করোনা মহামারির ধাক্কা সামলে সুদিন ফিরে আসছে দেশের প্রধান রফতানি খাত তৈরি পোশাক শিল্পে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ প্রধান প্রধান ক্রেতা দেশে বাংলাদেশের পোশাক রফতানিতে ভালো প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। শুধু তাই নয়, দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলো এবং দক্ষিণ কোরিয়া, ভারতের মতো নতুন দেশের বাজারেও পোশাক রফতানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৮১ শতাংশ পর্যন্ত। এর পাশাপাশি ক্রেতা দেশগুলো থেকে এখন পোশাক রফতানির কার্যাদেশ আসছে ব্যাপক হারে। এ ছাড়া করোনাকালে প্রতিদ্বন্দ্বী অনেক দেশের তুলনায় পোশাক রফতানিতে এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) ও বিজিএমইএ সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাই-আগস্ট মাসের রফতানির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, এ সময়ে পোশাক বাজারের নতুন দেশগুলোতে তুলনামূলকভাবে প্রবৃদ্ধি বেশি। ভারতে পোশাক রফতানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৮১ দশমিক ৩২ শতাংশ। এ সময়ে দেশটিতে পোশাক রফতানি হয়েছে প্রায় ১০ মিলিয়ন ডলার। দক্ষিণ আমেরিকার দেশ চিলিতে পোশাক রফতানির প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৪৪ দশমিক ৭৭ শতাংশ। দেশটিতে অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে রফতানি হয়েছে ২ মিলিয়ন ডলার। এশিয়ার আরেক দেশ দক্ষিণ কোরিয়ায় পোশাক রফতানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২২ দশমিক ১৫ শতাংশ এবং দেশটিতে রফতানি হয়েছে ৩ মিলিয়ন ডলারের পোশাক। অন্যান্য নতুন দেশের মধ্যে আরেক সম্ভাবনাময় বাজার দক্ষিণ আফ্রিকায় পোশাক রফতানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৪ দশমিক ৭৩ শতাংশ এবং পোশাক রফতানি হয়েছে ২ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি। নতুন বাজারের অন্যান্য দেশের মধ্যে এশিয়ার দেশ জাপানে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১ দশমিক ৪৬ শতাংশ। জাপানে পোশাক রফতানি হয়েছে প্রায় পৌনে ২ মিলিয়ন ডলারের। তবে নতুন বাজারের মধ্যে অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল, চীন ও তুরস্কের মতো দেশে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হলেও রফতানির পরিমাণ বেড়েছে।
একক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের শীর্ষ আমদানিকারক দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এই দুঃসময়ের মধ্যেও যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রফতানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৪ দশমিক ৫৭ শতাংশ। গত বছরের প্রথম দুই মাসে যেখানে যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রফতানি হয়েছিল ১ দশমিক ১২ বিলিয়ন ডলারের, সেখানে চলতি বছরের প্রথম দুই মাসে রফতানি হয়েছে ১ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলারের।
একইভাবে দেশের পোশাক শিল্পের বৃহত্তম আঞ্চলিক বাজার ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতেও ধীরে ধীরে রফতানি বাড়ছে। যদিও ইইউ দেশগুলোতে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩ দশমিক ৩৯ শতাংশ, রফতানি হয়েছে প্রায় সাড়ে ৩ বিলিয়ন ডলারের পোশাক।
