ভালো বেতনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে বাংলাদেশ থেকে দক্ষ জনশক্তি নিয়োগ করছে দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের দেশ বুলগেরিয়া।
এখন পর্যন্ত ইউরোপের বাজার বাংলাদেশের তৈরি পোশাক (আরএমজি) পণ্যের শীর্ষ রপ্তানি গন্তব্যগুলোর একটি।
তবে এই প্রথম ইউরোপের কোনো দেশে পেশাগত যাত্রা শুরু করছেন বাংলাদেশের আরএমজি কর্মীরা।
এই পদক্ষেপ ইঙ্গিত দিচ্ছে, ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের বড় ব্র্যান্ড ও ক্রেতারা নিয়ারশোরিং ও অটোমেশনের দিকে মনোযোগ দিচ্ছে।
বৈশ্বিক পরামর্শদাতা প্রতিষ্ঠান ম্যাককিনসে অ্যান্ড কোম্পানির সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুসারে, বৈশ্বিক পোশাক ব্র্যান্ড ও খুচরা বিক্রেতাদের টিকে থাকতে হলে এশীয় দেশগুলো থেকে আরএমজি আমদানি কমাতে হবে।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, ‘এই প্রথম ইউরোপের কোনো দেশ বাংলাদেশ থেকে আরএমজি কর্মী নিয়োগের জন্য আনুষ্ঠানিক পদক্ষেপ নিল।’
অধিকাংশ ক্রেতাই লিড টাইম—উৎপাদন প্রক্রিয়া শুরু ও সম্পন্ন করতে মোট যে সময় লাগে—কমানোর জন্য নিয়ার-শোর থেকে পণ্য সোর্স করতে চায়; তাই বুলগেরিয়ার প্রতিষ্ঠানগুলো এ উদ্যোগ নিয়েছে।
ফারুক হাসান আরও বলেন, ‘আমরা মনে করি প্রত্যেকেরই উন্নত জীবন বেছে নেওয়ার অধিকার আছে। বুলগেরিয়ান কারখানার কাজের প্রস্তাব শ্রমিকদের ভালো জীবনযাপনে সহায়ক হবে। একইসাথে আমরা দক্ষ জনশক্তি তৈরির জন্য আরও বেশিসংখ্যক লোককে প্রশিক্ষণ দিচ্ছি।’
অবশ্য ইংল্যান্ডের কিছু পোশাক কারখানায় অল্পসংখ্যক বাংলাদেশি কাজ করছে বলে জানান তিনি।
প্রাথমিকভাবে দুটি বুলগেরিয়ান কোম্পানি—আঁতোয়া ভিল ও মিজিয়া-৯৬এডি—প্রতি মাসে ৪৬০ ডলার (৪৫,০০০ টাকা)) বেতনে ১০০ জন কর্মী নিয়োগ করছে।
বাংলাদেশ ওভারসিজ এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড সার্ভিসেস লিমিটেডের (বোয়েসল) তত্ত্বাবধানে ইতিমধ্যে নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
বোয়েসল সূত্রে জানা গেছে, এই কোম্পানিগুলো দক্ষ কর্মী, বিশেষ করে সুইং মেশিন অপারেটর, প্রেসিং মেশিন অপারেটর ও টেক্সটাইল টেইলার্স খুঁজছে।
বাংলাদেশে একজন পোশাক শ্রমিকের মাসিক আয় ৮ হাজার টাকা থেকে ৮ হাজার ৪২০ টাকার মধ্যে ওঠানামা করে। বুলগেরিয়ায় যারা নিয়োগ পাবেন, তারা দেশের চেয়ে পাঁচগুণ বেশি আয় করবেন।
চাকরির শর্তাবলি অনুযায়ী, চুক্তির মেয়াদ হবে সর্বোচ্চ তিন বছর এবং প্রতিবার নবায়নযোগ্য। মাসিক বেতন ছাড়াও বিমান ভাড়া, খাওয়া বাবদ মাসিক ৫০ ডলার এবং থাকা বাবদ ৩-৪ জনের আলাদা কক্ষ কোম্পানি থেকে দেওয়া হবে।
তবে বিদ্যুৎ ও পানির বিল কর্মীকে বহন করতে হবে। কর্মাবস্থায় দুর্ঘটনাজনিত ক্ষতিপূরণ এবং অন্যান্য বিষয়াদি বুলগেরিয়ার শ্রম আইন অনুযায়ী প্রযোজ্য হবে।
২০ থেকে ৩৫ বছর বয়সি পুরুষ ও নারী উভয় প্রার্থীই নিয়োগের জন্য আবেদন করতে পারবেন।
বোয়েসলের ৪২ হাজার টাকা সার্ভিস চার্জসহ মোট অভিবাসন খরচ ৫২ হাজার ৭৪০ টাকা।
স্টেকহোল্ডারদের মতে, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন শ্রম রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান বোয়েসলও বেসরকারি নিয়োগকারীদের মতোই অভিবাসনের জন্য মাত্রাতিরিক্ত চার্জ নিচ্ছে।
