ট্যানারি মালিকরা আনুষ্ঠানিকভাবে আড়ৎদারদের কাছ থেকে কাঁচা চামড়া কেনা শুরু করেছেন। কিন্তু তা খুবই সামান্য। গত ৩১ জুলাই থেকে চামড়া কেনা শুরু হয়। এ পর্যন্ত কোরবানির সময় কেনা চামড়া বিক্রি হয়েছে মাত্র ১২ থেকে ১৭ শতাংশ। বাকিটা পড়ে আছে রাজধানীর অদূরে কাঁচা চামড়ার বড় বাজার পোস্তার আড়তে। এসব চামড়া কবে নাগাদ পুরোটা বিক্রি হবে তা জানেন না পোস্তার ব্যবসায়ীরা। লবণ মাখানো এসব চামড়া নির্দিষ্ট একটা সময় পর পানি ছেড়ে দেয়। তখন চামড়া কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলে বিধায় ট্যানারি মালিকরা তা কিনতে চান না। পরিস্থিতি এমন হলে বিপাকে পড়বেন ক্ষুদ্র চামড়া ব্যবসায়ীরা। তাই লবণ মাখানো এসব চামড়া নিয়ে অনেকটাই অনিশ্চয়তায় রয়েছেন তারা। পোস্তার ক্ষুদ্র চামড়া ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
তারা জানিয়েছেন, বৈশ্বিক মহামারি করোনার কারণে চামড়ার আন্তর্জাতিক বাজার এখন বিপর্যস্ত। বাজারের অভাবে অনেকেই আগের অর্ডার বাতিল করেছে। কারণ বিশ্বের সব দেশেই করোনার প্রভাবে হয় লকডাউন চলছে, নয়তো বাণিজ্য সীমিত করতে হয়েছে। এ সব মিলিয়ে বাংলাদেশের চামড়ার বাজার নিয়ে উদ্বেগ উৎকন্ঠায় দিন পার করছেন সংশ্লিষ্টরা।
জানা গেছে, ব্যাংক ঋণ না পাওয়ায় কোরবানির চামড়া কেনার ক্ষেত্রে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন ট্যানারী ব্যবসায়ীরা। অনেক ট্যানারি মালিকই বিভিন্ন কারণে ইতিমধেই ঋণ খেলাপি হয়েছেন। আগের পাওনা টাকার অধিকাংশই পরিশোধ করেননি তারা। ট্যানারি মালিকদের কাছে এখনও কোটি কোটি টাকা পাওনা রয়েছে। কিছু ট্যানারি মালিক এবারও বাকিতে চামড়া কেনার আগ্রহ ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু আড়তদাররা রাজি নন। তাই আড়তেই পড়ে আছে লবণে মাখানো সব কাঁচা চামড়া।
সংশ্লিষ্টরা জানান, স্বাভাবিক সময়ে কোরবানির পর এ সময়ে জমানো মোট চামড়ার ৬০ শতাংশ বিক্রি হলেও এবার তা হয়নি। লবণযুক্ত চমড়া দেড় থেকে সর্বোচ্চ দুই মাস ভালো থাকে। এর পরই নষ্ট হতে শুরু করে। তখন ওই চামড়া ফেলে দেওয়া ছাড়া আর কোনও পথ খোলা থাকে না।
পোস্তার ক্ষুদ্র চামড়া ব্যবসায়ী শওকত আলী জানিয়েছেন, ধার দেনা করে চামড়া কিনেছি। বিক্রি করেই ধারদেনা পরিশোধ করবো বলে। কিন্তু এ বছর ট্যানারি মালিকরা তো চামড়া কিনতে চাচ্ছেন না চাহিদা নেই বলে। আবার অনেকে তা বাকিতে কিনতে চাচ্ছেন। বাকিতে বিক্রি করলে ধারদেনা পরিশোধ করবো কী দিয়ে?
তিনি জানান, মাস খানেকের মধ্যে বিক্রি করতে না পারলে চামড়ায় পানি ছেড়ে দেবে। চামড়া পঁচে যাবে। তখন সেই চামড়া ফেলে দিতে হবে। অপরদিকে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ভাড়া করা গুদামের ভাড়া বাড়তে থাকলে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হবো।
সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, চামড়ার বাজার প্রতিবছরই নামছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে যেখানে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রফতানি ছিল ১২৩ কোটি ডলার। ২০১৭-১৮-তে তা নেমে আসে ১০৮ কোটি ডলারে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আরও নেমে ১০২ কোটি ডলারে এসে ঠেকে। করোনার কারণে ২০১৯-২০ অর্থবছর এ খাতের অবস্থা আরও নাজুক। কাঙ্ক্ষিত হারে রফতানিও করা যায়নি বলে জানিয়েছেন তারা।
ট্যানারি মালিকরা জানান, ইউরোপ-আমেরিকার নামকরা আমদানিকারকরা সাভারের চামড়াপল্লীতে এসে পরিবেশ খারাপ দেখে ফিরে গেছেন। এমন নানা প্রতিবন্ধকতা থাকায় ভালো ক্রেতাদের কাছে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য বিক্রি করা যাচ্ছে না। দিন দিন তাই কমছে এ খাতের রফতানি।
কাশেম ট্যানারির সরোয়ার হোসেন জানিয়েছেন, পণ্যের চাহিদা নাই। নতুন অর্ডারও নাই। গতবছরের চামড়ার মজুদ রয়ে গেছে। নতুন চামড়া কেনার প্রয়োজন নেই বলে এ বছর এখনও কিনছি না। বিদেশি ক্রেতারা গতবছর যে পণ্য কিনেছে তাদের কাছে পাওনা টাকাও পাওয়া যায়নি। করোনার কারণে তাদের ব্যবসা বন্ধ বলে জানিয়েছে। তাই এখন টাকা দিতে পারছে না। অন্যদিকে ব্যাংকের কাছ থেকেও ঋণ পাওয়া যায়নি।
সূত্র জানায়, করোনার কারণে চীন ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশের প্রায় একশ কন্টেইনার চামড়ার চুক্তি বাতিল করে। এ কারণে চামড়াশিল্পকে একটি বড় অঙ্কের লোকসান গুণতে হচ্ছে। দেশীয় বাজারেও চাহিদা নেই।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি জানিয়েছেন, করোনার কারণে সব কিছুই মন্দার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। চামড়া খাত এর বাইরে নয়। তবে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। পরিস্থিতি উত্তরণের। দেশের চামড়া শিল্পকে এগিয়ে নিতে নানা ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। আশা করছি আমাদের দেশের চামড়া খাত উন্নতি করবে।