রফতানি প্রবৃদ্ধির বিষয়টিকে ইতিবাচক হিসেবে দেখলেও ক্রেতা দেশগুলোর সঙ্গে পোশাকের ক্রয়মূল্য বাড়ানোর এখনই সময় বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। এ বিষয়ে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম হোসেন সময়ের আলোকে বলেন, এখন তৈরি পোশাক রফতানির প্রবৃদ্ধিতে যে গতি সেটি গত বছরের লো-বেইজের ওপর ভিত্তি করে। অর্থাৎ গত বছর করোনার শুরুর বছরে পোশাকসহ দেশের রফতানি আয় একেবারে তলানিতে নেমে গিয়েছিল। এ বছর সে অবস্থা থেকে পরিস্থিতি কিছুটা ভালো। এ জন্যই অধিকাংশ দেশে পোশাক রফতানি বাড়ছে। তবে এই অবস্থাকে আমি করোনার ধাক্কা সামলে ঘুরে দাঁড়ানোর সূচনা বলতে পারি। তিনি বলেন, এখন ক্রেতা দেশগুলো থেকে প্রচুর কার্যাদেশ আসছে। করোনার দোহাই দিয়ে ক্রেতারা কম মূল্যে বাংলাদেশ থেকে পোশাক কেনার চেষ্টা করছে এবং অন্য দেশের চেয়ে অনেক কম মূল্যে বাংলাদেশ থেকে তারা পোশাক কিনেছে। এখন তারা প্রচুর অর্ডার দিচ্ছে, প্রতিযোগী দেশগুলোর চেয়ে ক্রেতারা বাংলাদেশের বাজারে ঝুঁকছেন বেশি। এই সুযোগে ক্রেতাদের সঙ্গে দরকষাকষি করতে হবে। কারণ কম মূল্যে পোশাক রফতানি করলে এ খাতের শ্রমিক এবং মালিক উভয়েই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
এদিকে করোনাকালেও প্রতিযোগী দেশগুলোর চেয়েও পোশাক রফতানিতে ভালো অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। বিশেষ করে অন্যতম প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ ভিয়েতনামের চেয়ে ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি পোশাক রফতানি হয়েছে চলতি ক্যালেন্ডার ইয়ারের প্রথম সাত মাসে (জানুয়ারি-জুলাই)।
এ বিষয়ে তৈরি পোশাক প্রস্তুত রফতানিকারক মালিক সমিতির (বিজিএমইএ) পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল সময়ের আলোকে জানান, বাংলাদেশ সরকারের অফিসিয়াল তথ্য এবং ভিয়েতনামের সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালের জানুয়ারি-জুলাই মাসে বাংলাদেশ স্পষ্টভাবে ভিয়েতনামের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে। এই সময়ের মধ্যে ভিয়েতনামের সরকারি রফতানি ১৬ দশমিক ৮৬ বিলিয়ন ডলার যেখানে বাংলাদেশের রফতানি ১৮ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। এ ছাড়া ভিয়েতনাম সরকার তথ্য প্রকাশের সময় তাদের টেক্সটাইল রফতানির সঙ্গে পোশাক রফতানি একত্রিত করে প্রকাশ করে, তাই তারা যে তথ্য প্রকাশ করে তা পুরোপুরি পোশাক রফতানি নয়। সে কারণে আমরা আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলতে পারি, বাংলাদেশ ২০২১ সালের মধ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রফতানিকারক দেশ হবে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) প্রথম সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম সময়ের আলোকে বলেন, করোনার ধাক্কা সামলে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে পোশাক শিল্প। কিন্তু এই ঘুরে দাঁড়ানোতে বাধার সৃষ্টি করছে সুতার অত্যধিক দাম বৃদ্ধি। কয়েক মাস আগেও ৩০ কাউন্টের প্রতিকেজি সুতার মূল্য ছিল ২ দশমিক ৫০ ডলার, সেটি এখন বেড়ে হয়েছে ৪ দশমিক ২৫ ডলার। সমস্যা হচ্ছে সুতার অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধি হলেও ক্রেতারা কিন্তু পোশাকের ক্রয়মূল্য সেভাবে বাড়ায়নি। ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো পোশাকপ্রতি মাত্র ১০ থেকে ১৫ সেন্ট দাম বাড়াচ্ছে, যা দিয়ে উৎপাদন করে পোষাবে না। এ জন্য অনেক উদ্যোক্তা অর্ডার ছেড়ে দিচ্ছে। সুতরাং করোনাপরবর্তী পোশাক শিল্প প্রকৃত সুবিধা পেতে হলে একদিকে সুতার দাম কমাতে হবে, অন্যদিকে ক্রেতা প্রতিষ্ঠানকে তাদের ক্রয়মূল্য বাড়াতে হবে।