি হচ্ছে, যা হবে সরকার থেকে সরকার (জিটুজি) পর্যায়ে। এ চুক্তির বিষয়টি দেখভাল করছে কটন করপোরেশন অব ইন্ডিয়া। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের কথা থাকলেও দেশটির বিভিন্ন রাজ্যে নির্বাচন থাকার কারণে চুক্তিটি হয়নি।
খবরে আরো বলা হয়েছে, বছরে ২০-৩০ লাখ বেল তুলা আমদানি করে বাংলাদেশ। ফলে ভারতীয় তুলার জন্য এ দেশের বাজার বেশ ভালো। চুক্তিটি এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে আছে। এ নিয়ে সমঝোতার বিষয়গুলো নির্ধারণে সক্রিয় রয়েছেন দুই দেশেরই সরকারি কর্তাব্যক্তিরা।
বাংলাদেশে তুলা বাণিজ্যসংক্রান্ত সরকারি ও বেসরকারি সূত্রগুলো বলছে, ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে বছরে নির্ধারিত পরিমাণ তুলা বাংলাদেশে রফতানির বিষয়ে আলোচনা হয়েছিল গত বছরের শেষার্ধে। দুই দেশের সরকার পর্যায়ে এক চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে ওই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের বিষয়ে আলোচনাও হয় তখন। দেশের তুলা আমদানিকারক সুতার উৎপাদকরা তখন আপত্তি জানিয়ে বলেছিলেন বিষয়টি অযৌক্তিক। তুলার মানের ওপর সুতা ও কাপড়ের মান নির্ভর করে। ক্রেতার চাহিদার ভিত্তিতে বিভিন্ন দেশ থেকে তুলা আমদানি হয় বাংলাদেশে। তাই কোনো নির্দিষ্ট দেশ থেকে তুলা আমদানির বিষয়টি চাপিয়ে দেয়া ঠিক হবে না।
জানা গেছে, গত বছর ভারতের কটন করপোরেশনের (সিসিআই) মাধ্যমে বাংলাদেশে তুলা সরবরাহ নিয়ে আলোচনা হয়। এরপর সেপ্টেম্বরে ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশন চুক্তির খসড়া পররাষ্ট্র, বাণিজ্য, বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় এবং টিসিবির চেয়ারম্যানকে পাঠায়। তবে বেসরকারি খাতের আপত্তি থাকায় ওই আলোচনা আর এগোয়নি বলে জানিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
জানতে চাইলে বাংলাদেশের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে বলেন, সিসিআই সাত-আট মাস আগে একটি প্রস্তাব দিয়েছিল। বছরে নির্দিষ্ট পরিমাণ আমদানিসংক্রান্ত ওই প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল টিসিবিকে। কিন্তু এ ধরনের আমদানির কোনো ম্যান্ডেট টিসিবির নেই। এর পরও একাধিকবার এ প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হয়। পরবর্তী সময়ে প্রস্তাবটি তুলাসংশ্লিষ্ট বেসরকারি খাতের সংগঠনগুলোকে দেয়া হয়।
তারাও জানিয়েছিলেন, বিটুবি বা বিটুজি পর্যায়ে এ ধরনের চুক্তি হতে পারে, কিন্তু টিসিবির সঙ্গে এ চুক্তির সুযোগ নেই। এখন বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ছাড়া ভারত অন্য কোনো পর্যায়ে এ নিয়ে কোনো আলোচনা করছে কিনা সে বিষয়ে বলা সম্ভব হচ্ছে না। ভারত চেষ্টা করতে পারে। কারণ এ বিষয়ে ভারতের আগ্রহ ব্যাপক।
বাংলাদেশের খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বছরে নির্দিষ্ট পরিমাণ তুলা আমদানির বিষয়ে আপত্তি জানানো হয়েছে। ফলে বিষয়টি বাতিল হয়ে গেছে বলা যায়। ভারতীয়দের তুলা বাণিজ্যের মৌসুম আসন্ন। তাই এ ধরনের আলোচনা হচ্ছে দেশটিতে। গত বছরও এমন আলোচনা হয়েছিল এমন মৌসুমে। চীন একসময় বিপুল পরিমাণ তুলা আমদানি করত। এখন করছে না। অন্যদিকে বাংলাদেশেও তুলার বাজারে শক্তিশালী রফতানিকারক এখন আফ্রিকা। সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে তুলার বাজারে নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করার প্রয়াস হিসেবে ভারতে চুক্তির বিষয়টিকে এখন সামনে আনা হচ্ছে।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন বণিক বার্তাকে বলেন, এমন চুক্তির বিষয়ে বেশ আগে আলোচনা হয়েছিল। আমরা আপত্তি জানিয়েছিলাম। এ নিয়ে আর কোনো অগ্রগতি নেই।
