বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের শুরুটা গৌরবময়। এরপর ধাপে ধাপে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে পোশাক খাতে নানা অর্জন যোগ হয়েছে। কয়েক দশকের রূপান্তরের অনেকগুলো পর্যায় রয়েছে। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়গুলো হচ্ছে ১৯৭৯ সালে নুরুল কাদের, ২০০৫ সালে এমএফএর সমাপ্তি, ২০১১ সালে ইইউর উৎস শর্ত (রুলস অব অরিজিন) পরিবর্তন ও ইবিএ (এভরিথিং বাট আর্মস)। এগুলো বাংলাদেশের ওপর বড় ধরনের প্রভাব ফেলেছে।
পশ্চিম পাকিস্তানের নির্যাতনের প্রতিবাদে নিজের খান উপাধি ত্যাগ করা নুরুল কাদের ১৯৭৯ সালে জাতীয় দৈনিকে বিজ্ঞাপন এবং মেধাবী তরুণদের নিয়োগ দেন। দাইয়ুর সঙ্গে মিলে কোরিয়ায় এদের পাঠান প্রশিক্ষণের জন্য ও দেশে ১০০ শতাংশ রফতানিকেন্দ্রিক প্রথম গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি স্থাপন করেন তিনি। নুরুল কাদের ও তার দূরদৃষ্টি ছাড়া দেশের আরএমজি খাত এখন যে পর্যায়ে রয়েছে, সেখানে কখনো পৌঁছতে পারত না।
১৯৭৪ সালে মাল্টিফাইবার এগ্রিমেন্ট চালু হয়, যখন উন্নত বিশ্ব অনুভব করল উন্নয়নশীল বিশ্ব থেকে নিজেদের আমদানির সমন্বয়ের প্রয়োজন রয়েছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যেহেতু ইইউ আমদানি সীমিতকরণ প্রত্যাখ্যান করে, রফতানি বাড়তে থাকে। পরে জেনারেল এগ্রিমেন্ট অন ট্যারিফ অ্যান্ড ট্রেড (জিএটিটি) উরুগুয়ে রাউন্ডে টেক্সটাইল বাণিজ্য বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার এখতিয়ারে আসে এবং সবশেষে এগ্রিমেন্ট অন টেক্সটাইল অ্যান্ড ক্লদিং এমএফএর অধীন কোটা পর্যায়ক্রমে বিলুপ্ত করার পথ খুলে দেয়। ২০০৫ সালের ১ জানুয়ারি কোটার বিলুপ্তি ঘটে এবং অনুমান করা হয়েছিল, এ কারণে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি ভুগবে। ২০০৬ সালে বাংলাদেশের রফতানি প্রায় নাটকীয়ভাবে পরিমাণের দিক থেকে বৃদ্ধি পায়, আনুমানিক ৫০০ মিলিয়ন ডলার।
একটা সময় ইইউতে রফতানির জন্য অ্যাপারেল ও ক্লদিং আনুষঙ্গিক উপকরণের বেশির ভাগ শর্ত সুতা থেকে উৎপাদনের কথা বলা ছিল। দ্বিস্তর উৎপাদন নিয়ম-কানুন মানে হচ্ছে, আমদানীকৃত পণ্যের ব্যবহার ম্যানুফ্যাকচারড আউটপুট মূল্যের একটি নির্দিষ্ট শতাংশ অতিক্রম করতে পারবে না। জিএসপি রুলস অব অরিজিনের এ দুই পর্যায়ের ফলে ইইউতে বাংলাদেশের মাত্র ৫৫ শতাংশ রফতানি করতে পারে, যেখানে বাংলাদেশের জিএসপির ব্যবহার ১৯৯৬ সালে ৪১ দশমিক ১৮ শতাংশ থেকে কমে ১৯৯৭ সালে হয় ১৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ। এরপর ইইউ নিজেদের শর্ত সমন্বয় করে ও নিটওয়্যারের জন্য আমদানীকৃত সুতা অনুমোদন এবং ১৯৯৮ সাল থেকে রফতানির