করোনা মহামারির প্রথম ধাক্কায় বিশ্ববাজারে পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশ দ্বিতীয় অবস্থান হারালেও তা আবারো ফিরে পাওয়ার ধারায় চলে এসেছে বলে দাবি করেছে তৈরি পোশাক শিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ। সমপ্রতি বিজিএমইএ যে তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে দেখা গেছে, বছরের প্রথম ছয় মাস শেষে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ভিয়েতনামের চেয়ে পোশাক রপ্তানিতে প্রায় ২০০ কোটি ডলার এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। গত বছর বাংলাদেশকে টপকে গিয়েছিল ভিয়েতনাম।
চলতি বছরের প্রথম ৭ মাসে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে ভিয়েতনামের চেয়ে ১৯৪ কেটি ডলার বেশি আয় করেছে বাংলাদেশ। দুই দেশের সরকারি ডাটা অনুযায়ী, চলতি বছরে জুলাই মাস পর্যন্ত ১ হাজার ৮৭৯ কোটি ডলারের পোশাক পণ্য রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। আর একই সময়ে ১ হাজার ৬৮৬ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে ভিয়েতনাম।
রপ্তানিকারকরা বলছেন, প্রধান রপ্তানিবাজার ইউরোপ ও আমেরিকার দেশগুলোতে মহামারি স্বাভাবিক হতে শুরু করায় বাংলাদেশে ক্রয়াদেশও বেড়েছে। এই ধারা চললে বছর শেষে প্রতিদ্বন্দ্বী ভিয়েতনামকে টপকে যাওয়া যাবে।
তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বিশ্বে বরাবরই শীর্ষে চীন। এক দশক আগে বাংলাদেশ দ্বিতীয় স্থানে উঠে এলেও করোনাভাইরাস মহামারির ধাক্কায় গত বছর বাংলাদেশকে টপকে দ্বিতীয় স্থানে উঠে যায় ভিয়েতনাম।
পোশাক খাত সংশ্লিষ্টরা জানান, দ্বিতীয় ঢেউয়ের সংক্রমণ এখন নিম্নমুখী এবং প্রত্যেক দিনই পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। বিধিনিষেধ তুলে নিয়ে বেশ আগেই ব্যবসায়িক কার্যক্রমসহ শিল্প-কলকারখানা সচল হয়েছে। এসবেরই প্রভাব পড়েছে পোশাক রপ্তানিতে। ভিয়েতনাম থেকে মুখ ফেরানো ক্রেতারা বাংলাদেশে ক্রয়াদেশ বাড়িয়েছেন। কারণ করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে বিপর্যস্ত ভিয়েতনাম। বড় দিনের বিশাল বাজার ঘিরে আন্তর্জাতিক ক্রেতারা বাধ্য হয়ে বিকল্প দেশে ক্রয়াদেশ বাড়িয়ে দেয়। এ সুযোগ লুফে নিয়েছে বাংলাদেশ।
বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) ‘ওয়ার্ল্ড ট্রেড স্ট্যাটিসটিক্যাল রিভিউ’তে দেখা গেছে, ২০২০ সালে বিশ্ববাজারে পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশের অবস্থান তিন নম্বরে। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে ১৪২ বিলিয়ন ডলারের পোশাকপণ্য রপ্তানি করে প্রথম অবস্থানে ছিল চীন। বিশ্ববাজারে তাদের অংশীদারিত্ব ৩১.৬ শতাংশ। দ্বিতীয় অবস্থানে উঠে আসা ভিয়েতনামের রপ্তানির পরিমাণ ছিল ২৯ বিলিয়ন ডলার; বিশ্ববাজারে অংশীদারিত্ব ৬.৪ শতাংশ, যা আগের বছর ছিল ৬.২ শতাংশ। আর গতবছর বাংলাদেশ ২৮ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রপ্তানি করে; মোট বিশ্ব রপ্তানিতে অংশ ৬.৩ শতাংশ, যা আগের বছর ছিল ৬.৮ শতাংশ। ২০১০ সালে তৈরি পোশাকের বিশ্ব রপ্তানি বাজারে ৪.