বিজিএমইএ নেতারা বলছেন, প্রস্তাবিত এলাকায় জমির দাম বেশি হওয়ায় ও নির্মাণ ব্যয় বাড়তে থাকায় তারা এ উদ্দ্যোগ থেকে পিছু হটেছেন।
চার দশক আগে, ১৯৭৮ এ চট্টগ্রামের কালুরঘাট বিসিক শিল্প এলাকার ‘দেশ গার্মেন্টসের’ হাত ধরেই শুরু হয়েছিল বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানির পথচলা। দুই দশক পর সেই কালুরঘাটেই স্বতন্ত্র গার্মেন্টস পল্লী গড়ে তোলার বিষয়ে একমত হন ব্যবসায়িরা।
কিন্তু সেই উদ্দ্যোগ আর এগোয়নি, গত দুই দশকেও গড়ে ওঠেনি চট্টগ্রামের স্বতন্ত্র গার্মেন্টস পল্লী।
২০১৩ সালে সাভারের রানা প্লাজা ধসের পর সে দাবি আরও জোরদার হয়। এই লক্ষে ২০১৬ সালের ৩ জানুয়ারি নগরীর কালুরঘাটে ১১ দশমিক ৫৫১ একর জমিতে স্বতন্ত্র গার্মেন্টস পল্লী গড়ে তুলতে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) সঙ্গে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ)।
বিজিএমইএ নেতারা বলছেন, প্রস্তাবিত এলাকায় জমির দাম বেশি হওয়ায় ও নির্মাণ ব্যয় বাড়তে থাকায় তারা এ উদ্দ্যোগ থেকে পিছু হটেছেন। বর্তমানে স্বতন্ত্র গার্মেন্সপল্লী গড়ে তুলতে হলে শহরের বাইরে হাটহাজারী, আনোয়ারা ও পটিয়ার মত উপ-শহর বা শহরতলীর দিকে নজর দিতে হবে।
বিজিএমইএর প্রকৌশলী মাঈন উদ্দিন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, “শহরের নদী তীরবর্তী শিল্প এলাকাগুলোতে নির্মাণ ব্যয় অনেক বেশি। পোশাক কারখানার মানের অবকাঠামো নির্মাণের জন্য ১৪০ ফুট পর্যন্ত পাইলিং করতে হয়। এসব কারণে নির্মাণ ব্যয় দ্বিগুন হয়ে যায়।”
“কারখানা স্থাপন করতে হবে শিল্পায়িত জোনে, আবাসিক এলাকায় নয়। শিল্পপল্লী করতে হলে এখন শহরের বাইরে যেতে হবে,” বলেন তিনি।
বিজিএমইএর প্রথম সহসভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, “শিল্প কারখানা স্থাপনে চট্টগ্রামে এখন প্রধান সমস্যা জমির উচ্চমূল্য। পোশাক শিল্প কারখানার জন্য স্বতন্ত্র পল্লী গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। তখন অল্প সময়ের নোটিশে অনেক কারখানা মালিক নির্মাণ ব্যয়ের জন্য অগ্রিম টাকাও দিয়েছিলেন। কিন্তু অতিরিক্ত ব্যয়ের কারণে তা আর হয়ে ওঠেনি।”
বিজিএমইএ সূত্র জানায়, বন্দর সুবিধার কারণে ১৯৭৮ সালে চট্টগ্রাম থেকেই তৈরি পোশাক শিল্প কারখানার গোড়াপত্তন হয়। এরপরের চার দশকে চট্টগ্রাম শহরের আনাচে-কানাচে ছোট-বড় প্রায় সাড়ে ৭শ পোশাক কারখনা গড়ে ওঠে। করোনা মহামারির আগ পর্যন্ত গড়ে প্রতি বছর অন্তত ২০টি কারখানা স্থাপিত হয়েছে এই শহরে।