বৃদ্ধি পাওয়া শুরু করে। বর্তমানের ইইউ-এভরিথিং বাট আর্মস ইনিশিয়েটিভে আগের জিএসপির অধীনে বাংলাদেশ আজও ইইউতে অস্ত্র ব্যতীত সব পণ্যের ক্ষেত্রে শুল্কমুক্ত, কোটামুক্ত বাজার প্রবেশাধিকার পেয়ে আসছে। আগে বাংলাদেশের নিজের উৎপাদিত প্রায় সব রফতানিজাত পণ্যের ক্ষেত্রে ইসি বাজারে জিরো ট্যারিফ, কোটা ফ্রি প্রবেশাধিকার ছিল, যা রুলস অব অরিজিনের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। যা হোক, ইইউ-ইবিএ স্কিম পরবর্তী সময়ে আরো ৯১৯ ট্যারিফ লাইন চুক্তির অধীনে আসে। ইইউর জেনারেলাইজড সিস্টেম অব প্রেফারেন্সেস, যা ২০১০ সালের ১৮ নভেম্বর রুলস অব অরিজিনের শর্তগুলো সংশোধন করে অ্যাপারেল খাতকে রফতানির সবচেয়ে বড় গন্তব্য এনে দেয়। বাংলাদেশ রাতারাতি দ্বিতীয় বৃহত্তম গার্মেন্ট রফতারিকারক দেশে পরিণত হয়।
এখন কোথায় দাঁড়িয়ে: বতর্মান সময়ে এসে আমাদের এখন পণ্য বৈচিত্র্যকরণের দিকে অগ্রসর হওয়া জরুরি। তৈরি পোশাক খাতকে নতুন একটি পর্যায়ে উত্তরণের জন্য পণ্য বৈচিত্র্যকরণের পাশাপাশি মূল্য সংযোজন (ভ্যালু অ্যাডিশন), সেক্টর বৈচিত্র্যকরণ, উচ্চমূল্য সংযোজিত পণ্য তৈরি (প্রডাক্ট আপগ্রেডেশন) ও তদারকির বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্যও পণ্য বৈচিত্র্যকরণ জরুরি। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাংলাদেশ ৩৪ দশমিক ১৩ বিলিয়ন ডলার তৈরি পোশাক রফতানি করে। ২০১৮ সালে বিশ্বব্যাপী তৈরি পোশাক রফতানির মোট পরিমাণ ছিল ৫০৫ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশের অংশগ্রহণ মাত্র ৬ দশমিক ৪৩ শতাংশ, যদিও বৈশ্বিক বাজারে চীনের অংশগ্রহণ ৩৯ শতাংশ। তবে এফএমএর সমাপ্তির পর বাংলাদেশের পোশাক খাতের রফতানি পাঁচ গুণ বেড়েছে। কারণ উদ্যোক্তারা ‘ভলিউম ড্রাইভেন’ প্রবৃদ্ধি কৌশলের দিকে মনোনিবেশ করেন—যা মৌলিক পোশাক তৈরির প্রতি অধিক গুরুত্ব দেয়। গত চার দশকে আমাদের আরএমজি শিল্পের সক্ষমতা ও প্রবৃদ্ধি বেড়েছে। তবে একই ব্যবসায়িক মডেল অনুসরণ করে এ খাতের প্রবৃদ্ধির গতি অব্যাহত রাখা নিশ্চয়ই সহজ হবে না।
প্রয়োজন পণ্যের মূল্য সংযোজন: আমাদের উৎপাদন খরচ ও মজুরি বাড়লেও পণ্যের ‘মূল্য’ বাড়েনি। যদিও শিল্পটির সামাজিক ও অর্থনৈতিক অগ্রগতি অনন্য, তবে প্রতিযোগিতা ধরে রাখার বিষয়টি ক্রমেই চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠেছে। এ পর্যায়ে শ্রমঘন উৎপাদন থেকে বৈচিত্র্যময় ও উদ্ভাবনী শিল্পে রূপান্তরের জন্য খাতটিকে বর্তমান ‘বাস্তবতা’ অনুধাবনপূর্বক ব্যবসায়িক মডেল পুনর্মূল্যায়ন করতে হবে; বিশেষ করে পণ্য বৈচিত্র্যকরণ, মূল্য সংযোজন ও কাঁচামাল সীমাবদ্ধতার ক্ষেত্রে। আমাদের রফতানীকৃত পণ্যের সিংহভাগ পাঁচটি মৌলিক