বস্ত্রখাতে নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলতে যাচ্ছে ম্যাকসন্স গ্রুপ। নতুন করে প্রায় এক হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ নিয়ে কাজ করছে বস্ত্রখাতের অন্যতম বড় এই শিল্পগোষ্ঠী। চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরে (বিএসএমএসএন) স্থাপন হতে যাচ্ছে ম্যাকসন্স গ্রুপের তিনটি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের শাখা। এজন্য জমি বরাদ্দের ইজারার চুক্তি হয়েছে গত বছরের শেষে। আনুষ্ঠানিকভাবে জমি বুঝে পাওয়ার পর পরই শুরু হবে অবকাঠামো নির্মাণের কাজ।
পুঁজিবাজারে বস্ত্রখাতে বর্তমানে ম্যাকসন্স গ্রুপের দুটো প্রতিষ্ঠান তালিকাভুক্ত রয়েছে। এর মধ্যে মেট্রো স্পিনিং মিলস পুঁজিবাজারে এসেছে ২০০২ সালে। ২০০৯ সালে ডিএসইতে তালিকাভুক্ত হয় ম্যাকসন্স স্পিনিং মিলস। করোনা মহামারির মন্দার বাজারেও প্রতিষ্ঠান দুটি লাভের ধারায় রয়েছে। বিনিয়োগকারীরাও পেয়েছেন এই লাভের ভাগ।
এই গ্রুপের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে—গার্ডেনিয়া ওয়্যারস লিমিটেড, ম্যাকসন অ্যাপারেলস লিমিটেড, লা-মুনি অ্যাপারেলস লিমিটেড, ম্যাক সোর্সিং লিমিটেড, এসপেন সিরামিকা, ম্যাকসন টেক্সটাইল লিমিটেড, ম্যাককট ইন্টারন্যাশনাল, ম্যাকসন প্রোপার্টিজ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড এবং ম্যাকসন লজিস্টিক লিমিটেড।
বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) তত্ত্বাবধায়নে গড়ে ওঠা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্প নগরে প্রতিষ্ঠা হতে যাওয়া ম্যাকসন গ্রুপের তিনটি প্রতিষ্ঠান হচ্ছে—মেট্রো স্পিনিং মিলস, ম্যাকসন্স স্পিনিং মিলস ও ম্যাকসন স্পিনিং মিলস (ইউনিট-২)। প্রতিষ্ঠান তিনটি গড়তে গত ডিসেম্বরের শেষ দিকে বেজার সঙ্গে ৩০ একর জমির ইজারা চুক্তি করেছে প্রতিষ্ঠানটি।

ম্যাকসন গ্রুপ সূত্রে জানা যায়, বঙ্গবন্ধু শিল্প নগরীতে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের আয়তন হবে ১০ একর। এর মধ্যে চার কোটি ডলার বিনিয়োগ করবে মেট্রো স্পিনিং মিলস। এতে প্রায় এক হাজার ২০০ লোকের কর্মসংস্থান হবে। ম্যাকসন্স স্পিনিং মিলস প্রায় তিন কোটি ডলার বিনিয়োগের মাধ্যমে একটি টেক্সটাইল মিল স্থাপন করবে। এতে ৮০০ লোকের কর্মসংস্থান হবে। ম্যাকসন স্পিনিং মিলস (ইউনিট-২ ) এ চার কোটি ১০ লাখ ডলার বিনিয়োগ করা হবে। এতে কর্মসংস্থান হবে প্রায় এক হাজার ২০০ জনের। তিন প্রতিষ্ঠানের মোট বিনিয়োগ দাঁড়াবে ১১ কোটি ৩০ লাখ ডলার। স্থানীয় মুদ্রায় প্রায় ৯৬০ কোটি টাকা। প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে চার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হবে নতুন এই বিনিয়োগে।
প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধাররা মনে করেন, নতুন শিল্প নগরীতে বিনিয়োগের ফলে পোশাক উৎপাদনের প্রধান কাঁচামাল কাপড় আমদানি নির্ভরতা অনেকটা কমবে। কমে আসবে রপ্তানি প্রক্রিয়ার সময় লিড টাইমও। যা তৈরি পোশাক রপ্তানি বাণিজ্যকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাবে।
জানতে চাইলে ম্যাকসন্স গ্রুপের ব্যবস্থাপক (এইচআর, কমপ্লায়েন্স অ্যান্ড অপারেশন্স) জুয়েল রানা ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্প নগরে জমি বরাদ্দের জন্য সব ধরনের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয়েছে। নগরীটিতে কিছু অবকাঠামো তৈরির বিষয় আছে। ওই অবকাঠামো নির্মাণের দায়িত্ব বেজার। যদিও কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারা এসব অবকাঠামো নির্মাণ কাজ শেষ করেছে। কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান উৎপাদনেও গেছে। কিন্তু সব জায়গায় সম্মিলিতভাবে অবকাঠামোগত কাজ শেষ হয়নি। তাই আমাদেরও অপেক্ষা করতে হচ্ছে। ’

