পোশাক খাতের সঙ্গে আমাদের প্রজন্মের আরও অনেকের মতো আমিও কোনো না কোনো ভাবে জড়িয়ে গেলাম। প্রায় ২০ বছর আগে ‘জায়ান্ট গ্রুপে’ (ফিরোজ এম হাসান- ফারুক এম হাসানের মালিকাধীন প্রতিষ্ঠান) কাজ করার মধ্য দিয়ে যে গার্মেন্টস সংশ্লিষ্টতা শুরু হয়েছিল, পিএইচডি গবেষণার মধ্যে দিয়ে তা পূর্ণতা পেল। এখনও সেই সংশ্লিষ্টতা এতোটুকুও কমেনি। গত দুসপ্তাহ ধরে বিভিন্ন গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং ব্যক্তিগত আলোচনায় অনেকবার উঠে এসেছে পোশাক রপ্তানিতে ভিয়েতনামের কাছে আমাদের দ্বিতীয় স্থান খোয়ানোর কথাটি। সংশ্লিষ্টতার কারণে কাছের অনেকেই ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় জানতে চেয়েছেন, এই বিষয়ে আমি কী মতামত পোষণ করি।
প্রথমেই বলে নেই, এই সব র্যাংকিংয়ের আপাতদৃষ্টিতে খুব একটা প্রায়োগিক মূল্য আছে বলে আমি মনে করি না। ব্যক্তিজীবনে হোক বা রাষ্ট্র জীবনে, উন্নয়ন একশ মিটারের দৌড় না। এটা ম্যারাথনের মতো। দীর্ঘসময় খুব ভালো ভাবে লেগে থাকাই সাফল্যের মূলকথা। তাই, কেন আমরা তৃতীয় স্থানে গেলাম, তা নিয়ে দুঃখ করার খুব বেশি অবকাশ আছে বলে আমি মনে করি না। পক্ষান্তরে আমি মনে করি আমাদের অন্য সব বিষয়ে আরও একটু যত্নবান হতে হবে। তার মধ্যে আছে, সামগ্রিক বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা। শুধু ভিয়েতনাম না, আমাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতার জন্য আরও অনেকে আছে। তার উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে কম্বোডিয়ার কথা।
সামনে শুল্কমুক্ত সুবিধা উঠে যাওয়ার পর আমাদের নতুন বাস্তবতা, করোনা পরবর্তী (কালীন!) বৈশ্বিক বাণিজ্য এবং বহুল চর্চিত চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে আমাদের করণীয়।
আমি সব সময় মজা করে বলি, ভিয়েতনামের উন্নয়ন বোঝার জন্য আমার কোনো পরিসংখ্যান দেখার দরকার নেই। আমি যখনই আমার ভিয়েতনামিজ বন্ধু ব্যু ভ্যানের দিকে তাকাই, আমি ভিয়েতনামের উন্নয়নের গ্রাফটা বুঝে যাই। ২০০৬-০৭ সালে যখন আমি ভিয়েতনামে ছিলাম, তখন সে ‘প্রায় ভাঙা’ একটি স্কুটি চালাতো। আজ সে দুটো বিএমডাব্লিউয়ের মালিক। ভিয়েতনামে এখনও অটোমোবাইল ট্যাক্স অনেক বেশি। একজন তরুণ উদ্যোক্তা হিসেবে ব্যু ভ্যানের এই বিকাশ আমার কাছে সারা দেশের উন্নয়নের প্রতিবিম্ব। এর পিছনে রয়েছে যথেষ্ট সিস্টেমেটিক এবং স্ট্র্যাটেজিক কর্মপদ্ধতির অনুসরণ। গার্মেন্টসও এর ব্যতিক্রম নয়। আমাদের গার্মেন্টস ক্ষেত্রে স্ট্র্যাটেজিক অপশনগুলো পর্যালোচনা ও সেই মোতাবেক কাজ করার এই হয়তো শেষ সময়। মনে রাখতে হবে আমাদের এই খাতগুলোর অনেক কম্পিটিটিভ অ্যাডভ্যান্টেজ আছে। এটা মনে করার কোনো কারণ নেই যে শুধুমাত্র জিএসটির জোরে আমরা এতদূর এসেছি। অনেকগুলো শক্তিমত্তার জায়গা আছে, যেগুলো সম্পর্কে খুব একটা আলোচনা হয় না। যেমন- আমাদের আছে তরুণ, দক্ষ, উচ্চাকাঙ্ক্ষী একটি মার্চেন্ডাইজিং ওয়ার্ক ফোর্স। যারা প্রায় নীরবে কাজ করে যাচ্ছেন। যাদের কথা খুব বেশি বলা হয় না। আমাদের নিজেদের একটা যথেষ্ট দক্ষ ডিজাইনার জেনারেশন তৈরি হয়ে গেছে। এই রকম আরও অনেক কিছুই আছে। আমার উপলব্ধি হলো— শক্তিমত্তার সম্ভাব্য প্রতিটা জায়গা থেকে আমাদের সর্বোচ্চ সুবিধা নিতে হবে। তা না হলে আকাশে সিঁদুরে মেঘের আনাগোনা শুরু হয়ে যেতে পারে।
