সরাসরি যুদ্ধে লিপ্ত রাশিয়া-ইউক্রেনে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের রপ্তানি কমেছে। যুদ্ধের পরোক্ষ প্রভাবে ইইউ ও যুক্তরাষ্ট্রের ক্রয়াদেশও কমছে।
রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের ছয় মাস পেরিয়ে গেছে, তবু তা বন্ধের লক্ষণ নেই। সরাসরি যুদ্ধে লিপ্ত রাশিয়া-ইউক্রেনে ইতিমধ্যে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানি কমেছে। তবে যুদ্ধের পরোক্ষ প্রভাবই ভোগাচ্ছে বেশি বাংলাদেশকে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) দেশগুলোয় মূল্যস্ফীতির হার বেড়েছে। সেখানে জ্বালানি ও নিত্যপণ্যের বাইরে অন্যান্য পণ্য বিক্রি কমে গেছে। পণ্যের মজুত জমছে। সে কারণে বাংলাদেশে ক্রয়াদেশ কমিয়ে দিচ্ছে ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানগুলো। ফলে আগামী মাসগুলোয় রপ্তানি কমবে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যানুযায়ী, রাশিয়ার বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের রপ্তানি বাড়ছিল। করোনার মধ্যেও ২০২০-২১ অর্থবছরে রপ্তানি বৃদ্ধি পায় ১৮ কোটি ডলার। তাতে মোট রপ্তানির পরিমাণ দাঁড়ায় সাড়ে ৬৬ কোটি ডলার। যুদ্ধের প্রভাবে গত জুনে শেষ হওয়া অর্থবছরে সেই রপ্তানি ৪ শতাংশ কমে ৬৩ কোটি ৮৩ লাখ ডলারে নামে। জুলাইয়ে দেশটিতে রপ্তানি কমে অর্ধেকে নেমেছে। এই মাসে রপ্তানি হয়েছে দুই কোটি ডলারের পণ্য।
রাশিয়ায় বাংলাদেশের শীর্ষ রপ্তানি পণ্য হচ্ছে নিট ও ওভেন পোশাক, পাট ও পাটজাত পণ্য এবং হোম টেক্সটাইল। ২০২১-২২ অর্থবছরে ৬৩ কোটি ৮৩ লাখ ডলারের রপ্তানির মধ্যে ৫৮ কোটি ডলারই ছিল পোশাক খাতের। গত জুলাইয়ে দেশটিতে রপ্তানি হয়েছে মাত্র ১ কোটি ৮১ লাখ ডলার।
অন্যদিকে ইউক্রেনে বাংলাদেশি পণ্যের বাজার ছোট। এই বাজারে শীর্ষ রপ্তানি পণ্য হচ্ছে নিট ও ওভেন পোশাক, জুতা, ওষুধ ইত্যাদি। তারপরও করোনার মধ্যে ২০২০-২১ অর্থবছরে পণ্য রপ্তানি ৩৬ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। সে বছর রপ্তানি পৌঁছায় ২ কোটি ৬৮ লাখ ডলারে। তবে যুদ্ধের কারণে ২০২১–২২ অর্থবছরে তা ২৭ শতাংশ কমে ২ কোটি ৩ লাখে নেমেছে। এর মধ্যে তৈরি পোশাক ছিল ৯৫ লাখ ডলারের। আর গত জুলাইয়ে দেশটিতে মাত্র ৪ লাখ ৪১ হাজার ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। গত বছরের জুলাইয়ে রপ্তানি হয়েছিল ১২ লাখ ৭২ হাজার ডলারের পণ্য।
রাশিয়া গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে হামলা শুরু করে। এরপর পশ্চিমা দেশগুলো এক জোট হয়ে রাশিয়ার ওপর নানামুখী নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। তারা সুইফট লেনদেনব্যবস্থা থেকে রাশিয়ার ব্যাংকগুলোকে বের করে দেয়। এ ছাড়া বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় শিপিং কোম্পানিগুলো রাশিয়ায় পণ্য পরিবহন বন্ধ রাখে। তাতে দেশটির সঙ্গে আমদানি-রপ্তানি জটিল আকার ধারণ করে। বাংলাদেশের অনেক রপ্তানিকারকের অর্থও আটকে যায়।
দেশের পোশাক রপ্তানিকারকেরা বলছেন, শুধু রাশিয়া-ইউক্রেনে রপ্তানি কমলে কোনো সমস্যা হতো না। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় দুই বাজার যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউর দেশগুলোতে যুদ্ধের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব পড়েছে। এতে বিক্রি কমে যাওয়ায় তাদের ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানগুলো নতুন ক্রয়াদেশ দেওয়া কমিয়েছে। চলমান ক্রয়াদেশেও স্থগিতাদেশ দিচ্ছে। আবার দেশেও গ্যাস-বিদ্যুতের সংকটে ভুগছে শিল্পকারখানা।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যানুযায়ী, গত অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে ৫ হাজার ২০৮ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। তার মধ্যে পোশাক খাতের হিস্যা ছিল ৪ হাজার ২৬১ কোটি ডলার। তাতে প্রবৃদ্ধি ছিল ৩৫ শতাংশ। চলতি বছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ৩৩৭ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করা হয়, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১৬ দশমিক ৬১ শতাংশ বেশি।
বর্তমানে রপ্তানিমুখী পোশাক কারখানাগুলোয় শীতের পোশাক তৈরি হচ্ছে। একই সঙ্গে আগামী বসন্ত ও গ্রীষ্মের ক্রয়াদেশ আসার সময়ও এখন। করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় গত বছর এই সময়ে ইইউ ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রচুর ক্রয়াদেশ এসেছিল। কিন্তু এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। বিজিএমইএর নেতারা জানান, গত মে-জুন মাসে শুল্কমুক্ত সুবিধা কাঁচামাল আমদানির জন্য ইউটিলাইজেশন ডিক্লারেশন (ইউডি) নেওয়ার সংখ্যা ২০২১ সালের একই সময়ের তুলনায় ১৮ শতাংশ কমেছে। একই সময়ে বিকেএমইএ থেকে ইউডি নেওয়ার সংখ্যা ১০ শতাংশ কমেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের বহুজাতিক খুচরা বিক্রেতাপ্রতিষ্ঠান ওয়ালমার্ট চলতি মাসে সারা বিশ্বের উৎপাদকের দেওয়া শত শত কোটি ডলার মূল্যের পণ্য কেনার আদেশ বাতিল করেছে। এতে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন বাংলাদেশের অনেক তৈরি পোশাকশিল্পের মালিক। বাংলাদেশি তৈরি পোশাকের অন্যতম ক্রেতা ওয়ালমার্ট।
রাশিয়ায় যেসব কারখানা পোশাক রপ্তানি করে তাদের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান তুসুকা গ্রুপ। এই শিল্পগোষ্ঠীর চেয়ারম্যান আরশাদ জামাল গত রাতে বলেন, ‘রাশিয়ায় ক্রয়াদেশ নেওয়ার ক্ষেত্রে আমরা সতর্কতা অবলম্বন করছি। ফলে স্বাভাবিক রপ্তানি কমেছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘নতুন ক্রয়াদেশ আসার হার কম। অনেক চলমান ক্রয়াদেশ ৬০ দিন পর্যন্ত স্থগিত করছে ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান। তাতে আমরা নগদ অর্থের সংকটে পড়ছি। তবে বর্তমান খারাপ সময়ে আশার কথা হচ্ছে, ক্রেতারা পণ্যের নকশা উন্নয়নের কাজ পুরোদমে চালিয়ে যাচ্ছে। বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ড এমঅ্যান্ডএস বাংলাদেশে ব্যবসা বাড়ানোর কথা জানিয়েছে। ইন্ডিটেক্সও নতুন কারখানা খুঁজছে।’