২ শতাংশ অংশীদারিত্ব অর্জন করে তুরস্ককে পেছনে ফেলে দ্বিতীয় অবস্থানে এসেছিল বাংলাদেশ। এরপর থেকে এই অবস্থানেই ছিল। তখন তুরস্কের অবস্থান ছিল ৩, ভারতের অবস্থান ছিল ৪। ওই সময় বিশ্ববাজারে ভিয়েতনামের অবস্থান ছিল তাদের পেছনে। কিন্তু করোনাভাইরাস মহামারির শুরুতে বিশ্বের অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়ায় গত বছরের এপ্রিলে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় তলানিতে গিয়ে ঠেকে। তাতে ভিয়েতনাম পেছন থেকে উঠে এসে বাংলাদেশকে ছাড়িয়ে যায়। তবে এরপর ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি।
বিজিএমইএ’র পরিচালক ও জনসংযোগ কমিটির চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, এখন আপাতত দুই বিলিয়ন ডলার এগিয়ে থাকতে দেখা গেলেও প্রকৃত অর্থে এটা আরও বেশি হবে। কারণ ভিয়েতনাম তাদের পোশাক ও টেক্সটাইল সেক্টর মিলিয়ে তথ্য প্রকাশ করে। আমরা বাংলাদেশের ক্ষেত্রে শুধু পোশাক রপ্তানির কথা বলছি। আমাদের টেক্সটাইল সেক্টরের অন্যান্য পণ্যের রপ্তানি তথ্য যোগ করে বললে অংকটা অনেক বড় হবে। তাই আমরা আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলতে পারি, বাংলাদেশ ২০২১ সালের মধ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক দেশ হবে।
বিজিএমইএ সহসভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম বলেন, চলতি পঞ্জিকা বছর শেষে ডব্লিউটিও’র প্রতিবেদন বাংলাদেশের পক্ষেই আসবে। এখন বছরের মাঝামাঝি সময়ে দুই বিলিয়ন ডলার এগিয়ে আছে। বছর শেষে সেটা ৪ বিলিয়নেরও বেশি ছাড়িয়ে যাবে। কারণ, পোশাক খাতে এখন প্রচুর অর্ডার রয়েছে। আগামী কয়েক মাসের মধ্যে এর প্রতিফলন দেখা যাবে বলে মনে করি।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য মতে, গত অর্থবছরে এক হাজার ৬৯৬ কোটি ডলারের নিট পোশাক রপ্তানি হয়েছে। এ সময় ওভেন পোশাকের রপ্তানির পরিমাণ ছিল এক হাজার ৪৪৮ কোটি ডলার। আগের বছরের বৃদ্ধির তুলনায় নিট পোশাকের রপ্তানি বেড়েছে ২২ শতাংশ। ওভেনে বেড়েছে ৩ শতাংশ।
ওভেনের তুলনায় নিটের বেশি চাহিদার প্রবণতা চলতি অর্থবছরে প্রথম দুই মাসেও অব্যাহত আছে। গত জুলাই ও আগস্ট মাসে নিট পোশাকের রপ্তানি আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় বেড়েছে ৫ শতাংশ। অন্যদিকে ওভেনে কমেছে ৮ শতাংশ।
বিকেএমইএ’র প্রথম সহ-সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, করোনার কারণে বিভিন্ন দেশে শারীরিক উপস্থিতির আনুষ্ঠানিকতা একেবারেই কম। অফিস-আদালতও চলছে অনলাইনে। জরুরি কাজ ছাড়া ঘর থেকে বের হওয়ার প্রয়োজন পড়ছে না অনেকের। এ কারণে ফরমাল পোশাকের চাহিদা কমে এসেছে। এ ছাড়া করোনার প্রভাবে মানুষের আয় কমে গেছে। তাই যেসব ওভেন পোশাকের দাম বেশি, সেগুলো কেনার মতো আর্থিক অবস্থাও নেই অনেকের। অন্যদিকে ওভেনের তুলনায় নিট পোশাকের দাম কম। সব মিলিয়ে, ঘরে ব্যবহার্য আরামদায়ক ইনফরমাল নিট পোশাকের চাহিদাই বেশি। দেশে পরিবর্তিত চাহিদার সুযোগ কাজে লাগাতে বেশকিছু ওভেন পোশাক উৎপাদনের কারখানা নিট পোশাক কারখানায় রূপান্তর করা হয়েছে।