ভোক্তা বাজার হিসেবে বিদেশি ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে আকর্ষণ বাড়ছে বাংলাদেশের। উচ্চ মূল্যের বিশ্বমানের পণ্য ক্রয়ে মানুষের সংখ্যা এখন নেহাত কম নয়। এই সুবাদে তৈরি পোশাক এবং পাদুকাশিল্পের বিশ্ববিখ্যাত ব্র্যান্ডগুলো নিজস্ব শোরুম খুলেছে ঢাকায়। আরও বেশ কয়েকটি ব্র্যান্ড ঢাকায় শোরুম খোলার পরিকল্পনা নিয়েছে। বিস্তারিত জানাচ্ছেন আবু হেনা মুহিব
দেশে অতিমারি করোনার অস্তিত্ব জানা যায় গত বছরের ৮ মার্চ। এরপর একের পর নেওয়া হয় নানা রকম সতর্কতামূলক পদক্ষেপ। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড অনেকটাই স্থবির হয়ে পড়ে। তবে করোনার কবলে পড়ার আগে দারুণ ছন্দে এগোচ্ছিল দেশের অর্থনীতি। টানা প্রায় এক দশক মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) বছরপ্রতি গড় প্রবৃদ্ধি ছিল সাড়ে ৬ শতাংশের ওপরে। করোনার আগে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এ হার ৮ দশমিক ১৫ শতাংশে পৌঁছায়।
প্রবৃদ্ধির নিরবচ্ছিন্ন এই গতির সুবাদে দেশের অর্থনীতির অন্তর্নিহিত শক্তির বিষয়টি উঠে আসে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পরিসংখ্যান, মাথাপিছু আয় ও ভোগক্ষমতা বৃদ্ধি বিশ্ববাণিজ্যে বাংলাদেশকে কিছুটা আকর্ষণীয় করে তোলে। ১৮ কোটি মানুষের বাংলাদেশকে সম্ভাবনাময় ভোক্তাবাজার হিসেবে আমলে নেয় পোশাকসহ বিভিন্ন পণ্যের বিশ্ববিখ্যাত ব্র্যান্ডগুলো। তৈরি পোশাকের দ্বিতীয় প্রধান রপ্তানিকারক বাংলাদেশের ভোক্তাদের টার্গেট করে বিনিয়োগও শুরু করেছে নামকরা কয়েকটি ব্র্যান্ড। নিজস্ব শোরুম খুলেছে অনেক প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে আছে যুক্তরাষ্ট্রের নাইকি, জার্মানির অ্যাডিডাস ও পুমা, জাপানের গ্রামীণ ইউনিক্লো, ইতালির লোটো, লন্ডনের লি কুপার ইত্যাদি। রাজধানীর অভিজাত এলাকা এবং বড় শপিংমলগুলোতে শোভা পাচ্ছে ব্র্যান্ডগুলোর দৃষ্টিনন্দন শোরুম। আরও বেশ কয়েকটি ব্র্যান্ড ঢাকায় শোরুম খোলার পরিকল্পনা নিয়েছে। শিগগিরই হয়তো ভোক্তারা আরও নতুন ব্র্যান্ডের পণ্য পাবেন।
দেশে পোশাকের বাজার এখন ২০ হাজার কোটি টাকা। প্রতিবছর ১৫ শতাংশ হারে বাড়ছে এই বাজার। সে তুলনায় বিদেশি ব্র্যান্ডের উপস্থিতি এখনও যথেষ্ট কম। তবে এ দেশে বিদেশি ব্র্যান্ডগুলোর ব্যবসা সম্প্রসারণ হলে দেশ লাভবান হবে বলে মনে করেন বিশ্নেষক ও উদ্যোক্তারা। তাদের মতে, এতে বিদেশি বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়বে। পর্যটনে বাড়তি আকর্ষণ যোগ হবে। দেশীয় পোশাক খাতও উপকৃত হবে। বিদেশি ব্র্যান্ডগুলো স্থানীয়ভাবে উৎপাদন ও বাজারজাত করলে অনেক কম দামে বিশ্বমানের পণ্য পাবেন স্থানীয় ভোক্তারা।