পণ্যে কেন্দ্রীভূত—ট্রাউজার, টি-শার্ট, সোয়েটার, শার্ট ও জ্যাকেট। এদিকে আরএমজি শিল্পের দ্রুত বৃদ্ধির ফলে এর সঙ্গে লিংকেজ শিল্পগুলোও উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে তুলাভিত্তিক পোশাক ব্যতীত পলেস্টার, ভেজিটেবল ফাইবার কিংবা অ্যানিমেল ফাইবারের ব্যবহার বাড়েনি। ২০০৭ থেকে ২০১৭ সাল নাগাদ তুলাভিত্তিক পোশাকের বিশ্বব্যাপী বাণিজ্যের পরিমাণ শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। বিপরীতে এমএমএফভিত্তিক (ম্যানমেড ফাইবার) পোশাকের বাণিজ্য ৫ শতাংশ বেড়েছে। ২০১৭ সালে এমএফএফভিত্তিক পোশাকের বৈশ্বিক বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ১৫০ বিলিয়ন ডলার, যেখানে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ মাত্র ৫ শতাংশ, অথচ ভিয়েতনামের ১০ শতাংশ। বাংলাদেশে দেখা যায়, একই কারখানার কাছে একই ক্রেতার ক্রয়াদেশ বারবার আসছে। বাংলাদেশ এই রেকর্ড থেকে প্রাপ্ত তথ্যের সুবিধা কাজে লাগিয়ে পরবর্তী সময়ে নতুন ও পুনরাদেশ গ্রহণ করার ক্ষেত্রে আরো ভালো দরকষাকষি করতে পারে।
পণ্য হালনাগাদকরণ আমাদের দেশের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ। যদি একজন প্রস্তুতকারক একটি প্লেইন ব্লাউজ তৈরি করে, তার উচিত হবে পণ্যটি আরো আকর্ষণীয় করে তোলা, তাহলে ক্রেতাভূষণ ও অতিরিক্ত কাজের জন্য বাড়তি অর্থ দেবে। ক্রেতারা যেমন সরবরাহকারীর পণ্যসম্ভারের মধ্যে যতটা মিল খোঁজে, তেমনি বহুমুখী সক্ষমতাও খোঁজে, যেটির কারণে গ্রাহকরা সহজেই অন্যান্য পণ্য আদেশ দিতে পারে ও যার জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি যোগ এবং সমন্বয় করার মাধ্যমে একই প্রডাকশন লাইনে সর্বোচ্চ পণ্য প্রস্তুত করা যেতে পারে। বাংলাদেশ দীর্ঘদিন থেকে মৌলিক কাজ করে আসছে। যখন মিয়ানমার ও ইথিওপিয়া আমাদের ব্যবসা নিজেদের দখলে নেয়ার চেষ্টা করছে, এখন আমাদের উচিত চীন ও ভারত থেকে কিছু ফ্যাশন পণ্য চুরি করা। পরিচালনার ব্যয় বৃদ্ধির সঙ্গে বাংলাদেশকে আরো ভালো দাম পাওয়াকে লক্ষ্যবস্তু করতে হবে। তাছাড়া কতদিন আমরা শুধু ম্যানুফ্যাকচারিংয়ে থাকব? আমাদের এখন সার্ভিস ইকোনমিতেও যাওয়া প্রয়োজন। ভিয়েতনাম যদি ১৬ বিলিয়ন ডলার শুধু সার্ভিস ইকোনমি রফতানি করে তাহলে আমরা কেন পারি না! তাই আমাদের ব্র্যান্ডিংয়ের দিকে মনোযোগ দিতে হবে।
অনেক জায়গায় ঘাটতি রয়ে গেছে আমাদের। আমরা নিজেরা নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা করে দাম কমিয়ে দিচ্ছি। একটা অসাধু প্রতিযোগিতা আমাদের সেক্টরকে গ্রাস করছে, এর জন্য দিনে দিনে দাম কমেই যাচ্ছে। গত চার বছরে ইইউ থেকে আমাদের দাম কমেছে ২ দশমিক ৩৫ ভাগ, অথচ কমপ্লায়েন্সের চাপ বাড়ছে। কমপ্লায়েন্স কিংবা বায়ারদের একের পর এক নির্দেশনা ভারি হতে থাকে। আমাদের উৎপাদিত পণ্যের দাম কমতে থাকে, বিপরীতে দায়িত্ব বাড়তে থাকে। সবকিছুরই একটি ক্রমবিন্যাস প্রয়োজন। এ ভারসাম্যটা কীভাবে আসবে, আমরা কীভাবে নিজেদের ব্র্যান্ড ভ্যালু বাড়াব—এগুলো খুব জটিল বিষয়।
