গ্যাস ও বিদ্যুৎ–সংকটে বস্ত্র খাতের কারখানাগুলোর উৎপাদন কমে গেছে ২০ থেকে ৫০ শতাংশ। তাতে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে।
গাজীপুরের ভবানীপুরের মোশারফ কম্পোজিট টেক্সটাইল মিলস সুতা তৈরির পাশাপাশি কাপড় রং ও তৈরি পোশাক উৎপাদন করে। গ্যাসচালিত ক্যাপটিভ জেনারেটরের সাহায্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের নিজস্ব ব্যবস্থা রয়েছে তাদের। গত বছরের শেষের দিক থেকে কারখানাটিতে গ্যাসের চাপ কম। তাই বিদ্যুতের বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে পল্লী বিদ্যুতের সংযোগ নেয় তারা। সেখান থেকে যে বিদ্যুৎ পাওয়া যায়, তা চাহিদার তিন ভাগের এক ভাগেরও কম। তাই ডিজেল জেনারেটরও স্থাপন করেছে কারখানা কর্তৃপক্ষ।
চলতি বছরের শুরুতে গ্যাসের চাপ কম থাকলেও মাঝে দুই মাস ভালো ছিল। তবে মাসখানেক ধরে আবারও গ্যাসের চাপ কম। বিকেল পাঁচটা থেকে ভোর পাঁচটা পর্যন্ত গ্যাসের চাপ শূন্য থেকে ৩ পিএসআইয়ের (প্রতি বর্গইঞ্চিতে গ্যাসের চাপের ইউনিট) মধ্যে ওঠানামা করে। আর গ্যাসের চাপ ৩ পিএসআইয়ের নিচে নামলেই ক্যাপটিভ চালানো যায় না। তাতে সুতার কারখানা গড়ে প্রতিদিন চার-পাঁচ ঘণ্টা বন্ধ রাখতে হচ্ছে।
মোশারফ কম্পোজিট টেক্সটাইলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোশারফ হোসেন গতকাল বলেন, ‘আমাদের কারখানায় দিনে গড়ে ১৬০ টন সুতা তৈরি হয়। গ্যাসের চাপ চাহিদার চেয়ে নিচে থাকায় বর্তমানে ৩০-৩৫ টন সুতা কম উৎপাদিত হচ্ছে। সব মিলিয়ে সুতার উৎপাদন ২০ শতাংশের মতো কমে গেছে।
মোশারফ কম্পোজিট টেক্সটাইলের মতো বস্ত্র খাতের অধিকাংশ কারখানা গ্যাস-বিদ্যুতের সংকটে কমবেশি ভুগছে। তাতে কারখানাগুলোর উৎপাদন কমে গেছে ২০ থেকে ৫০ শতাংশ। উৎপাদন কমে যাওয়ায় খরচও বেড়ে যাচ্ছে বলে দাবি করেন এই খাতের কয়েকজন উদ্যোক্তা।
বস্ত্রকল মালিকদের সংগঠন বিটিএমএর সভাপতি মোহাম্মদ আলী প্রথম আলোকে বলেন, সুতার মিলগুলোতে প্রায় ২৫০ কোটি ডলার বা ২৩ হাজার ৬৭৫ কোটি টাকার সুতা অবিক্রীত অবস্থায় পড়ে আছে। কারণ, ক্রয়াদেশ কম। সাধারণত পণ্য গুদামে পড়ে থাকলেও মিলগুলো পুরোদমে উৎপাদন করে। কারণ, গ্যাস-বিদ্যুতের বিল, শ্রমিকের মজুরি ও ব্যাংকের সুদ নিয়মিতই দিতে হয়। গুদামে পণ্য থাকলে দরদাম করে বিক্রি করতে পারেন উদ্যোক্তারা। আবার কারখানা বন্ধ রাখলে উৎপাদন খরচ বাড়ে। বর্তমান পরিস্থিতিতে গড়ে ৩০ শতাংশ উৎপাদন কমে গেছে। তাতে উদ্যোক্তাদের লোকসানে পড়তে হবে।
দেশের শীর্ষস্থানীয় রপ্তানি খাত তৈরি পোশাকশিল্পের নিট পোশাক কারখানার প্রয়োজনীয় সুতার ৭৫-৮০ শতাংশ এবং ওভেন পোশাক কারখানার ৪০-৪৫ শতাংশ কাপড় সরবরাহ করে দেশীয় বস্ত্রকল। পাশাপাশি স্থানীয় বাজারেও সুতা-কাপড় সরবরাহ করে বস্ত্র খাত।