তুলা বাণিজ্যসংশ্লিষ্ট বাংলাদেশী ব্যবসায়ীরা বলছেন, চীনের সঙ্গে তুলার বাণিজ্য ভালো যাচ্ছে না। আবার বাংলাদেশে তুলা রফতানিতে গুরুত্বপূর্ণ দেশ এখন আফ্রিকা। অন্যদিকে সিসিআইতে এ বছর অনেক তুলা মজুদ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সব মিলিয়ে তুলা বাণিজ্য পুনরুদ্ধারে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তির বিষয়ে পুনরায় আলোচনায় আগ্রহী হয়ে উঠছে ভারত।
তুলা বাণিজ্য পুনরুদ্ধারে ভারত প্রয়াস চালাতেই পারে, এমন মত প্রকাশ করে বাংলাদেশ কটন অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি মেহেদী আলী বণিক বার্তাকে বলেন, তুলা রফতানিতে বেশ কয়েক বছর আগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল ভারত। তখন থেকেই বছরে নির্দিষ্ট পরিমাণ তুলা আমদানির বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। তবে আমদানির পদ্ধতিগুলোর কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। এছাড়া মান সম্পর্কে নিশ্চিত না হয়ে স্পট রেটে তুলা কেনার বিষয়টি বাস্তবসম্মত নয়।
তুলা আমদানিতে দীর্ঘদিন ধরেই ভারতনির্ভর ছিল বাংলাদেশ। তবে এ চিত্রে পরিবর্তন আসছে। সাম্প্রতিক তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, তুলা আমদানির উৎস হিসেবে ধীরে ধীরে ভারতকে প্রতিস্থাপন করছে আফ্রিকার দেশগুলো। বর্তমানে দেশের আমদানীকৃত তুলার এক-তৃতীয়াংশই আসছে আফ্রিকার দেশগুলো থেকে। এর মধ্য দিয়ে দেশে তৈরি বস্ত্র ও পোশাকের গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য অংশীদার হয়ে উঠছে আফ্রিকা।
মূলত মানের কারণেই ভারত থেকে তুলা আমদানি কমিয়ে দিচ্ছেন দেশের সুতা ও কাপড় প্রস্তুতকারীরা। তারা বলছেন, ভারতীয় তুলা থেকে উৎপাদিত কম মানের সুতা ও কাপড় নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই তৈরি পোশাক ব্যবসায়ীরা অভিযোগ তুলছেন। অন্যদিকে আফ্রিকার তুলার মান তুলনামূলক অনেক ভালো। এ কারণে দেশে তুলার উৎস হিসেবে ভারতের জায়গা দখল করে নিচ্ছে আফ্রিকার দেশগুলো।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশে তুলা আমদানি হয়েছে ৭৫ লাখ বেল। এর মধ্যে পরিমাণ বিবেচনায় সবচেয়ে বড় উৎস আফ্রিকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বলছে, দেশে মোট তুলা আমদানির ১০ শতাংশ আসে আফ্রিকার বেনিন থেকে। বুরকিনা ফাসো ও মালি থেকে আসে যথাক্রমে ৭ ও ৮ শতাংশ। এছাড়া আইভরিকোস্ট ও ক্যামেরুন উভয় দেশেরই অবদান ৪ শতাংশ করে। সব মিলিয়ে দেশে আমদানীকৃত তুলার ৩৩ শতাংশ আসছে আফ্রিকা থেকে।
মূল্য ও আমদানির সময় বিবেচনায় একসময় দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উৎস ছিল ভারত। ২০১০ সালে বাংলাদেশ মোট তুলা আমদানি করে ৫২ লাখ বেল। এর মধ্যে ভারত থেকে আমদানি হয় ১১ লাখ বেলের বেশি। এ হিসাবে সে বছর ২২ শতাংশ তুলা আমদানি হয়েছিল ভারত থেকে। ২০১৫ সালে বাংলাদেশ মোট ৬১ লাখ বেল তুলা আমদানি করে। এর মধ্যে ভারত থেকে আমদানি হয় ২৯ লাখ বেল। পরের বছর আমদানীকৃত তুলার মধ্যে ভারতের অংশ ছিল প্রায় ৫৫ শতাংশ। বতর্মানে এ হার কমে দাঁড়িয়েছে ২৩ শতাংশে।