অতিমারি করোনায় সারা বিশ্বে মানুষের জীবনযাত্রায় পরিবর্তন এসেছে। করোনার প্রাদুর্ভাব শুরুর পর থেকেই লকডাউন, জরুরি অবস্থা কিংবা নানা বিধিনিষেধের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন দেশ। কাজের ক্ষেত্রেও এসেছে নতুন বাস্তবতা। কর্মস্থলে যেতে না পারা কর্মীরা ঘরে বসেই অনলাইনে কাজ করছেন। সামাজিক অনুষ্ঠানও বন্ধ। এর ফলে অনেক দেশেই ঘরোয়া পরিবেশে ব্যবহার উপযোগী পোশাকের চাহিদা বেড়েছে। অন্যদিকে কমেছে ফরমাল এবং ফ্যাশন পোশাকের চাহিদা।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য মতে, গত অর্থবছরে এক হাজার ৬৯৬ কোটি ডলারের নিট পোশাক রপ্তানি হয়েছে। এ সময় ওভেন পোশাকের রপ্তানির পরিমাণ ছিল এক হাজার ৪৪৮ কোটি ডলার। আগের বছরের বৃদ্ধির তুলনায় নিট পোশাকের রপ্তানি বেড়েছে ২২ শতাংশ। ওভেনে বেড়েছে ৩ শতাংশ।
বিভিন্ন দেশে করোনা শুরুর আগের অর্থবছরে রপ্তানির এই চিত্র একেবারেই ভিন্ন ছিল। অর্থাৎ নিটের তুলনায় ওভেনের রপ্তানি বেশি ছিল। গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে নিট পোশাকে রপ্তানির পরিমাণ ছিল এক হাজার ৩৯০ কোটি ডলার। ওই অর্থবছরে ওভেনে এর পরিমাণ ছিল এক হাজার ৪০৪ কোটি ডলার। ২০১৮-১৯ অর্থবছর নিটের রপ্তানি ছিল এক হাজার ৬৮৯ কোটি ডলার। ওই অর্থবছরে ওভেনের রপ্তানির পরিমাণ এক হাজার ৭২৪ কোটি ডলার। আগের ১০ বছরের তথ্য ঘেঁটেও একই প্রবণতা দেখা গেছে। অর্থাৎ নিটের তুলনায় ওভেন পোশাকই বেশি রপ্তানি করে আসছিল বাংলাদেশ।
ওভেনের তুলনায় নিটের বেশি চাহিদার প্রবণতা চলতি অর্থবছরে প্রথম দুই মাসেও অব্যাহত আছে। গত জুলাই ও আগস্ট মাসে নিট পোশাকের রপ্তানি আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় বেড়েছে ৫ শতাংশ। অন্যদিকে ওভেনে কমেছে ৮ শতাংশ।
ঘরোয়া পরিবেশে সাধারণত টি-শার্ট, পলো শার্ট, স্যান্ডো গেঞ্জি, ট্রাউজার জাতীয় পোশাক বেশি ব্যবহার হয়ে থাকে। দামে কম এবং আরামদায়ক- এ ধরনের পোশাকের জনপ্রিয়তা আছে। পোশাকশিল্পের ভাষায় এ ধরনের পোশাককে নিট ক্যাটাগরির পণ্য হিসেবে ধরা হয়। অন্যদিকে শার্ট, প্যান্ট, স্যুট-ব্লেজার, ফরমাল শার্ট, প্যান্ট জাতীয় ফরমাল পোশাক হচ্ছে ওভেন ক্যাটাগরির পণ্য।
জানতে চাইলে বিকেএমইএর প্রথম সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম সমকালকে বলেন, করোনার কারণে বিভিন্ন দেশে শারীরিক উপস্থিতির আনুষ্ঠানিকতা একেবারেই কম। অফিস-আদালতও চলছে অনলাইনে। জরুরি কাজ ছাড়া ঘর থেকে বের হওয়ার প্রয়োজন পড়ছে না অনেকের। এ কারণে ফরমাল পোশাকের চাহিদা কমে এসেছে। এ ছাড়া করোনার প্রভাবে মানুষের আয় কমে গেছে। তাই যেসব ওভেন পোশাকের দাম বেশি, সেগুলো কেনার মতো আর্থিক অবস্থাও নেই অনেকের। অন্যদিকে ওভেনের তুলনায় নিট পোশাকের দাম কম। সব মিলিয়ে, ঘরে ব্যবহার্য আরামদায়ক ইনফরমাল নিট পোশাকের চাহিদাই বেশি।
সাধারণত, নিট পোশাক তৈরির প্রধান কাঁচামাল তুলা। নিট পোশাকের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় তুলার চাহিদা বেড়েছে ২২ শতাংশ। ইন্টারন্যাশনাল কটন অ্যাসোসিয়শনের তথ্য বলছে, অতিমারি করোনায় জীবনযাত্রার পরিবর্তনের ফলে তুলায় তৈরি পোশাকের ব্যবহার বেড়েছে। তবে বৈরী আবহাওয়ায় এ বছর তুলার উৎপাদন কম হয়েছে ৩০ শতাংশ। এ দুই কারণে বিশ্ববাজারে তুলার বাজারে অস্থিরতা চলছে। দাম বেড়েছে দ্বিগুণের কাছাকাছি। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত এক কেজি তুলার দর ছিল ১ ডলার ৬৫ সেন্ট। চলতি আগস্ট মাসে একই পরিমাণ তুলার দর ২ ডলার ৪৩ সেন্ট। তুলার আন্তর্জাতিক বাজারের এ অস্থিরতায় দেশেও তুলা নিয়ে তুলকালাম চলছে। তুলা থেকে সুতা এবং কাপড় উৎপাদনকারী উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ) এবং তৈরি পোশাক উৎপাদন ও রপ্তানিকারক উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিজিএমইএ’র মধ্যে দ্বন্দ্বের বিষয়টি প্রকাশ পেয়েছে।
পরিবর্তিত চাহিদার সুযোগ কাজে লাগাতে বেশ কিছু ওভেন পোশাক উৎপাদনের কারখানা নিট পোশাক কারখানায় রূপান্তর করা হয়েছে। গত বছরের জুলাই মাসে ওভেন থেকে নিটে রূপান্তরিত হয়েছে রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকার ইতাল অ্যাডওয়েজ কারখানা। প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সারওয়ার আহম্মেদ সমকালকে জানান, করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পর থেকেই ওভেনের রপ্তানি আদেশ খুব কম আসছিল। অথচ নিট পণ্যে রপ্তানি আদেশের কোনো অভাব নেই। পরিস্থিতি বুঝে ওভেন থেকে নিটে রূপান্তর ঘটান তারা।