বিটিএমএর তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে প্রায় পাঁচ শ স্পিনিং মিল রয়েছে। আর উইভিং বা কাপড় বোনার কারখানা রয়েছে প্রায় ৯০০টি। কাপড়ে রং করার ডাইং কারখানার ২৫০-৩০০টি।
বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ে গত মাসের তৃতীয় সপ্তাহে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) এবং জ্বালানি তেল আমদানি কমানোর সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। ডিজেলচালিত সব বিদ্যুৎকেন্দ্রও আপাতত বন্ধ রাখা হয়েছে। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমেছে। আর বিদ্যুতের ঘাটতি পূরণে সারা দেশে নিয়ম করে লোডশেডিং করছে বিদ্যুৎ বিভাগ। এলএনজি আমদানি কমানোয় শিল্পকারখানায় চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস সরবরাহ করতে পারছে না তিতাস।
নারায়ণগঞ্জের একজন বস্ত্রকল মালিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বললেন, ‘আমাদের মিলে দিনে এক লাখ পাউন্ডের বেশি সুতা উৎপাদিত হয়। তবে গ্যাসের চাপ কমে যাওয়ায় বর্তমানে উৎপাদন ৫০ শতাংশের মতো কমে গেছে। উৎপাদন কমে যাওয়ায় পণ্যের খরচ বেড়েছে। তুলার দামও বাড়তি। ফলে সামনের দিনে আমাদের জন্য কী অপেক্ষা করছে বুঝতে পারছি না।’
গ্যাসের পরিস্থিতি নিয়ে ওই উদ্যোক্তা বললেন, ভোর সাড়ে ৫টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত এবং বেলা ৩টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত গ্যাসের চাপ ১-৩ পিএসআইতে নেমে যায়। তাতে আর ক্যাপটিভ চালানো যায় না। তখন পল্লী বিদ্যুতের লাইন দিয়ে আংশিক উৎপাদন চালাতে হয়। সেটাও অনেক সময় লোডশেডিংয়ের কারণে করা যায় না।
বিটিএমএর তথ্য অনুযায়ী, বিদায়ী ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) স্পিনিং মিলগুলো প্রচ্ছন্নভাবে ৪৩২ কোটি ডলারের সুতা রপ্তানি করে। এর আগের বছর প্রচ্ছন্নভাবে ৪১৮ কোটি ডলারের সুতা রপ্তানি হয়। অবশ্য বিদায়ী অর্থবছর সুতার দাম ছিল বাড়তি। ধীরে ধীরে দর কমছে।
সারা দেশের মধ্যে নরসিংদীতে বস্ত্র খাতের কারখানা বেশি। সেখানকার উইভিং ও ডাইং কারখানাগুলোর ৯৫ শতাংশ ক্ষুদ্র ও মাঝারি। ডাইং কারখানাগুলোতে বিদ্যুতের পাশাপাশি বয়লার চালাতে গ্যাসের প্রয়োজন হয়। বর্তমান পরিস্থিতিতে নরসিংদীর কারখানাও আছে বিপদে।
বিটিএমএর সহসভাপতি আবদুল্লাহ আল মামুন গতকাল বলেন, গ্যাসের চাপ কম। দিনে কমপক্ষে তিন ঘণ্টা লোডশেডিং হচ্ছে। কারখানাগুলোর উৎপাদন গড়ে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কমে গেছে। এমন অবস্থা চলতে থাকলে অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে।