ইইউ কমিশনের নতুন নীতিমালার খসড়া অনুযায়ী প্রাথমিক শর্তেই আটকে যাবে বাংলাদেশ।
- ইইউতে ২০২৬ সাল পর্যন্ত জিএসপি সুবিধা পাবে বাংলাদেশ।
- তারপর আরও তিন বছর জিএসপি সুবিধা বহাল থাকবে।
বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানি, বিশেষ করে তৈরি পোশাকের সবচেয়ে বড় বাজার ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ)। বাজারটিতে স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) হিসেবে ইবিএর (অস্ত্র ছাড়া বাকি সব পণ্য) অধীনে অগ্রাধিকারমূলক বাজার সুবিধা বা জিএসপি পায় বাংলাদেশ। সবকিছু ঠিক থাকলে ২০২৬ সালে এলডিসির তালিকা থেকে বেরিয়ে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ হবে। তারপর আরও তিন বছর ইইউর বাজারে জিএসপি বজায় থাকবে। তাতে ২০২৯ সাল পর্যন্ত বাজারটিতে পণ্য রপ্তানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাওয়া নিয়ে সমস্যা হবে না।
তারপর শুল্কমুক্ত সুবিধা অব্যাহত রাখতে বাংলাদেশকে জিএসপি প্লাসের জন্য যোগ্যতা অর্জন করতে হবে। তবে ২০২৪-৩৪ সালের জন্য জিএসপির নতুন নীতিমালার খসড়া চূড়ান্ত করেছে ইউরোপীয় কমিশন। আগামী বছরের তৃতীয় প্রান্তিকে সেটি অনুমোদিত হওয়ার কথা রয়েছে। শেষ পর্যন্ত খসড়াটি ইইউ পার্লামেন্টে অনুমোদিত হলে বাংলাদেশের জিএসপি প্লাস পাওয়ার বিষয়টি একরকম অসাধ্যই হয়ে যাবে। কারণ, প্রাথমিক শর্তেই আটকে যাবে বাংলাদেশ। তখন প্রায় ১২ শতাংশ শুল্ক দিয়ে ইইউতে পোশাক রপ্তানি করতে হবে।
‘জিএসপির নতুন নীতিমালার খসড়া অনুমোদিত হলে আমাদের জিএসপি প্লাস পাওয়া কঠিন হবে। সে জন্য ঢাকায় ইইউ রাষ্ট্রদূতের কাছে গত সপ্তাহে আমরা আমাদের উদ্বেগ জানিয়েছি। জেনেভায় আসন্ন ডব্লিউটিওর মন্ত্রিপর্যায়ের বৈঠকেও আমরা আমাদের বক্তব্য ইইউর প্রতিনিধিদের জানাতে চেষ্টা করব। নীতিমালার খসড়াটি আমরা এখনো পর্যালোচনা করছি। সেটি শেষ হলে আনুষ্ঠানিকভাবে ইইউ কমিশনকে সরকারিভাবে আপত্তি জানানো হবে।’
এত দিন জিএসপি প্লাস পাওয়ার জন্য জিএসপি নীতিমালার একটি শর্তকে গলার কাঁটা মনে করা হচ্ছিল। সেটি হচ্ছে, জিএসপি সুবিধার আওতায় এলডিসিভুক্ত দেশগুলো ইইউতে যে পরিমাণ রপ্তানি করে, তার সাড়ে ৬ শতাংশের বেশি একক কোনো দেশ করলে সেই দেশ জিএসপি প্লাসের জন্য যোগ্য হবে না। বাংলাদেশের হিস্যা বর্তমানে ২০ শতাংশের কাছাকাছি। তবে ২০২৪ থেকে ২০৩৪ সালের জন্য জিএসপির নতুন নীতিমালার খসড়ায় এই শর্ত তুলে দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের জন্য সেটি সুসংবাদ হলেও সমস্যা হয়েছে অন্য জায়গায়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জিএসপির খসড়া নীতিমালায় বস্ত্র ও পোশাক খাতকে স্পর্শকাতর