প্রতিষ্ঠানটির প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন এই কর্মকর্তা বলেন, ‘অনেক বড় শিল্প নগরী হচ্ছে। এটিকে মিনি সিঙ্গাপুর বলা হচ্ছে। পুরো শিল্প নগর গড়ে তুলতে বেজার নিজস্ব অর্থায়ন এবং বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নেও কাজ চলছে। জোন এবং ব্লক অনুযায়ী কাজ হচ্ছে। আমাদের পড়েছি বিজিএমইএর টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোনে। ওই জোনের এখনো গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির সংযোগও পাওয়া যায়নি। একটা সেন্ট্রাল ইটিপি হওয়ার কথা সেটিও হয়নি। বেজা অবকাঠামো নির্মাণের কাজ শেষ করলেই আমরা নিজেদের অবকাঠামো তৈরির কাজ শুরু করব। ’
চট্টগ্রামের মিরসরাই, সীতাকুণ্ড ও ফেনীর সোনাগাজীতে প্রায় ৪৬ হাজার একর জমির উপর একটি পূর্ণাঙ্গ শিল্প শহর গড়ে তুলছে বেজা, যার নামকরণ করা হয়েছে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্প নগর’। শিল্প নগরটি ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক থেকে ১০ কিলোমিটার ও চট্টগ্রাম থেকে ৬৫ কিলোমিটার দূরে।
বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র, সমুদ্র বন্দর, কেন্দ্রীয় বর্জ্য ব্যবস্থাপনা/পানি শোধনাগার, আবাসিক এলাকা, বাণিজ্যিক এলাকা, বিশ্ববিদ্যালয় ও হাসপাতাল থাকছে এই শিল্পনগরে। এ লক্ষ্যে বেজা সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের সহযোগিতায় সংযোগ সড়ক, ভূমি উন্নয়ন এবং প্রতিরক্ষা বাঁধ, ব্রিজ নির্মাণ, গ্যাস সংযোগ লাইন স্থাপন করছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, রপ্তানিমুখী পোশাক শিল্পসহ অন্যান্য খাতে অভ্যন্তরীণ চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে ৬০ শতাংশ ঘাটতি রয়েছে। রপ্তানিমুখী পোশাক শিল্পে এখন প্রায় সাত থেকে আট বিলিয়ন ডলার মূল্যের কাপড় আমদানি করতে হচ্ছে।

নতুন শিল্পের জন্য জমি ইজারা চুক্তির অনুষ্ঠানে ম্যাকসন গ্রুপের চেয়ারম্যান এবং বস্ত্রকল মালিকদের সংগঠন টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন বলেন, ‘টেক্সটাইল শিল্পে আমার ৩৫ বছর ব্যবসা করার অভিজ্ঞতা। সর্বশেষ বছরে ৭৭ মিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে, আগামীতে ১০০ মিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করছি। ’
শিল্পোদ্যোক্তা মোহাম্মদ আলী খোকন বলেন, ‘নতুন এই শিল্প ইউনিটগুলোতে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতি স্থাপনের মাধ্যমে উন্নত মানের সুতা ও কাপড় উৎপাদন করা হবে। এই তিনটি প্রতিষ্ঠান যদি আমরা সফলভাবে দাঁড় করাতে পারি তাহলে এখান থেকেও একশ মিলিয়ন ডলার রপ্তানির সুযোগ তৈরি হবে।’
রপ্তানি পোশাক শিল্পের সম্ভাবনার বিষয়টি তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘দুই ঈদ, পুজা, নববর্ষের চারটি উৎসবকে কেন্দ্র করে আট বিলিয়ন ডলারের পোশাক ও কাপড়ের বাজার তৈরি হয়। আমরা চাই এই চাহিদার শতভাগ যেন দেশীয় জোগান থেকে নিশ্চিত করা যায়।’