বাজার সম্প্রসারণ: আমাদের রফতানীকৃত তৈরি পোশাকের বেশির ভাগই উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপের বাজারে কেন্দ্রীভূত। তবে গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রফতানি বাজারের বৈচিত্র্যকরণ ঘটছে। পাশাপাশি অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে। নতুন বাজার অনুসন্ধানের ক্ষেত্রেও। প্রাপ্ত তথ্য থেকে আমরা বিষয়টি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাব। যেমন ২০০৮-০৯ অর্থবছরে অপ্রচলিত বাজারে আমাদের রফতানির পরিমাণ ছিল যেখানে মাত্র ৬ দশমিক ৪, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তা বৃদ্ধি পেয়ে ১৬ দশমিক ৬৬ শতাংশ হয়। তবে প্রচলিত ও অপ্রচলিত দুই ধরনের বাজারেই বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রফতানির সম্ভাবনা বিপুল। নতুন বাজার যেমন ব্রাজিল, রাশিয়া এগুলোর পেছনে যদি দৌড়াতে হয় তাহলে অর্থনৈতিক কূটনীতির দরকার আছে। এক্ষেত্রে পররাষ্ট্র, বাণিজ্য, শ্রম মন্ত্রণালয় এবং আমাদের একসঙ্গে কাজ করতে হবে সমন্বয়ের মাধ্যমে। কারণ অনেক সময় আমরা দেখি, সবাই বিচ্ছিন্নতায় ভুগছি। আমরা হয়তো একটা কথা বলছি, কিন্তু ভালোভাবে বুঝিয়ে বলতে পারছি না। এ বিষয়ে একটি কমিটি করে দিলে হয়তোবা আমাদের জন্য ভালো হবে।
অসম প্রতিযোগিতা: আমরা মজুরি ও দাম এবং দক্ষতার চ্যালেঞ্জগুলো চিহ্নিত করতে পারছি না। কারণ মজুরি বাড়ছে, দক্ষতা বাড়ছে না। দক্ষতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে অনেক রকম প্রকল্প হচ্ছে। কিন্তু দক্ষতা বাড়ছে না। দক্ষতা কেনো বাড়ছে না, তার প্রকৃত কারণ আমরা জানিও না। আবার একই সঙ্গে ক্রেতা দামও দিচ্ছে না। ক্রেতাকে যখন জিজ্ঞাসা করছি দাম দিচ্ছো না কেন? তখন খুব সুন্দর একটা জবাব দিচ্ছে, সেটা হলো তোমরা নিজেরাই তো একজন আরেকজনের বিরুদ্ধে দাম কমাচ্ছো অসম প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ে। কাজেই আমাদেরও বুঝতে হবে, আমাদের যতগুলো কারখানা আছে, অতিরিক্ত সক্ষমতা আমরা তৈরি করছি কি না! এক পর্যায়ে সবাই কিন্তু আমরা বড় হয়ে গিয়েছি, এখন বাড়তে বাড়তে এমন অবস্থায় এসেছি যে আমরা প্রডাকশন লাইনগুলোকে অপটিমাইজ করছি না। কিন্তু আমরা যেটা করছি খুব সুন্দর করে কারখানায় খালি লাইন বাড়াচ্ছি, আর অর্ডার নিয়ে নিচ্ছি যেকোনো দামে। সবাই করছেন তা বলছি না, কিন্তু বেশির ভাগই করছেন অর্ডার চলে যাওয়ার ভয়ে। ক্রেতারা বিভিন্ন সময় আমাদের ভয় দেখান বাজার পরিবর্তনের। এই মনের বাঘই আমাদের খাচ্ছে, বনের বাঘ নয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এটাই হচ্ছে।