বাংলাদেশে বাজার বড় করছে বিদেশি ব্র্যান্ডগুলো: ঢাকায় বিদেশি বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ব্যবসা বেশ ভালোই চলছে। তাদের ব্যবসা সম্প্রসারণ দেখেই সেটি বোঝা যায়। প্রায় সব ব্র্যান্ডই অতি অল্প সময়ে শোরুমের সংখ্যা কয়েক গুণ বাড়িয়েছে। পণ্যের তালিকাও বড় হচ্ছে। ঢাকায় বিদেশি ব্র্যান্ডের প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রত্যাশার চেয়েও বেশি সাড়া পাচ্ছেন তারা। কয়েকটি ব্র্যান্ডের পণ্যের দাম বেশ চড়া। তারপরও ক্রেতাদের সাড়া বাড়ছেই। যেমন- অ্যাডিডাসের খুব সাধারণ একটি গেঞ্জির দাম ছয় হাজার টাকা। অথচ বাংলাদেশ থেকে এক-দেড় ডলার, অর্থাৎ মাত্র ১০০ টাকার মধ্যে গেঞ্জি রপ্তানি হয়। প্রায় সব ব্র্যান্ডের লক্ষ্যই হচ্ছে উচ্চবিত্ত ভোক্তা। যাদের কাছে বেশি দামের ব্যাপারটা যেন ‘ব্যাপারই না’। ঢাকায় বসে বিশ্ববিখ্যাত ব্র্যান্ডের পোশাক পাওয়া যাচ্ছে, সেটাই বড় কথা। ব্র্যান্ডেড আইটেম হওয়ায় ম্যানহাটন, মিলান কিংবা মন্ট্রিল থেকে কেনা আর ঢাকায় কেনার মধ্যে কোনো তফাৎ নেই। সর্বত্র একই মান। অবাক করার বিষয়, ঢাকায় শোরুমগুলোতে আসা কোনো কোনো পণ্যের গায়ে ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ ট্যাগ পাওয়া যাচ্ছে। তবে বাংলাদেশ থেকে উৎপাদিত পোশাক সরাসরি ঢাকার শোরুমে আসে না। সে সুযোগও নেই। বাংলাদেশে বিদেশি ব্র্র্যান্ডের পোশাক উৎপাদনের পর ব্র্যান্ডগুলোর কেন্দ্রীয় কিংবা আঞ্চলিক ওয়্যারহাউসে চলে যায়। সেখান থেকে বিপণন নেটওয়ার্কের মাধ্যমে বাজারজাত করা হয়। এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম শুধু জাপানের ব্র্যান্ড গ্রামীণ ইউনিক্লো এবং ইতালির লোটো। এই ব্র্যান্ড দুটোর বাংলাদেশে উৎপাদিত পোশাকই স্থানীয় ভোক্তাদের হাতে পৌঁছানো হয়।
দেশের বাজারে নাইকি ও অ্যাডিডাস: খেলাধুলার সামগ্রী প্রস্তুতকারক বিশ্বের নামকরা দুই ব্র্যান্ড যুক্তরাষ্ট্রের নাইকি ও জার্মানির অ্যাডিডাস। বাটা শু কোম্পানির মাধ্যমে বাংলাদেশে নাইকি ও অ্যাডিডাসের জুতা, জার্সি, জ্যাকেটসহ খেলাধুলার বিভিন্ন সামগ্রী বাজারজাত করা হচ্ছে। গত চার বছর বাটার বড় শোরুমগুলোতে শোভা পাচ্ছে নাইকি-অ্যাডিডাসের পণ্য। বাটার সঙ্গে ব্র্যান্ড দুটির চুক্তি আছে সেভাবেই।
জানতে চাইলে বাটার একজন প্রতিনিধি সমকালকে জানান, নাইকি-অ্যাডিডাসের সামগ্রীর দাম একই মানের অন্য পণ্যের তুলনায় বেশি। সব শ্রেণির মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকে না এসব সামগ্রী। গুণমান এবং ব্র্যান্ডের সুনাম- এসব কারণেই নাইকি-অ্যাডিডাসের পণ্যের দাম বেশি হয়ে থাকে। ঢাকার বাটায় এক জোড়া নাইকির জুতার দাম পড়ে ১৮ হাজার টাকা। অ্যাডিডাসের সাধারণ একটা জার্সির দাম সাত হাজার টাকা। করোনার সময়েও নাইকি, অ্যাডিডাসের বেচাবিক্রি বেড়েছে বলে জানান তিনি।
ব্র্যান্ডের নামেও ভেজাল: রাজধানীর কিছু অভিজাত শপিংমলে বিশ্ববিখ্যাত অনেক ব্র্যান্ডের নামে প্রতারণার অভিযোগও পাওয়া যায়। কয়েকটি শপিং সেন্টারে যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত ব্র্যান্ড জেসিপেনির নামে শোরুম দেখতে পাওয়া যায়। তাদের বিক্রিও ভালো। আছে দামি ব্লেজার, স্যুট-কোট। দামও জেসিপেনির পোশাকের মতো বেশি। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, মূল ব্র্যান্ডের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই এই জেসিপেনির। অথচ হুবহু একই নাম। সম্প্রতি সমকালের সঙ্গে আলাপকালে জেসিপেনির সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক না থাকার কথা স্বীকারও করেন এসব প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা। তাদের যুক্তি, দেশের আইন অনুযায়ী এ রকম নাম ব্যবহার করতে কোনো বাধা নেই। তবে জেসিপেনির বাংলাদেশ অফিস কিছুদিন আগে বিষয়টি নিয়ে ওই শোরুমটিতে গিয়ে তাদের আপত্তির কথা জানিয়েছে।
স্পেনের বিখ্যাত জারা ব্র্যান্ডের নামও এভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। মূল ব্র্যান্ডের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই, অথচ হুবহু একই নাম ও লোগো ব্যবহার করা হচ্ছে। জারা ফ্যাশন, জারা ম্যান, জারা ব্র্যাইডাল- জারার লোগো ব্যবহার করে এ রকম অনেক শোরুম খোলা হয়েছে। অথচ স্প্যানিশ জারার সঙ্গে এদের কোনো সম্পর্ক নেই। আদপে জারার কোনো শোরুমই নেই বাংলাদেশে। এ রকম কেলভিন ক্লিন, গ্যাপ, এইচঅ্যান্ডএমসহ আরও কিছু বিশ্ববিখ্যাত ব্র্যান্ডের নকল শোরুম আছে ঢাকার বিভিন্ন স্থানে।
শুল্ক সমস্যার সমাধান চায় ব্র্যান্ডগুলো :পোশাক ও স্পোর্টস ওয়্যারের বিশ্ববিখ্যাত ব্র্যান্ডগুলো বাংলাদেশের বাজারে প্রবেশের ক্ষেত্রে শুল্ক্ক সমস্যাকে বড় বাধা হিসেবে দেখছে। ব্র্যান্ডগুলোর প্রতিনিধিরা বলেন, তাদের কোনো কোনো পণ্যে ১৩০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক্কারোপ রয়েছে। এত বেশি শুল্ক্ক দিয়ে প্রতিযোগিতামূলক দর ধরা মুশকিল। অনেক ক্ষেত্রে বাংলাদেশে উৎপাদিত পোশাক ভারতে কিংবা ইউরোপে রপ্তানি করা হয়। সেই পণ্য আবার বাংলাদেশে আমদানি করা হয়। এ প্রক্রিয়ায় সময় ও ব্যয় বেড়ে যায়। ভারতে বিদেশি ব্র্যান্ডগুলোকে ৫০ শতাংশ পণ্য স্থানীয় উৎপাদন থেকে সংগ্রহ করার সুযোগ দেওয়া হয়। সম্প্রতি এ বিষয়ে বিজিএমইএর কাছে চিঠি দিয়ে সহযোগিতা চেয়েছে ব্র্যান্ডগুলো।
চিঠিতে বলা হয়, প্রতিযোগিতামূলক মূল্যে গুণগত মানের পোশাক পণ্য সরবরাহে অনেক ব্র্যান্ডের কৌশল থাকে। কিন্তু শুল্ক্ক ও প্রক্রিয়ায় দর বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশে ব্যবসা পরিচালনা বাধা হয়ে দাঁড়ায়। ক্রেতাদের চিঠি পেয়ে বিদেশি ব্র্যান্ডগুলো বাংলাদেশে উৎপাদিত পোশাক যাতে বিনা শুল্ক্কে বাজারজাত করতে পারে, সে ব্যাপারে নির্দেশনা চেয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাছে চিঠি দিয়েছে বিজিএমইএ। চিঠিতে বলা হয়, এ সুযোগ দেওয়া হলে দেশে বিদেশি বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়বে। স্থানীয় পণ্যের চাহিদা এবং উৎপাদনও বাড়বে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বাংলাদেশ গার্মেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সহসভাপতি শহিদুল্লাহ আজিম সমকালকে বলেন, বিদেশি ব্র্যান্ডগুলো দেশে শোরুম খুলে ব্যবসা করলে স্থানীয় ভোক্তা ও পোশাক খাত উভয়েই উপকৃত হবে। পণ্য উৎপাদনের পর শুধু রপ্তানি প্রক্রিয়ায় উৎপাদন ব্যয়ের দ্বিগুণের বেশি ব্যয় হয়। বিদেশি ব্র্যান্ডগুলো স্থানীয়ভাবে উৎপাদন ও বাজারজাত করলে অর্ধেক দামে বিশ্বমানের পণ্য পাবেন স্থানীয় ভোক্তারা। তাই শুল্ক্ক কমানোর প্রস্তাব দিয়ে বিজিএমইএর পক্ষ থেকে এনবিআরকে চিঠি দেওয়া হয়েছে।