পণ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আর স্পর্শকাতর তালিকার পণ্য সেফ গার্ড বা নিরাপত্তাবেষ্টনীর অধীনে থাকবে। সে ক্ষেত্রে দুটি শর্ত পরিপালন করলেই জিএসপি প্লাসের জন্য দ্বিতীয় ধাপে যেতে পারবে সংশ্লিষ্ট দেশ। প্রথম শর্ত হচ্ছে, ইইউ বিভিন্ন দেশ থেকে তিনটি এইচএস কোড—৬১, ৬২ ও ৬৩, অর্থাৎ নিট ও ওভেন পোশাক এবং হোম টেক্সটাইল পণ্য যে পরিমাণ আমদানি করে, তার ৬ শতাংশের বেশি একক কোনো দেশ থেকে আসতে পারবে না। বাংলাদেশ থেকে এই তিন এইচএস কোডে ৯ শতাংশের বেশি পণ্য ইইউতে রপ্তানি হয়। দ্বিতীয় শর্ত হচ্ছে, জিএসপি সুবিধার অধীনে যে পরিমাণ তৈরি পোশাক ইইউ আমদানি করে, তার ৩৭ শতাংশের বেশি কোনো একক দেশ থেকে গেলে সেই দেশ জিএসপি প্লাসের জন্য যোগ্য হবে না। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের রপ্তানি ৫০ শতাংশের বেশি।
সেফ গার্ড থেকে উতরে গেলেও জিএসপি প্লাস সুবিধা পেতে হলে ৩২টি কনভেনশন অনুসমর্থন ও বাস্তবায়ন করতে হবে। বর্তমান জিএসপি নীতিমালায় ২৭টি কনভেনশন অনুসমর্থন ও বাস্তবায়নের বিধান ছিল। তবে ৩২টির মধ্যে মাত্র একটি কনভেনশন বাংলাদেশের সই করা বাকি রয়েছে। ফলে এটি বড় সমস্যা নয়। তবে জিএসপি প্লাস পেতে হলে সংশ্লিষ্ট পণ্যে ৪০ শতাংশ মূল্য সংযোজনের প্রয়োজন হবে। নিট পোশাকে থাকলেও ওভেন পোশাকের অনেকগুলোতেই এই পরিমাণ মূল্য সংযোজন হয় না।
বিষয়টি নিশ্চিত করে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্টের (আরএপিআইডি) চেয়ারম্যান আবদুর রাজ্জাক বলেন, খসড়া নীতিমালাটি অনুমোদিত হলে ইইউতে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে জিএসপি প্লাস সুবিধা পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা থাকবে না। এমনকি মূল্য সংযোজনের গ্যাঁড়াকলে অন্য কয়েকটি খাত জিএসপি প্লাস থেকে বঞ্চিত হবে। তিনি বলেন, ইইউর বাজারে জিএসপির সুবিধা ধরে রাখতে সরকারি পর্যায়ে আলাপ-আলোচনা করতে হবে। সেই আলোচনায় সুশীল সমাজ, রপ্তানিকারক, শ্রমিক সংগঠনের নেতাদেরও যুক্ত করার প্রয়োজন রয়েছে।
এই পর্যায়ে এসে যে কেউ প্রশ্ন করতে পারেন, ইইউর বাজারে শুল্কমুক্ত সুবিধা না থাকলে কি পোশাক রপ্তানিতে ধস নামবে? উত্তর হচ্ছে, এখনই এ ব্যাপারে নিশ্চিত করে কিছু বলা যাবে না। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে ইইউতে পণ্য রপ্তানিতে বাংলাদেশের বড় হাতিয়ার জিএসপি। আর এই সুবিধার কারণে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের ৬০-৬১ শতাংশের গন্তব্য ইইউ।
চলতি বছরের প্রথম ৪ মাসে (জুলাই-অক্টোবর) ১ হাজার ২৬২ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে। তার মধ্যে ৬০ দশমিক ২৭ শতাংশ বা ৭৬০ কোটি ডলারের পোশাক ইইউর বিভিন্ন দেশে গেছে।