কারখানাগুলো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকায় শ্রমিকের সংকট ও যাতায়াতে সময় ব্যয়সহ প্রয়োজনীয় নিরাপত্তার অভাব রয়েছে এক্ষেত্রে। অথচ তৈরি পোশাক শিল্পের ৪০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি এই চট্টগ্রামে থেকেই। তবুও এখানকার কারখানাগুলোর দিকে নজর দেওয়া হয়নি।
বর্তমানে সাড়ে ৩শ পোশাক কারখানায় প্রায় চার লাখ শ্রমিক কাজ করেন।
বিজিএমইএ ও চসিকের মধ্যকার সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী, চসিকের ওই জমিতে সাত তলা বিশিষ্ট ১০টি ভবন এবং একটি ইউটিলিটি ভবন নির্মাণের কথা ছিল। ভবনের প্রতি তলার আকৃতি নির্ধারণ করা হয় ২০ হাজার বর্গফুট। সবমিলিয়ে এর আয়তন হতো ১ লাখ ৪০ হাজার বর্গফুট।
এই ভবন নির্মাণের জন্য চসিককে এককালীন ১৪০ কোটি টাকা দেওয়ার কথা ছিল বিজিএমইএর। এছাড়া মাসে প্রতি বর্গফুটের জন্য ১২ টাকা করে মোট ১৬ লাখ ৮০ হাজার টাকা ভাড়া দেওয়ার কথা ছিল।
শুরুতে সিটি করপোরেশন প্রতি বর্গফুটের নির্মাণ ব্যয় ধরেছিল প্রায় ২২০০ টাকা করে। কিন্তু বিজিএমইএর চাহিদা মতো সেন্ট্রাল ইটিপি, সেন্ট্রাল জেনারেটর, সেন্ট্রাল বয়লার, সেন্ট্রাল ইলেক্ট্রিক অ্যান্ড ফায়ার প্রটেকশন ব্যবস্থা স্থাপনের জন্য ব্যয় বেড়ে গিয়েছিল কয়েকগুণ।
সেসময় এই প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য প্রায় ৫০০ কোটি টাকা প্রয়োজন পড়ে। অতিরিক্ত ব্যয়ের বিপরীতে স্বল্প আয়ের অসামঞ্জ্যতা থাকায় চসিকের ঋণ পাওয়া নিয়েও তৈরি হয় জটিলতা। তখনই মুখ থুবড়ে পড়ে পোশাক কারখানার জন্য স্বতন্ত্র এই পল্লীর উদ্যোগ।
তৈরি পোশাকের আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের জোট অ্যাকোর্ডা অ্যালায়েন্সের মতে, এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে স্বতন্ত্র পল্লী গড়ে তোলা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।
পোশাক কারখানা এবং শ্রমিকদের নিরাপত্তার জন্য পৃথক কোড ও আইন মেনে কারখানার অবকাঠামো তৈরি করতে হয়। যেখানে বৈদ্যুতিক ও অগ্নিনির্বাপক নিরাপত্তা নিশ্চিত থাকতে হবে।
বিজিএমইএর সাবেক প্রথম সহসভাপতি নাসির উদ্দিন চৌধুরী টিবিএসকে বলেন, “পোশাক কারখানার জন্য বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস সরবরাহসহ ইউটিলিটি সুবিধা প্রয়োজন। এজন্য একটি অঞ্চল বা জোন দরকার।”
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পরিকল্পিতভাবে এমন জোন গড়ে তোলা হয়েছে, উল্লেখ করে তিনি বলেন, “আমাদের এখানে সুনির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা নেই।”
তিনি আরও বলেন, “শিল্প উপযোগী সুবিধা সম্পন্ন পল্লী গড়তে বড় এলাকা লাগবে। বন্দরের সঙ্গে ভালো সড়ক যোগাযোগ থাকতে হবে। চট্টগ্রাম শহরে এখন এমন জায়গা পাওয়া কঠিন।”