বোয়েসলের জেনারেল ম্যানেজার (ওভারসিজ এমপ্লয়মেন্ট) বনানী বিশ্বাস টিবিএসকে বলেন, ‘আপাতত ১০০ লোকের চাহিদা দিলেও পরবর্তীতে আরো লোক নেয়া হবে বলে আমরা আশা করছি। হ্যান্ডসাম স্যালারি হওয়ায় আমরা শ্রমবাজারটিকে গুরুত্ব দিচ্ছি।
‘এর আগে ইউরোপে আমাদের কোনো স্কিলড গার্মেন্ট ওয়ার্কার যায়নি। জর্ডানের পরে বোয়েসেল-এর মাধ্যমে বুলগেরিয়াতেই প্রথম গার্মেন্টস কর্মীরা যাচ্ছে।’
উচ্চ অভিবাসন ব্যয়ের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘অভিবাসন ব্যয় নির্ধারণ করে বোয়েসেল বোর্ড। যদি এটা বেশি হয়ে থাকে, আমরা বোর্ডে বিষয়টি আবার তুলব যাতে পুনরায় বিবেচনা করা যায়।’
নিয়োগের শর্তানুযায়ী, একজন কর্মীকে দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজ করতে হবে। ওভারটাইমের পারিশ্রমিকও কোম্পানির নীতিমালা অনুযায়ী দেওয়া হবে।
বোয়েসল প্রতি শুক্রবার বাংলাদেশ-কোরিয়া টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারে আগ্রহী প্রার্থীদের ব্যবহারিক পরীক্ষা নিচ্ছে। বোয়েসেলের বাছাইকৃতদের মধ্য থেকে বুলগেরিয়ার কোম্পানি প্রতিনিধিরা এসে পুনরার পরীক্ষার মাধ্যমে চূড়ান্ত প্রার্থী বাছাই করবেন।
দীর্ঘদিন ধরেই পূর্ব ইউরোপের ফ্যাশনের কেন্দ্র বুলগেরিয়া। বুলগেরিয়ান ফ্যাশন ম্যানুফ্যাকচারিংকে প্রায়ই তাদের প্রতিবেশী তুরস্কের উচ্চ মানের সঙ্গে তুলনা করা হয়।
প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে পারিবারিকভাবে বুলগেরিয়ান ফ্যাশন ম্যানুফ্যাকচারাররা কাজ করছে। এই ঐতিহ্যের সঙ্গে নতুন সেলাই প্রযুক্তি যুক্ত হওয়ায় বুলগেরিয়া হয়ে উঠেছে পোশাক ও টেক্সটাইল সোর্সিংয়ের হটস্পট।
গার্মেন্টস ও টেক্সটাইল উৎপাদন আজও বুলগেরিয়ার অন্যতম প্রধান শিল্প। হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান করছে এই খাত।
ইউরোপে বুলগেরিয়ার উৎপাদন খরচই সবচেয়ে কম। এছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যপদ থাকায় সমস্ত নৈতিক ও পরিবেশগত মানদণ্ডও নিশ্চিত করে দেশটি।
২০১৮ সালে বুলগেরিয়ার ফ্যাশন সেগমেন্টের আয় ছিল আনুমানিক ৩২৪ মিলিয়ন ডলার।
পোশাক সোর্সিং ও প্রোডাক্ট ডেভেলপমেন্ট সাইট স্কেচ-এর তথ্যানুসারে, পোশাক ও টেক্সটাইল শিল্প বুলগেরিয়ায় প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি করেছে।
২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশ বুলগেরিয়ায় ১.৭৯ মিলিয়ন ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে, আর ২০১৯-২০ অর্থবছরে আরএমজি শিপমেন্ট ছিল ২.২৭ মিলিয়ন ডলার।
নিয়োগকারী সংস্থাগুলোর মধ্যে আঁতোয়া ভিল ১৯৮৮ সাল থেকে উচ্চ মানের মহিলাদের পোশাক উৎপাদন করছে।
বোয়েসলের তথ্যমতে, প্রতিষ্ঠানটি নানা স্টাইলের পোশাক তৈরি করে—জামা, ব্লাউজ, টপস, জ্যাকেট, ট্রাউজার, স্কার্ট ইত্যাদি। জার্মানি, বেলজিয়াম, সুইডেন, গ্রেট ব্রিটেন ও অন্যান্য ইইউভুক্ত দেশের গ্রাহকদের দ্বারা স্বীকৃত বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক ফ্যাশন ব্র্যান্ডের সঙ্গে দীর্ঘদিনের অংশীদারত্ব আছে কোম্পানিটির।
বর্তমানে জর্ডানেও বাংলাদেশি দক্ষ নারী আরএমজি কর্মীরা কর্মরত আছেন। তারা মাসিক ২২ হাজার টাকা বেতন পান।
