Home বাংলা নিউজ ১৭১টি নতুন পোশাক কারখানা চালু

১৭১টি নতুন পোশাক কারখানা চালু

গাজীপুরের গাজীপুরা এলাকার সাতাইশে চলতি বছরের জানুয়ারিতে মাম’স টাচ সোয়েটার গার্ডেন নামের সোয়েটার কারখানা চালু করেন তাজুল ইসলাম। বর্তমানে প্রায় ১৫০ জন শ্রমিক কারখানাটিতে কাজ করছেন। কোনো মাসে ৫ হাজার, কোনো মাসে ২০ হাজার সোয়েটারও রপ্তানি হয়। বিদেশি ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে সরাসরি ক্রয়াদেশ না পেয়ে সাবকন্ট্রাক্টিং বা ঠিকায় কাজ করছে কারখানাটি। বায়িং হাউস থেকেও কিছু ক্রয়াদেশ পাচ্ছে।

ভাড়া জমি ও ভবনে কারখানাটি শুরু করতে প্রাথমিকভাবে প্রায় এক কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন তাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘করোনার আগেই পোশাক কারখানা করার পরিকল্পনা করেছিলাম। জমির মালিককে ভবন নির্মাণের জন্য টাকাও দেওয়া হয়েছিল। সে কারণে মহামারির মাঝেই কারখানা চালু করতে হয়েছে। পেছনে ফেরার কোনো সুযোগ ছিল না।’বিজ্ঞাপন

মহামারি করোনাভাইরাসের প্রথম ঢেউয়ে গত বছর একের পর এক ক্রয়াদেশ বাতিল ও স্থগিত হওয়ায় পোশাক রপ্তানির ব্যবসা বড় ধরনের হুমকির মধ্যে পড়ে যায়। বছরের শেষ দিকে ব্যবসা আবার ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে। এই উত্থান-পতনের মধ্যেও তাজুল ইসলামের মতো অনেক বিনিয়োগকারী রপ্তানিমুখী পোশাকের ব্যবসায় নতুন করে যুক্ত হয়েছেন। তাতে করোনাকালে কমপক্ষে ১৭১টি নতুন পোশাক কারখানা উৎপাদনে এসেছে।

তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর তথ্যানুযায়ী, গত বছরের জুন থেকে গত মাস পর্যন্ত ৯৬টি নতুন কারখানা তাদের সদস্যপদ নিয়েছে। বর্তমানে সব কটিই উৎপাদনে রয়েছে। অন্যদিকে নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ জানায়, গত বছর ৩৩টি কারখানা সদস্যপদ নিয়েছে। তার মধ্যে ঢাকায় ১৯, নারায়ণগঞ্জে ১০ ও চট্টগ্রামের ৪টি কারখানা। আর চলতি বছর ৪২টি নতুন কারখানা সদস্যপদ নিয়েছে। তার মধ্যে নারায়ণগঞ্জে ১৭টি, ঢাকা ও চট্টগ্রামের ১৩টি করে কারখানা রয়েছে।

নতুন এসব প্রতিষ্ঠানের কারণে রপ্তানিমুখী পোশাকশিল্পে সচল কারখানার সংখ্যা কত হলো, তার কোনো সঠিক হিসাব নেই। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোক্তা উন্নয়ন কেন্দ্রের (সিইডি) ম্যাপড ইন বাংলাদেশের তথ্যানুযায়ী, দেশে ৩ হাজার ৪০৯টি পোশাক কারখানা রয়েছে। এর মধ্যে বিজিএমইএর সদস্য ১ হাজার ৯৪৫ ও বিকেএমইএর সদস্য ৫২১টি। তার বাইরে বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ উভয় সংগঠনের সদস্য ২৫৪টি। কোনো সংগঠনের সদস্য নয়, এমন কারখানার সংখ্যা ৬৮৯।

জানতে চাইলে বিজিএমইএর সহসভাপতি শহিদুল্লাহ আজিম সম্প্রতি প্রথম আলোকে বলেন, করোনার মধ্যে পুরোনো অনেক পোশাক কারখানা বন্ধ হয়েছে। আবার নতুন কারখানাও চালু হয়েছে। তবে এই কঠিন সময়ে নতুন বিনিয়োগ আসাটা ইতিবাচক। তাতে সামগ্রিকভাবে পোশাকশিল্পের উৎপাদন সক্ষমতা বেড়েছে। তিনি আরও বলেন, নতুন আসা কারখানার মধ্যে অধিকাংশই ক্ষুদ্র ও মাঝারি। ভবিষ্যতে এই কারখানাগুলোর মধ্যেই কিছু বড় হবে।

পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা জানান, বিপুলসংখ্যক মানুষকে করোনার টিকা দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) দেশগুলো স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরেছে। সেসব দেশের ক্রেতা প্রতিষ্ঠান আগামী গ্রীষ্ম ও বসন্ত মৌসুমের জন্য করোনার আগের মতো ক্রয়াদেশ দিচ্ছে। তা ছাড়া মিয়ানমার, ভিয়েতনাম ও চীন থেকে বাংলাদেশে ক্রয়াদেশ স্থানান্তরিত হয়ে আসছে। সব মিলিয়ে ২০১৯ সালের তুলনায় চলতি বছর ১৫-২০ শতাংশ ক্রয়াদেশ বেশি এসেছে।

সাভারে গত মার্চে এনআর ক্রিয়েশন নামে নিট পোশাক কারখানা চালু করেন আলকাছ মিয়া। বর্তমানে কারখানাটিতে ৫৫০ জন শ্রমিক কাজ করেন। শুরু থেকেই সরাসরি ক্রেতার কাজ করছে কারখানাটি। বর্তমানে তারা ইউরোপের চারটি ক্রেতার কাজ করছে।

গত ১২ বছর একটি পোশাক কারখানায় কাজ করার পর অংশীদারি ভিত্তিতে একটি কারখানা করেছিলেন আলকাছ মিয়া। সেভাবেই আট-নয় বছর ব্যবসা করেন। তারপর নিজেই ছয় কোটি টাকা বিনিয়োগ করে এনআর ক্রিয়েশনস নামের নতুন কারখানা করেছেন। এমন তথ্য দিয়ে আলকাছ মিয়া বলেন, ‘করোনার মধ্যেই শুরু করেছি। বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মধ্যে আছি। মাসে এক কোটি টাকা বেতন দিতে হচ্ছে। তবে আশা করছি, আগামী বছর থেকে ভালো ক্রয়াদেশ পাব।’

নতুন কারখানা স্থাপনের পাশাপাশি ব্যবসাও সম্প্রসারণ করছে অনেক প্রতিষ্ঠান। ঊর্মি গ্রুপের একটি পোশাক কারখানা তেজগাঁও থেকে স্টাফ কোয়ার্টার এলাকার ছয় বিঘা জমিতে বড় পরিসরে স্থানান্তরের প্রক্রিয়া চলছে। ইতিমধ্যে কারখানার নির্মাণকাজ শেষের দিকে রয়েছে। সেখানে আগামী বছরের প্রথম দিকে কারখানাটির উৎপাদন চালু হবে।

ঊর্মি গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আসিফ আশরাফ সম্প্রতি প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমানে তেজগাঁওয়ের কারখানায় ১ হাজার ৩০০ শ্রমিক কাজ করেন। নতুন কারখানা ভবনে সেটি স্থানান্তরিত হওয়ার পর উৎপাদন সক্ষমতা বাড়বে। তাতে অতিরিক্ত এক হাজার শ্রমিক যুক্ত হবেন।

ইতিমধ্যে করোনার ধাক্কা কাটিয়ে পোশাক রপ্তানি ঘুরে দাঁড়িয়েছে। গত জুনে শেষ হওয়া অর্থবছরে ৩ হাজার ১৪৫ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে, যা আগের বছরের চেয়ে সাড়ে ১২ শতাংশ বেশি। চলতি অর্থবছরের প্রথম মাসে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ভালো না হলেও পরের দুই মাসে পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। গত মাসে ৩৪২ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৪২ শতাংশ বেশি। এটিই পোশাক খাতের ইতিহাসে এক মাসে সর্বোচ্চ রপ্তানি। সব মিলিয়ে চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে রপ্তানি হয়েছে ৯০৫ কোটি ডলারের পোশাক। এই আয় গত বছরের একই সময়ের চেয়ে সাড়ে ১১ শতাংশ বেশি।

বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘নতুন কারখানায় উৎপাদনে আসায় সামগ্রিকভাবে আমাদের উৎপাদন সক্ষমতা বেড়েছে। বর্তমান ক্রয়াদেশ বেশি থাকায় ব্যবসায় প্রবেশ করা তুলনামূলক সহজ। তবে এই জগতের বাইরের কেউ যদি কারখানা করেন, তাহলে তাঁর জন্য সরাসরি ক্রয়াদেশ পাওয়া কঠিন।’

পোশাকের পাশাপাশি বস্ত্র খাতেও নতুন বিনিয়োগ হচ্ছে। বস্ত্রকলমালিকদের সংগঠন জানিয়েছে, ২০২৩ সালের মধ্যে খাতটিতে বিনিয়োগ ২৫০ কোটি মার্কিন ডলার বা ২১ হাজার ২৫০ কোটি টাকা হবে। গত নভেম্বর থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১১ মাসে ১০টি নতুন বস্ত্রকল সংগঠনটির সদস্যপদ নেওয়ার জন্য আবেদন করেছে। তার মধ্যে রয়েছে সুতা ও কাপড় উৎপাদনকারী কারখানা। কারখানাগুলো আগামী দুই বছরে উৎপাদনে আসবে। এসব কারখানায় বিনিয়োগ হচ্ছে ৪ হাজার ৬০ কোটি টাকা।

জানতে চাইলে বিকেএমইএর সাবেক সভাপতি ফজলুল হক সম্প্রতি বলেন, পোশাক রপ্তানির ব্যবসায় কোটি কোটি টাকা আছে, সহজে ব্যবসায় ঢোকা যায়। এমন ধারণা থেকে অনেকে পোশাকশিল্পে বিনিয়োগ করেন। প্রতিবছরই খাতটিতে নতুন কারখানা আসে, আবার কিছু কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। অনেক বছর ধরেই এটি চলমান প্রক্রিয়া। তিনি আরও বলেন, ‘করোনাকালে যেসব কারখানা উৎপাদনে আসছে, সেগুলো মহামারির আগেই পরিকল্পনা করেছিল। তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে নতুন বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত কিছুটা শ্লথ হবে। তাতে আগামী এক-দুই বছর নতুন কারখানা কম আসবে। তবে সার্বিকভাবে রপ্তানি বাড়াতে হলে সক্ষমতা বাড়াতে হবে। সে জন্য আমাদের নতুন কারখানা লাগবে।’

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here