কভিড-১৯ মহামারীর অভিঘাতে অন্য শিল্পগুলোর মতো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশের পোশাক খাতও। অনেক কারখানার ব্যবসা কমেছে। মুনাফা কমেছে বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানেরই। কভিডকালে আয়-মুনাফা কমে গেছে এমন প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকদের চাকরি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চায় আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও)। এ জন্য জার্মান সরকারের সহযোগিতায় ঘোষণা হয়েছে প্রকল্পও, যার আওতায় শ্রমিকের জন্য এককালীন মজুরি বাবদ ভর্তুকি পাবে সংশ্লিষ্ট পোশাক কারখানা।
২০২০ সালের মার্চে বাংলাদেশে প্রথম কভিড-১৯-এর সংক্রমণ শনাক্ত হয়। এরপর সাধারণ ছুটির নামে অঘোষিত লকডাউনে অর্থনীতি কার্যত স্থবির হয়ে পড়ে। এপ্রিল থেকে জুন সময়ে কার্যাদেশের অভাবে অনেক কারখানা সাময়িক ও স্থায়ী বন্ধ হয়ে যায়। কর্মচ্যুত হন অনেক শ্রমিক। একদিকে করোনা অন্যদিকে বেকারত্ব, জীবন ও জীবিকার টানাপোড়েনে বিপর্যস্ত শ্রমিকদের সহায়তায় এগিয়ে আসতে আগ্রহী হন পোশাক খাতের স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক মহলের সংশ্লিষ্টরা।
গত বছরের শেষার্ধে শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের তাগিদে সহায়তার আগ্রহ প্রকাশ করে আইএলও। হাতে নেয়া হয় ‘এমপ্লয়মেন্ট রিটেনশন ফর আরএমজি ওয়ার্কার্স: কভিড-১৯ রেসপন্স’ শীর্ষক প্রকল্প। সহযোগিতা নিশ্চিত করা হয় জার্মান সরকারের অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়নবিষয়ক মন্ত্রণালয় বা ফেডারেল মিনিস্ট্রি ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিএমজেড)। এরপর প্রস্তাব দেয়া হয় পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএকে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, কভিডে ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের চাকরি নিরাপত্তা নিশ্চিতে বাংলাদেশ সরকারই প্রথম উদ্যোগী হয়। মজুরি পরিশোধ বাবদ স্বল্প সুদে ঋণ গ্রহণের ব্যবস্থা করে দেয়া হয় শিল্পোদ্যোক্তাদের। প্রণয়ন করা হয় শ্রমিকের সুরক্ষাসংক্রান্ত নীতিমালা, যার মাধ্যমে ইউরোপীয় ইউনিয়নের পক্ষ থেকে অর্থসহায়তা দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়। এ রকমই আরেকটি উদ্যোগ আইএলও ও বিএমজেডের।
জানা গেছে, গত বছরের শেষার্ধে প্রস্তাব এলেও এ প্রকল্প নিয়ে খুব বেশি অগ্রসর হতে পারেনি সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলো। মূলত ক্ষুদ্র ও মাঝারি আকারের কারখানাগুলোর ক্ষতির ভার লাঘবের লক্ষ্য ছিল প্রকল্পটির। কথা ছিল বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ ক্ষতিগ্রস্ত কারখানা বাছাই করবে। আর সেই কারখানাগুলোর শ্রমিকদের মজুরি বাবদ ভর্তুকি দেয়া হবে। অতিসম্প্রতি বিজিএমইএ কারখানা বাছাই প্রক্রিয়া শুরু করেছে। এদিকে বিকেএমইএ প্রায় ১০০ ক্ষতিগ্রস্ত কারখানা বাছাই প্রক্রিয়া শেষ করেছে। এক্ষেত্রে অনুসরণ করা হচ্ছে সুনির্দিষ্ট কিছু মানদণ্ড।
সূত্র জানিয়েছে, শতভাগ রফতানিমুখী তৈরি পোশাক কারখানা ব্যবসায়িক ক্ষতির সম্মুখীন হলে সেই কারখানায় কর্মরত শ্রমিকদের চাকরির নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্য নেয়া হয়েছে প্রকল্পটি। সহায়তা পেতে প্রথম মানদণ্ডটি হলো কারখানায় কর্মরত শ্রমিকের সংখ্যা হতে হবে ২০০ থেকে ৫০০-এর মধ্যে। ২০২০ সালে কারখানার আর্থিক ক্ষতিসংক্রান্ত মানদণ্ডের মধ্যে আছে আয় বা ক্রয়াদেশ ন্যূনতম ১০ শতাংশ কমে যাওয়া। অথবা ন্যূনতম ৩০ শতাংশ হারে মুনাফা হ্রাস পাওয়া। অথবা ২০২০ সালের মার্চ থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ক্রেতার পক্ষ থেকে পণ্যের মূল্য দেরিতে পরিশোধ হওয়া।