আমাদের করণীয় কি? সেটা বলতে গেলে সবার প্রথমে আসে, আমাদের অতিরিক্ত বেসিক প্রোডাক্ট নির্ভরতা কমাতে হবে। এটা নিয়ে ইদানিং যথেষ্ট কথা হচ্ছে। এক্সপোর্ট মার্কেটিংয়ের ভাষায় আমরা যাকে বলি, এক্সপোর্ট প্রোডাক্ট ডাইভার্সিফিকেশন। এটা করতে হবে। আরও একটা সম্পূরক ক্ষেত্র হচ্ছে, এক্সপোর্ট মার্কেট ডাইভার্সিফিকেশন। আমি বিশ্বাস করতে চাই আমাদের বিজিএমইএ এবং ইপিবি এটা নিয়ে কাজ করছে। তাই, এই দুটি বিষয় আমার আজকের আলোচনা থেকে সরিয়ে রাখছি। আজ আমি সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা বিষয়ে আলোকপাত করতে চাই এবং প্রত্যাশা করি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এ নিয়ে চিন্তাভাবনা করবেন।
ছোটবেলায় দেখতাম মা-চাচীরা বিছানার চাদর বলতে বুঝতো কুষ্টিয়া কুমারখালীর চাদর। এখন আপনি প্যারিসে গেলে পরিচিতদের পারফিউম আনতে বলেন। ঠিক একই ভাবে বিখ্যাত মিলানের জুতা, জার্মানির গাড়ি (মেশিন), বসনিয়ার গরুর মাংস, লেবাননের চাল। মার্কেটিংয়ের শিক্ষার্থীরা এটাকে বলে— কান্ট্রি ব্র্যান্ডিং।
কান্ট্রি ব্রান্ডিংয়ের একটা সুনির্দিষ্ট রূপরেখা আছে, কর্ম পদ্ধতি আছে। যা সময় সাপেক্ষ এবং ব্যয়সাধ্য। যার জন্য যথেষ্ট অ্যাকাডেমিক রিসার্চ প্রয়োজন। তবে আমি মনে করি, কান্ট্রি ব্রান্ডিংয়ের দিকে আমাদের এখনই মনোযোগ দেওয়া দরকার। আমি আশঙ্কা করি, যদি আমরা এখনই কান্ট্রি ব্র্যান্ডিং নিয়ে কাজ শুরু না করি তাহলে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যেই ভিয়েতনাম বা কম্বোডিয়া এটা নিয়ে কাজ শুরু করবে। আজ দ্বিতীয় স্থান খোয়ানোর চেয়ে এর প্রভাব আমাদের গার্মেন্টস খাতের ওপর অনেক বেশি হবে। বছর দশেক আগে অসলোতে এক বন্ধু বলেছিল, দুটো চাইনিজ জিন্স না কিনে সে একটু দাম দিয়ে একটা বাংলাদেশি জিন্স কেনার পক্ষপাতী। জানতে চাইলে বলেছিল, দুটো চাইনিজ জিন্সের চেয়ে বাংলাদেশি একটা জিন্স বেশি টেকসই। ব্রাসেলসে এক দোকানে একজনকে জিজ্ঞেস করতে শুনেছি, এই টিশার্টের বাংলাদেশি ভার্সন আছে? কারণ একটাই, ভালো মান আর স্থায়িত্ব। এগুলোকে বলে ব্র্যান্ড অ্যাওয়ার্নেস। যা আমাদের পণ্যের যথেষ্ট আছে। আর কে না জানে, ব্রান্ডিংয়ের অন্যতম পূর্বশর্ত হচ্ছে এই ব্র্যান্ড অ্যাওয়ার্নেস। আমাদের এই বাংলাদেশি পণ্য সচেতন আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের আমাদের পোশাক খাতের পণ্যের সঙ্গে সংযুক্ত করতে হবে। তারা আমাদের থেকে যে ভ্যালু প্রত্যাশা করে, তা যে আমরা খুব ভালো ভাবে দিতে সক্ষম তা বোঝানোর জন্য আমাদের একটা সুনির্দিষ্ট ব্র্যান্ড কমিউনিকেশন সিস্টেম নিয়ে কাজ করতে হবে। আমাদের ট্রেডিং পার্টনারদের এটা নিশ্চিত করতে হবে, আমরা অন্য অনেকের চেয়ে যথেষ্ট প্রফেশনাল। সঙ্গে আছে আমাদের চিরন্তন কর্মঠ শ্রমিক। এর সঙ্গে যুক্ত করতে হবে রিসার্চ কমিউনিটিকে। দেশের বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষকদের এগিয়ে আসতে হবে পোশাক খাতে বাংলাদেশ ব্র্যান্ড নিয়ে কাজ করার জন্য। এর সঙ্গে আমাদের সামগ্রিক অব্যবস্থাপনা কমানোর বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। এটা ব্র্যান্ড ইমেজকে ক্ষতি করার অন্যতম একটা কারণ। শেষে বলতে চাই, বহির্বিশ্বের মানুষ মনে করে আমরা ভালো ও টেকসই জিনিস তৈরি করি। সঙ্গে যোগ করেন, আমাদের ডিজাইন। আমি মনে করি আমাদের কান্ট্রি ব্রান্ডিংয়ের সব উপাদানই বিদ্যমান। এখন দরকার সবগুলো বিষয় এক সরলরেখায় নিয়ে এসে একটি ঐকতান সৃষ্টি করা। যার ইন্দ্রজালে মোহমুগ্ধ হবে সারা বিশ্ব। আমি খুবই সচেতন যে ওপরের বিষয়গুলো কোনোটিই খুব একটা সহজ না।
তবে, কুড়িগ্রাম থেকে আসা বোনটার চোখের দিকে তাকান, সাতক্ষীরা থেকে আসা ভাইটার হাতের দিকে তাকান, আপনি পোশাক খাতে বাংলাদেশ ব্র্যান্ড দেখতে পাবেন। এটা সম্ভব, অবশ্যই সম্ভব।
ড. জালাল আহমেদ, সিনিয়র লেকচারার, মার্কেটিং ডিপার্টমেন্ট, ইউনিভার্সিটি অব স্কোভদে, সুইডেন।