এলডিসি উত্তরণের ফলে সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে দেশের রফতানি খাত। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় রফতানি বহুমুখীকরণ ও সক্ষমতা বৃদ্ধির ওপর জোর দেয়া প্রয়োজন বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা। এজন্য অল্প কয়েকটি খাতকে অগ্রাধিকার খাত চিহ্নিত না করে দেশের সব শিল্প খাতকে সমান সুযোগ-সুবিধা দেয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। পাশাপাশি এলডিসি-পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় ব্যবসার খরচ কমানো, কাস্টমসের সক্ষমতা বৃদ্ধি, উৎপাদনশীলতা ও বিদেশী বিনিয়োগ বাড়ানোর সুপারিশ করা হয়েছে। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই আয়োজিত এক সেমিনার থেকে গতকাল এমন মতামত তুলে ধরা হয়। এফবিসিসিআই অডিটোরিয়ামে এ সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়।
‘এক্সপোর্ট চ্যালেঞ্জেস অব বাংলাদেশ আফটার গ্র্যাজুয়েশন ফ্রম এলডিসি স্ট্যাটাস: অপশনস ফর দ্য প্রাইভেট সেক্টর’ শীর্ষক সেমিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস। অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান মো. সিরাজুল ইসলাম, বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ, শিল্প সচিব জাকিয়া সুলতানা প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
সেমিনার থেকে দেশের রফতানি খাতে বৈচিত্র্য আনার তাগিদ দেন এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন। এজন্য রফতানিকে সমৃদ্ধ করতে সব খাতকে সমান সুবিধা দেয়া দরকার বলে উল্লেখ করেন তিনি। পাশাপাশি নবায়নের প্রয়োজনীয়তা ছাড়া স্থায়ী নিবন্ধন, শুধু জমি, পরিবেশ, ইমারত, আগুন ও কর সনদের মাধ্যমে শিল্প স্থাপনের সুযোগসহ ওয়ানস্টপ সেবা চালুর আহ্বান জানান। এ সময় তিনি রফতানি-সংক্রান্ত সব কার্যক্রম বাস্তবায়নে ইপিবি, এনবিআর ও অন্যান্য প্রশাসনিক সিঙ্গেল উইন্ডো ব্যবস্থা কার্যকর করার দাবি জানান।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব বলেন, প্রধানমন্ত্রী নিজে বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্যকে ব্র্যান্ডিং করেন। প্রত্যেক বিদেশ সফরে তিনি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে নিয়ে যান। এলডিসি-উত্তরণের আগের চার বছর মোটেও কম সময় নয় উল্লেখ করে মুখ্য সচিব বলেন, বাংলাদেশ যে গতিতে এগোচ্ছে, তাতে এ সময়ের মধ্যে বিভিন্ন সংস্থার করা হিসাব পরিবর্তন করে দেবে। এ সময় তিনি ভ্যাকসিন ক্রয় ও মেগা প্রকল্পগুলোতে কোনো দুর্নীতি হয়নি বলে জানান।
বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান তার বক্তব্য বলেন, বিশ্বব্যাংক ব্যবসা সহজীকরণ সূচক প্রকাশ বন্ধ করলেও, দেশে ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ তৈরিতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে বিডা। ২০১৯ সালে চালুর পর থেকে ওয়ানস্টপ সার্ভিস থেকে বিডা সংশ্লিষ্ট ৫০ হাজারের বেশি সেবা দেয়া হয়েছে। দৈনিক গড়ে বিডার ১০০টি সেবা দেয়া হচ্ছে। তবে বিডার বাইরে থাকা ১৮টি সংস্থার মাত্র ৫৮টি সেবা যুক্ত হয়েছে। এসব সেবা বিডার ওএসএস প্লাটফর্ম থেকে নেয়ার জন্য ব্যবসায়ীদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
সেমিনারে বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ জানান, এলডিসি উত্তরণের পরও যেন অন্তত ছয় বছর শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা অব্যাহত থাকে, সে ব্যাপারে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সঙ্গে দরকষাকষি চলছে। তবে দীর্ঘমেয়াদে রফতানি ও বাণিজ্য সক্ষমতা ধরে রাখতে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির বিকল্প নেই বলে মনে করেন তিনি। এজন্য সরকারের পক্ষ থেকে প্রস্তুতি চলছে বলে জানান বাণিজ্য সচিব।
শিল্প সচিব তার বক্তব্যে জানান, এলডিসি-উত্তরণ চ্যালেঞ্জে সরকার শিল্প খাতে নারী উদ্যোক্তা তৈরি, আমদানি পণ্যের বিকল্প উৎপাদনসহ বিভিন্ন বিষয়ে সচেতন রয়েছে।
পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য শরিফা খান বলেন, বাংলাদেশের শিল্প খাত যথেষ্ট বৈচিত্র্যপূর্ণ। দেশে প্রায় সবধরনের পণ্যই উৎপাদিত হয়। কিন্তু এসব পণ্যকে রফতানি বাজারের জন্য উপযোগী করে তুলতে হবে।
সেমিনারে উন্মুক্ত আলোচনায় বক্তব্য রাখেন এফবিসিসিআইয়ের পরিচালক সৈয়দ আলমাস কবির, এফবিসিসিআইয়ের প্যানেল উপদেষ্টা ও সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, এমসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর, পিডব্লিউসি বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা অংশীদার মামুন রশীদ, এফবিসিসিআইয়ের উপদেষ্টা মঞ্জুর আহমেদ এবং বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মজিবুর রহমান।
উন্মুক্ত আলোচনা থেকে দক্ষ জনশক্তি তৈরি, সরবরাহ শৃঙ্খলা অব্যাহত রাখা, দেশের প্রতিটি অঞ্চলে ফাইভ-জি, ব্রডব্যান্ড পৌঁছে দেয়া, শিল্পের সঙ্গে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংযোগ, প্রযুক্তি অভিযোজন, মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি করার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়।
সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন এফবিসিসিআইয়ের প্যানেল উপদেষ্টা ও বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের সাবেক সদস্য ড. মোস্তফা আবিদ খান। তিনি জানান, এলডিসি থেকে উত্তরণের পর বাংলাদেশ তিনটি প্রধান চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়বে। শুল্কমুক্ত বাজার প্রবেশাধিকার হারানো, রফতানিতে ভর্তুকি বন্ধ করে দেয়া ও ট্রিপসের আওতায় সুযোগ-সুবিধা বন্ধ হয়ে যাওয়া। এর ফলে কানাডায় পোশাক রফতানিতে ১৬ দশমিক ৫ শতাংশ, ইইউতে ১১ দশমিক ৫ শতাংশ, জাপানে ৯ শতাংশ, কোরিয়ায় ১২ দশমিক ৫ শতাংশ হারে শুল্ক দিতে হবে। বাড়তি শুল্কের কারণে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, রফতানি কমতে পারে ২৬ দশমিক ৬ শতাংশ।