এসব মানদণ্ড উল্লেখ করে ২১ আগস্ট সংগঠনের সদস্যদের আবেদন করতে বলেছে বিজিএমইএ। সংগঠনটির আহ্বানে সাড়া দেয়ার সময়সীমা বেঁধে দেয়া হয়েছে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত। সংগঠনটি তাদের সদস্যদের জানিয়েছে, আইএলও ও বিএমজেডের যৌথ অর্থায়নে প্রকল্পটির আওতায় ক্ষতিগ্রস্ত কারখানায় কর্মরত প্রত্যেক শ্রমিক এককালীন মজুরি ভর্তুকি বাবদ ৩ হাজার টাকা পাবেন।
জানতে চাইলে বিজিএমইএর সহসভাপতি শহিদউল্লাহ আজিম বণিক বার্তাকে বলেন, প্রকল্পটির আওতায় সংগঠনের সদস্যদের আবেদন করতে বলা হয়েছে। অনেক কারখানাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আবেদন পাওয়ার পর বাছাই করা হবে।
এদিকে বিকেএমইএ প্রতিনিধিরা বলছেন, কভিডের প্রভাব লাঘবে প্রকল্পটির আওতায় সহায়তা পাবে পোশাক কারখানা। এ লক্ষ্যেই জার্মান সরকার একটি তহবিল ঘোষণা করেছিল। দীর্ঘদিন ধরে সেই তহবিল ব্যবহারের পদ্ধতি নিয়ে আমাদের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। একটা পর্যায়ে সিদ্ধান্ত হয় তুলনামূলক ছোট আকারের ক্ষতিগ্রস্ত কারখানাগুলোর জন্য তহবিলটি ব্যবহার করা হবে।
বিকেএমইএর প্রথম সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বণিক বার্তাকে বলেন, গত বছরের শেষার্ধে প্রস্তাব পাই আমরা। এ নিয়ে একাধিকবার আলোচনা করে শ্রমিক সংখ্যা বিবেচনায় নির্দিষ্ট আকারের ক্ষতিগ্রস্ত কারখানাকে সহায়তার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সে সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কারখানা বাছাই প্রক্রিয়া প্রায় শেষ পর্যায়ে। তহবিলটি অপব্যবহারের কোনো সুযোগ নেই।
কভিড-১৯-এর প্রভাবে কর্মহীন হয়ে পড়েছেন দেশের বিপুলসংখ্যক শ্রমিক। তাদের এ আপত্কালে সহায়তাস্বরূপ উদ্যোগ রয়েছে নগদ অর্থ প্রদানের। সরকারের পাশাপাশি এ উদ্যোগে হাত বাড়িয়েছে আন্তর্জাতিক মহল। নীতিমালার আওতায় সমন্বিত ওই কর্মসূচিতে তহবিলের আকার ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকারও বেশি। তবে এখন পর্যন্ত এ তহবিলের অর্থছাড়ের হার ১ শতাংশের অনেক নিচে।
সরকারের পক্ষে গত বছরের ৭ অক্টোবর একটি নীতিমালা জারি করে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। রফতানিমুখী পোশাক, চামড়াজাত পণ্য ও পাদুকা শিল্পের শ্রমিকদের মাসে সর্বোচ্চ ৩ হাজার টাকা করে নগদ সহায়তা দেয়া হবে, এমন বিধান রেখে জারি হয় নীতিমালা। ‘রফতানিমুখী তৈরি পোশাক, চামড়াজাত পণ্য ও পাদুকা শিল্পের কর্মহীন হয়ে পড়া ও দুস্থ শ্রমিকদের জন্য সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়ন নীতিমালা-২০২০’ শীর্ষক ওই নীতিমালাটি অবিলম্বে কার্যকরের ঘোষণাও দেয়া হয়।
নীতিমালায় বলা হয়, এ কার্যক্রমের আওতায় নির্বাচিত প্রত্যেক শ্রমিককে মাসিক ৩ হাজার টাকা করে নগদ সহায়তা দেয়া হবে। একজন শ্রমিক সর্বোচ্চ তিন মাস এ নগদ সহায়তা পেতে পারেন। তবে নির্বাচিত শ্রমিক এ তিন মাসের মধ্যে পুনরায় পূর্বতন কারখানায় বা অন্যত্র কোথাও নতুন কর্মে নিযুক্ত হলে ওই মাস থেকে আর এ নগদ সহায়তা প্রাপ্য হবেন না। এ কর্মসূচিতে অর্থায়নে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জার্মান সরকারের পাশাপাশি অংশ নেয় বাংলাদেশ সরকার।
কভিড-১৯-এর প্রভাবে দেশের শিল্প খাতে বিপুল পরিমাণ শ্রমিকের কর্মচ্যুতির ঘটনা ঘটলেও এর সুনির্দিষ্ট সংখ্যা নিশ্চিত করেনি সরকার বা মালিকপক্ষ। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর তথ্যে দেখা যায়, সব খাত মিলিয়ে দুই লক্ষাধিক শ্রমিক কর্মচ্যুত হয়েছেন। এর মধ্যে শ্রমঘন শিল্প খাতগুলোর কাজ হারানো শ্রমিকদের সুনির্দিষ্ট কিছু সংখ্যা পাওয়া যায় শিল্প এলাকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিরাপত্তা তদারকিতে নিয়োজিত শিল্প পুলিশের কাছে। সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী, আশুলিয়া, গাজীপুর, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, খুলনা ও ময়মনসিংহ—এ ছয় শিল্প এলাকায় কর্মচ্যুত শ্রমিকের সংখ্যা ৫০ হাজার ছাড়ায়নি।