আমাদের ফ্লোর প্রাইসটা সেট করতে হবে, যার মাধ্যমে নির্দিষ্ট মূল্যসীমার নিচে আমরা রফতানি করতে পারব না। এ কাজটি করতে হবে সরকারকে। বর্তমানে মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রেক্ষাপট হলেও কিছু করার নেই। মূল্যসীমাটি নির্ধারণ করতে হবে বেসিক বা মৌলিক পণ্যের ক্ষেত্রে। বেসিক টি-শার্ট কোনোভাবেই নির্ধারিত মূল্যসীমার নিচে রফতানি করা যাবে না, এ ধরনের সীমা বেঁধে দিতে হবে। বিশ্বের অন্যান্য দেশেও এটা সম্ভব হয়েছে। যেমন শ্রীলঙ্কায় হয়েছে, ভারতেও এক সময় এটা হয়েছে। কাজেই এটা সম্ভব। এবার সেটা করা দরকার।
চতুর্থ শিল্পবিপ্লব: তৈরি পোশাক খাতের শুরুতে নুুরুল কাদের খান অনেককেই কোরিয়ায় পাঠিয়েছিলেন। আমরা শিখে এসেছি। এখন আমরা কারো কাছ থেকে শিখতে চাই না। কিন্তু মুশকিলটা হলো লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং কিংবা অটোমোবাইলে আমাদের দক্ষতা কম। এ জায়গায় যদি বিদেশের বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে আনা হয় তাহলে আমাদের শেখার অনেক জায়গা আছে। কিন্তু এর উদ্যোগ নিতে হবে সরকারকে। উদ্যোক্তা কিংবা ব্যবসায়ীরা এটা পারব না। শুরুতে তৈরি পোশাক খাতকে এগিয়ে নেয়ার জন্য আমাদের শক্তি ছিল সস্তা শ্রম। দেশের সস্তা শ্রমবাজারের কারণে আমরা খুব সহজে তৈরি পোশাক খাতে বিনিয়োগ করতে পেরেছি। কিন্তু এখন অন্যান্য সেক্টরে যেতে হলে আমাদের শ্রমিকদের দক্ষতার উন্নয়ন ঘটাতে হবে। সব সমস্যার মধ্যে দক্ষতা একটা বড় সমস্যা। এ সমস্যা দূর করতে আমরাও যথাযথ ভূমিকা পালন করছি না। কারণ আমাদের মিড লেভেল ম্যানেজমেন্টকে আমরা ওভাবে ইকুইপড করতে পারছি না। আমাদের মিড লেভেল ম্যানেজমেন্ট অতটা দক্ষ নয়। শুধু মিড লেভেল ম্যানেজমেন্ট নয়, আমরা যদি আজকে লোক চাই, শুদ্ধ ইংরেজি তো বাদ দেন শুদ্ধ বাংলা লিখতেও পারে না। অথচ মানুষটা হয়তো মাস্টার্স ডিগ্রিধারী। অর্থাৎ যোগ্যতা ও প্রয়োজনীয়তার মধ্যে বিস্তর ফারাক। আমি তাকে কোনোভাবে ভালো চাকরিটা দিতে পারছি না। কারণ তিনি উপযুক্ত নন। আমার জন্য মিড লেভেল ম্যানেজমেন্ট গড়াটা খুব কঠিন একটা কাজ। আমার কারখানায় দক্ষ মিড লেভেল ম্যানেজমেন্ট দাঁড়াচ্ছে না। কারণ প্রয়োজনীয় দক্ষতার মানুষকে আমি খুঁজে পাচ্ছি না। আমাদের যোগ্য মানুষ লাগবে। শুধু শিক্ষাগত যোগ্যতা নয়, আমাদেরকে মিড লেভেল ম্যানেজমেন্ট নিয়ে কাউন্সেলিং করতে হবে। এখানে কিন্তু শিক্ষার প্রসঙ্গটা চলে আসে। আমরা খুব চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের কথা বলছি, কিন্তু এর সঙ্গে আমরা কতটা মানিয়ে চলতে পারব সেটাও প্রশ্ন। আমাদের কারখানায় যে শ্রমিকটি কাজ করছে, তখন কিন্তু আমরা তাকে আর চাকরি দিতে পারব না। আমাদের শ্রমিকের দক্ষতার উন্নয়ন ঘটানো জরুরি। যদিও পোশাক শিল্প খাত আগামী ১০ বছর এ রকমই চলতে থাকব। কিন্তু পরবর্তী সময়ে শুধু তৈরি পোশাক খাতের ওপর নির্ভর করে আমাদের অর্থনীতিকে ধরে রাখা সম্ভব হবে না। যখন গ্রাহকরা চাচ্ছে দক্ষ ব্যয়, স্মার্ট উৎপাদন ও দ্রুত টার্ন অ্যারাউন্ড টাইম, তখন কারখানার জন্য প্রয়োজন প্রযুক্তি এবং যন্ত্রাংশে বিনিয়োগ করতে হবে। অটোমেশন ধীরে প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে। মেশিন দ্রুত মানুষের জায়গায় নিয়ে নিচ্ছে। ২০২২ সালের মধ্যে যেসব পদে দ্রুত কর্মসংস্থান হ্রাস পাবে—এমন শীর্ষ ১০ জায়গার একটি হচ্ছে লো এন্ড ম্যানুফ্যাকচারিং, যখন কর্মঘণ্টার ৫২ শতাংশ করবে মানুষ, মেশিন করবে ৪৮ শতাংশ। বর্তমানে কর্মঘণ্টার মানুষের ভাগ ৭১ শতাংশ ও মেশিনের ২৯ শতাংশ।
চতুর্থ শিল্পবিপ্লব আমাদের সামনে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ। এখানে আমাদের উদ্ভাবনের দরকার আছে। অনেক সময় হয় কি, নতুন অনেক কিছু আমাদের হঠাৎ করে প্রডাকশন ফ্লোরে দিতে হয়, যেটি প্রেসক্রাইবড। ধরেন আমাদের স্থানীয় পর্যায়ে নির্ধারিত মানদণ্ডের একটা ইআরপি (এন্টারপ্রাইজ রিসোর্স প্ল্যানিং) সফটওয়্যার নেই এখন পর্যন্ত। সব বিদেশ থেকে আসছে। এটি কি আমরা করতে পারতাম না? আমরা বাংলাদেশে ঠিকমতো একটি ওয়াশিং মেশিনও বানাই না, এক সময় হয়তোবা বানাতাম। আসলে খুব মৌলিক জায়গাগুলোয় আমরা আটকে যাচ্ছি। কারণ কিছুতেই সেগুলো হচ্ছে না। এর অর্থ দাঁড়ায় উদ্ভাবনের একটা ঘাটতি বা অভাব আছে।
বিনিয়োগ নীতি: একটা দেশে যখন কোনো শিল্পের বিকাশ হতে থাকে তখন সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন ধরনের বিনিয়োগ নীতি ঠিক করে দেয়া হয়। আমাদের দেশে কোনো বিনিয়োগ নীতি নেই। আমরা বারবার ভিয়েতনামের কথা বলি, কারণ দেশটি অনেক তাড়াতাড়ি বৈচিত্র্যকরণ করতে সামর্থ্য হয়েছে। ওদের আরএমজি আছে তবে ওরা ইলেকট্রনিকস ও ফার্মাসিউটিক্যাল পণ্যের দিকেও ঝুঁকেছে। একটা দেশের অর্থনীতির জন্য দিকনির্দেশনা ও সুশাসন অনেক জরুরি। এ নীতিমালাগুলো সরকারি পর্যায়ের লোকরা নির্ধারণ করেন। সেখানে যদি তারা বেসরকারি খাতকে রাখেন তাহলে আমরা যারা উদ্যোক্তা আছি, অন্য সেক্টরে যেতে চাই তাদের জন্যও সুবিধা হয়। একজন উদ্যোক্তা হিসেবে আমি লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং কিংবা কৃষিতে যেতে চাই, কিন্তু সমস্যা হচ্ছে সেক্ষেত্রে এ জায়গাটায় সুতাটা গাঁথবে কে?