এছাড়া কয়েকজন বাংলাদেশি ইতালির আরএমজি কারখানায়ও কাজ করছেন বলে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (আরএমএমআরইউ) প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান তাসনিম সিদ্দিকি বলেন, ‘বাংলাদেশে তৈরি পোশাক খাতে প্রচুর শ্রমিক আছে। তারা যথেষ্ট দক্ষ। আমরা এই জনশক্তি বিদেশে রপ্তানির উদ্যোগ নিতে পারি। ইউরোপের বাজার পোশাক জনশক্তি রপ্তানির আদর্শ গন্তব্য হতে পারে।’
‘তবে এই সংখ্যাটা যাতে লিমিটেড না হয়ে ক্রমাগত বাড়ে, সেদিকে বোয়েসেলকে নজর দিতে হবে। বছরে যদি অন্তত ১০ হাজার লোক আমরা ইউরোপের মার্কেটে পাঠাতে পারি, তাহলে এটা রেমিট্যান্সের ক্ষেত্রে বিশাল প্রভাব ফেলবে,’ যোগ করেন তিনি।
২০২৫ সালের মধ্যে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান ব্র্যান্ড এবং ক্রেতারা চীন, বাংলাদেশ ও ভিয়েতনামের মতো দেশগুলো থেকে তাদের তৈরি পোশাকের আমদানি কমিয়ে দিতে পারে। বৈশ্বিক পরামর্শদাতা সংস্থা ম্যাককিনসে অ্যান্ড কোম্পানির ‘ইজ অ্যাপারেল ম্যানুফ্যাকচারিং কামিং হোম?’ শিরোনামের প্রতিবেদনে এ ইঙ্গিত দেওয়া হয়।
ব্যবসায়িক প্রকাশনা ‘সোর্সিং জার্নাল’-এর সঙ্গে যৌথভাবে ১৮০টি ব্র্যান্ড, ক্রেতা ও নির্বাহীদের ওপর একটি সমীক্ষার পর প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, আগামীতে সফল পোশাক কোম্পানি তারাই হবে যারা দুটি ফ্রন্টে—নিয়ারশোরিং ও অটোমেশন—পোশাকের ভ্যালু চেইন বাড়ানোতে নেতৃত্ব দেবে।
দুটি ফ্রন্টেই টেকসই উপায়ে ভ্যালু চেইন বাড়াতে হবে। ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে পোশাকের ব্র্যান্ড এবং খুচরা বিক্রেতারা আর আগের মতো ব্যবসা করতে পারছে না বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। সেখানে বিক্রেতা ও ব্র্যান্ডগুলো ব্যবসা বাড়ানোর পথ খুঁজছে।
এই দেশগুলোতে মজুরি বৃদ্ধির ফলে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় বিদেশি ব্র্যান্ডগুলো এমন পরিকল্পনা করেছে।
ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের ব্র্যান্ড এবং ক্রেতারা চীন, বাংলাদেশ ও ভিয়েতনামের পরিবর্তে মেক্সিকো ও তুরস্কের মতো কাছাকাছি দেশ থেকে পোশাক তৈরি করতে চাইছে।
তারা মনে করছে, এতে কম সময়ে পোশাক হাতে পাবে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ফ্যাশনের ধারা বদলে যাওয়ায় ক্রেতারা এখন কম সময়ে ও কম খরচে পোশাক চায় বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বাংলাদেশ থেকে জার্মানিতে পণ্য পাঠাতে সময় লাগে ৩০ দিন, যেখানে তুরস্ক থেকে জার্মানিতে পণ্য পাঠাতে সময় লাগে মাত্র ৩ থেকে ৬ দিন।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাই-মে মাসে তৈরি পোশাকের চালান আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ৩৫ শতাংশ বেড়েছে। এ সময়ে রপ্তানি হয়েছে ৩৮.৫২ বিলিয়ন ডলারের পোশাক।
এই সময়ে ইইউতে বাংলাদেশের রপ্তানি ছিল প্রায় ১৯.৩ বিলিয়ন ডলার, যা মোট পোশাক রপ্তানির ৫০.১১ শতাংশ। আর যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের মোট পোশাকের ১০.৬৩ শতাংশ ও ২১.১৫ শতাংশ রপ্তানি হয়।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের শীর্ষ ৭ রপ্তানি গন্তব্য হলো—জার্মানি (৬.৫ বিলিয়ন ডলার), স্পেন (২.৭২ বিলিয়ন ডলার), ফ্রান্স (২.১৫ বিলিয়ন ডলার), পোল্যান্ড (১.৮২ বিলিয়ন ডলার), ইতালি (১.৪২ বিলিয়ন ডলার), নেদারল্যান্ডস (১.৩২ বিলিয়ন ডলার) এবং ডেনমার্ক (১.০৩ বিলিয়ন ডলার)।
Reference: