ঈদের পর দুই সপ্তাহের কঠোর লকডাউন বা বিধিনিষেধের সময় রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক ও বস্ত্র কারখানা চালু রাখার দাবি জানিয়েছিলেন মালিকেরা। তবে সরকার আজ সোমবার বেলা চারটা পর্যন্ত নতুন করে কোনো নির্দেশনা দেয়নি। ফলে অনেকটা অনিশ্চয়তার মধ্যেই পোশাক কারখানার শ্রমিকদের ঈদের ছুটি দিচ্ছেন মালিকেরা।
অবশ্য আশা ছাড়েননি পোশাকশিল্পের মালিকদের দুই সংগঠন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর নেতারা। তাঁদের প্রত্যাশা, করোনা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলে ১ আগস্ট থেকে কারখানা খোলার সুযোগ দেবে সরকার। এমন বার্তা নিজেদের সংগঠনের সদস্যদের মধ্যেও ছড়িয়ে দিয়েছেন তাঁরা।
নেতাদের বার্তা পেয়ে পোশাক কারখানার মালিকেরা ঈদের ছুটি দেওয়ার ক্ষেত্রে কৌশলী হয়েছেন। অধিকাংশ কারখানার মালিক ঈদের সাধারণ ছুটি দিয়েছেন চার থেকে সাত দিন। তবে ছুটির নোটিশে তাঁরা উল্লেখ করছেন, ঈদের ছুটির পর করোনা সংক্রমণ রোধে সরকার ঘোষিত বিধিনিষেধে কারখানা বন্ধ থাকবে। পরবর্তী সময়ে সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ীই কারখানা চালু করা হবে।
করোনা সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ সামলাতে চলতি বছরের এপ্রিলে সরকার বিধিনিষেধ দিলেও রপ্তানিমুখী পোশাকসহ অন্যান্য শিল্পকারখানা উৎপাদন কার্যক্রম অব্যাহত রাখার সুযোগ পায়। সর্বশেষ গত ২৮ জুন শুরু হওয়া সীমিত পরিসরের ও পরে ১ জুলাই থেকে চলমান কঠোর বিধিনিষেধেও পোশাকসহ অন্যান্য শিল্পকারখানা চালু থাকে। তবে গত মঙ্গলবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ নতুন প্রজ্ঞাপন জারি করে বলেছে, ঈদ–পূর্ববর্তী ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা, দেশের আর্থসামাজিক অবস্থা এবং অর্থনৈতিক কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখার স্বার্থে ১৪ জুলাই মধ্যরাত থেকে ২৩ জুলাই সকাল পর্যন্ত সব ধরনের বিধিনিষেধ শিথিল থাকবে। এরপর আবার কঠোর বিধিনিষেধ শুরু হবে। চলবে ৫ আগস্ট রাত ১২টা পর্যন্ত। এই সময়ের কঠোর বিধিনিষেধে সব ধরনের শিল্পকারখানা বন্ধ থাকবে।
অধিকাংশ কারখানার মালিক ঈদের সাধারণ ছুটি দিয়েছেন চার থেকে সাত দিন। তবে ছুটির নোটিশে তাঁরা উল্লেখ করছেন, ঈদের ছুটির পর করোনা সংক্রমণ রোধে সরকার ঘোষিত বিধিনিষেধে কারখানা বন্ধ থাকবে। পরবর্তী সময়ে সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ীই কারখানা চালু করা হবে।
সরকারের এমন সিদ্ধান্তের পর দুশ্চিন্তায় পড়ে যান তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকেরা। বিষয়টি নিয়ে গত বুধবার রাজধানীর গুলশানে বিজিএমইএর কার্যালয়ে জরুরি বৈঠক হয়। সেই বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পরদিন বৃহস্পতিবার পোশাক ও বস্ত্র খাতের ব্যবসায়ীদের একটি প্রতিনিধিদল মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলামের সঙ্গে বৈঠক করেন। এ সময় প্রতিনিধিদলটি কারখানা খোলার রাখার যৌক্তিকতা তুলে ধরে সচিবের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী বরাবর চিঠি দেয়।
সেই বৈঠকের পর তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ ও নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর নেতারা গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, শনিবার সরকার সিদ্ধান্ত দিতে পারে। কিন্তু সরকার শনিবার কোনো সিদ্ধান্ত দেয়নি। তখন নেতারা বলেন, ঈদের আগে শেষ কর্মদিবস সোমবারের (আজ) মধ্যে সিদ্ধান্ত আসবে। কিন্তু আজ বিকেল পর্যন্ত মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে কোনো নির্দেশনা আসেনি।
সরকার নতুন করে কোনো নির্দেশনা না দেওয়ায় আজ সকালে বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান সদস্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে একটি খুদে বার্তা পাঠান। তাতে তিনি করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হলে ১ আগস্ট থেকে কারখানা চালু করার প্রস্তুতি রাখার কথা জানান।
জানা যায়, ঈদের পর বিধিনিষেধে কারখানা খোলা রাখা না রাখা নিয়ে সদস্যরা প্রতিনিয়ত বিজিএমইএর নেতাদের কাছে জানতে চান। অন্যদিকে সরকারও নতুন করে কোনো নির্দেশনা না দেওয়ায় আজ সকালে বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান সদস্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে একটি খুদে বার্তা পাঠান। তাতে তিনি করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হলে ১ আগস্ট থেকে কারখানা চালু করার প্রস্তুতি রাখার কথা জানান।
বিজিএমইএ সভাপতির বার্তাটি এ রকম, ‘দেশে করোনা সংক্রমণ উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। সরকারের সর্বশেষ প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে ২৩ জুলাই থেকে আগামী ৫ আগস্ট পর্যন্ত দেশে সর্বাত্মক বিধিনিষেধ থাকবে। এ সময় আমরা সবাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে ঈদ উদযাপন করব এবং অপ্রয়োজনে বাইরে যাওয়া থেকে বিরত থাকার চেষ্টা করব। করোনার সংক্রমণ পরিস্থিতির উন্নতি হওয়া সাপেক্ষে আগামী ১ আগস্ট থেকে শিল্পকারখানা পরিচালনার প্রস্ততি রাখার আশাবাদ ব্যক্ত করছি। পরিস্থিতি বিবেচনায় এ–সংক্রান্ত করণীয় পরবর্তী নির্দেশনার মাধ্যমে জানানো হবে।
বিষয়টি নিশ্চিত করে বিজিএমইএর সহসভাপতি শহিদউল্লাহ আজিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতির উন্নতি হওয়া সাপেক্ষে আগামী ১ আগস্ট কারখানা পুনরায় চালু করার আশা করছি। যদিও সরকার কোনো নির্দেশনা দেয়নি। ফলে সর্বশেষ প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী সদস্যদের কারখানা বন্ধ রাখতে বলেছি।’
মন্ত্রিপরিষদ সচিবের সঙ্গে বৈঠক ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি দেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা আশা করেছিলাম, সরকারের তরফ থেকে নির্দেশনা পাওয়া যাবে। সেটি না পাওয়ায় আমরাও সদস্যদের কোনো নির্দেশনা দিতে পারিনি। গত কয়েক দিন আমাদের কঠিন সময় পার করতে হয়েছে।
মোহাম্মদ হাতেম, সহসভাপতি,বিকেএমইএ
কারখানায় ঈদের ছুটি কীভাবে দেওয়া হচ্ছে, সেটি জানতে চট্টগ্রামের একটি কারখানার মালিকের সঙ্গে আমাদের কথা হয়। তিনি জানান, তাঁর কারখানা ২০ থেকে ২৬ জুলাই পর্যন্ত সাত দিন বন্ধ থাকবে। এর মধ্যে সরকারি ছুটি তিন দিন ও সাপ্তাহিক ছুটি এক দিন। বাকি তিন দিনের ছুটি শ্রমিকদের অর্জিত ও ঐচ্ছিক ছুটির সঙ্গে সমন্বয় করা হবে। তবে ২৭ জুলাই বিধিনিষেধ থাকায় সরকার পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত কারখানা বন্ধ থাকবে। সরকার নির্দেশনা দিলেই কারখানা খোলা হবে।
আবার নারায়ণগঞ্জের একজন পোশাক কারখানার মালিক জানালেন, ২৩ জুলাই পর্যন্ত সাধারণ ছুটি। এরপর বিধিনিষেধ থাকায় সেই ছুটি বাড়বে। তবে সরকার কারখানা চালু করার অনুমতি দিলে খুলবে। শ্রমিকদের সেভাবেই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
জানতে চাইলে বিকেএমইএর সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘মন্ত্রিপরিষদ সচিবের সঙ্গে বৈঠক ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি দেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা আশা করেছিলাম, সরকারের তরফ থেকে নির্দেশনা পাওয়া যাবে। সেটি না পাওয়ায় আমরাও সদস্যদের কোনো নির্দেশনা দিতে পারিনি। গত কয়েক দিন আমাদের কঠিন সময় পার করতে হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘আমরা আশা করছি, করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতির উন্নতি হলে ৫ আগস্টের আগেই আমরা কারখানা খোলার সুযোগ পাব।’
মোহাম্মদ হাতেম আরও বলেন, কারখানায় উৎপাদন না চললেও রপ্তানি কার্যক্রম চালু থাকবে। কোনো কারখানার পণ্য যদি প্রস্তুত থাকে, তাহলে তা জাহাজীকরণের জন্য বন্দরে পাঠাতে পারবে।
কঠোর বিধিনিষেধে কারখানা খোলা রাখার পক্ষে গত কয়েক দিন পোশাকশিল্পের মালিকেরা বিভিন্ন যুক্তি দিয়েছেন। সেগুলো হচ্ছে করোনার চ্যালেঞ্জের মধ্যেও বাংলাদেশের পোশাক খাত ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে, প্রচুর ক্রয়াদেশ আসছে। কারণ, ইউরোপ-আমেরিকায় করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে। এই সময়ে ক্রেতারা যখন বিধিনিষেধের কথা শুনবে, তখন তারা অন্য দেশে ক্রয়াদেশ দেবে। আবার ঈদের পর লম্বা সময় বন্ধ থাকলে চলমান ক্রয়াদেশের পণ্য সময়মতো রপ্তানি করা যাবে না। তখন ক্রেতাদের কাছে উড়োজাহাজে পণ্য পাঠাতে হতে পারে। সেটি হলে পোশাকশিল্পে লোকসানের পরিমাণ বেড়ে যাবে।