সেক্টর বৈচিত্র্যকরণ: এ বিষয়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ। ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের যদি বড় শিল্প খাতের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয় তাহলে আমরা লাভবান হব; এটা ব্যতীত সেক্টর বৈচিত্র্যকরণ হবে না। এদিকে আমাদের তৈরি পোশাক কারখানাগুলো আপগ্রেডেশন করা হয়েছে কিন্তু আমরা সে অনুযায়ী বায়ারদের কাছ থেকে পণ্যের দামটা পাচ্ছি না, গ্রিন ফ্যাক্টরি, গ্রিন প্রডাক্ট আছে কিন্তু দামটা গ্রিন পাচ্ছি না। এখন সময় আসছে ব্র্যান্ডিংয়ের। আমরা আমাদের ভালো কাজের স্বীকৃতি না পাওয়ার জন্য নিজেরাই দায়ী। নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা করে আমরা অস্বাস্থ্যকর একটি জায়গায় এসে পৌঁছেছি। আমাদের খুব দ্রুত সেক্টর বৈচিত্র্যকরণের দিকে ঝুঁকতে হবে। এ লক্ষ্যে সর্বাগ্রে শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ করতে হবে। ১৯৯৫ সালের দিকে চীনে আমি প্রচুর নারী উদ্যোক্তা দেখেছি। কারণ চীন সরকার একসময় নারী উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করতে নারী শিক্ষার প্রতি অনেক বেশি গুরুত্ব দিয়েছিল। একেক সময় সরকারের একেকটা নীতি পুরো অর্থনীতিকে ঘুরিয়ে দেয় ও ঠিক জায়গায় নিয়ে আসে। সারা জীবনের জন্য কোনো সরকারই ক্ষমতায় থাকবে না, কিন্তু ধারাবাহিকতাকে ধরে রাখতে হলে এরপর যিনি আসবেন তাকে তা ধরে রাখতে হবে। ভিয়েতনামে যেমনটা হয়েছে। ওরা ধারবাহিকভাবে গত ২০ বছর ধরে নিজেদের অর্থনৈতিক নীতিগুলোকে এক রেখেছে। আগামী ৫০ বছরে আমাদের শুধু আরএমজি খাতের ওপর নির্ভর করা উচিত হবে না। তাছাড়া আমার শুধু ন্যায্য মজুরির কথা বলি, একই সঙ্গে আমাদের ন্যায্য দামের বিষয়টিতেও জোর দিতে হবে। তেমনি সবুজ কারখানার ক্ষেত্রে সবুজ দাম নিশ্চিত করতে হবে। ব্র্যান্ডিয়ে বাংলাদেশকে অনেক বেশি সচেতন হতে হবে। গত ৫০ বছরের কিছু জিনিস কখনই রিপিটেড হওয়া উচিত নয়, তা হচ্ছে রানা প্লাজা বা তাজরীনের মতো ট্র্যাজেডি। কারণ অবকাঠামোগতভাবে আমাদের কারখানাগুলো অনেক বেশি এগিয়ে গেছে। তবে শুধু কাঠামোগত বিষয়গুলো দিয়ে কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত হয় না, এর বাইরে শ্রমিক অধিকার, পরিবেশের বিষয় রয়েছে। কারখানার অবকাঠামোর পাশাপাশি শ্রমিকের অধিকার ও পরিবেশের বিষয়গুলোতে গুরুত্ব দিতে হবে। এ তিনটি বিষয়কে যদি আমরা একসঙ্গে সমন্বয় করে না অগ্রসর হতে পারি, তাহলে ব্যবসা টিকবে না। বায়ার বলল আর কমপ্লায়ান্সের বক্স টিক করলাম—শুধু তা দিয়ে আর ব্যবসা হবে না। আমাদের যে জায়গায় অটুট থাকতে হবে তা হচ্ছে, আমরা কোনোমতেই কম দামের কাছে বিক্রি হব না। আর একটা বিষয়, তৈরি পোশাকের একই ধরনের সম্প্রসারণের প্রয়োজন নেই বরং মূল্য সংযোজন করতে হবে। আমরা এখন যে অবস্থায় রয়েছি তাকে ধরে রেখে পণ্য ও সেক্টর বৈচিত্র্যকরণ করতে হবে।
ড. রুবানা হক: ব্যবস্থাপনা পরিচালক, মোহাম্মদী গ্রুপ