আশির দশকের গোড়ার দিকে আনুষ্ঠানিকভাবে তৈরি পোশাক রপ্তানির যুগে প্রবেশ করে বাংলাদেশ। সে সময় কাপড় আমদানি করে পোশাক রপ্তানি করতেন ব্যবসায়ীরা। জিপার, বোতাম, কার্টনসহ অন্য সরঞ্জামও আমদানি করতে হতো। সে কারণে তখন তৈরি পোশাক রপ্তানিতে মূল্য সংযোজন ছিল শুধু সেলাইয়ের মজুরি।
ধীরে ধীরে অবস্থার পরিবর্তন হতে থাকে। নতুন নতুন সুতার কল হয়। গড়ে ওঠে কাপড় তৈরির কারখানা। ডাইং-প্রিন্টিং কারখানায়ও বিনিয়োগ বাড়ে। পোশাক খাতের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম উৎপাদনেও এগিয়ে আসেন উদ্যোক্তারা। তাতে মূল্য সংযোজন বাড়তে থাকে।
গত কয়েক বছরের এক-দুটি প্রান্তিক ছাড়া বাকি প্রান্তিকগুলোতে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে মূল্য সংযোজন ঘুরেফিরে ৫১ থেকে ৬০ শতাংশের মধ্যেই ছিল। চলতি ২০২২–২৩ অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে (অক্টোবর-ডিসেম্বরে) হঠাৎ তা বেড়ে ৬৭ শতাংশে দাঁড়ায়। পণ্য রপ্তানিতে মূল্য সংযোজন বৃদ্ধি পাওয়া দেশের অর্থনীতির জন্য ভালো। কারণ, তাতে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার বড় অংশই দেশে থাকে। প্রশ্ন হচ্ছে, হঠাৎ কী এমন ঘটল যে পোশাক রপ্তানিতে দেশীয় মূল্য সংযোজন বাড়ল। আসুন সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা যাক।
‘মূল্য সংযোজন বৃদ্ধি অবশ্যই আমাদের জন্য সুখবর। হঠাৎ মূল্য সংযোজন বৃদ্ধির বড় কারণ ওই প্রান্তিকে কাপড় উৎপাদনে দেশীয় স্পিনিং মিলের সুতা বেশি ব্যবহৃত হয়েছে।’
মোহাম্মদ হাতেম, নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি
তৈরি পোশাক রপ্তানি পর্যালোচনা করে তিন মাস পরপর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। সেই প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিক, অর্থাৎ জুলাই-সেপ্টেম্বরে ১ হাজার ২৭ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়। তার মধ্যে ৪৯৮ কোটি ডলার কাঁচামাল আমদানির পেছনে ব্যয় হয়। তাতে প্রকৃত রপ্তানি দাঁড়ায় ৫২৯ কোটি ডলারে। অর্থাৎ ওই প্রান্তিকে মূল্য সংযোজনের পরিমাণ ছিল ৫১ দশমিক ৪৯ শতাংশ।
পরের প্রান্তিক, অর্থাৎ অক্টোবর-ডিসেম্বরে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে মূল্য সংযোজন বাড়ে ৬২ দশমিক ৭৯ শতাংশ। এই প্রান্তিকে ১ হাজার ২৭২ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়। এর মধ্যে কাঁচামাল আমদানিতে ব্যয়ের পরিমাণ ৪১১ কোটি ডলার। তাতে প্রকৃত রপ্তানি দাঁড়ায় ৮৬১ কোটি ডলার। তার মানে অক্টোবর-ডিসেম্বরে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে মূল্য সংযোজন দাঁড়ায় ৬৭ দশমিক ৬৯ শতাংশ।
পোশাক রপ্তানিতে মূল্য সংযোজন চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকের চেয়ে দ্বিতীয় প্রান্তিকে ১৬ দশমিক ২ শতাংশীয় পয়েন্ট বৃদ্ধির কারণ জানতে চাইলে নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, ‘মূল্য সংযোজন বৃদ্ধি অবশ্যই আমাদের জন্য সুখবর। হঠাৎ মূল্য সংযোজন বৃদ্ধির বড় কারণ ওই প্রান্তিকে কাপড় উৎপাদনে দেশীয় স্পিনিং মিলের সুতা বেশি ব্যবহৃত হয়েছে।’
মোহাম্মদ হাতেম আরও বলেন, ‘২০২১ সালের দ্বিতীয়ার্ধে দেশে সুতার দাম বেড়ে যায়। আমরা সাধারণত বাংলাদেশ ও ভারতের সুতার দাম প্রতি কেজিতে ৫০ সেন্ট পার্থক্য থাকলেই আমদানির চিন্তা করি। চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে দেশীয় সুতার দাম কমে যায়। সে কারণে আমদানিও কমে যায়। ফলে স্বাভাবিকভাবেই মূল্য সংযোজন বাড়ে।’
পোশাক খাতে আমদানিনির্ভরতা যত কমবে, মূল্য সংযোজনও তত বাড়বে। দেশীয় কারখানাগুলোও বেঁচে থাকবে।
মোহাম্মদ আলী, বিটিএমএর সভাপতি
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে ৪ হাজার ২৬১ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়। এই পরিমাণ পোশাক রপ্তানির জন্য ১ হাজার ৯৪৪ কোটি ডলারের কাঁচামাল আমদানি করতে হয়েছে। তাতে ওই অর্থবছরে পোশাক রপ্তানিতে মূল্য সংযোজন ছিল ৫৪ দশমিক ৩৭ শতাংশ।
বস্ত্রকলের মালিকদের সংগঠন বিটিএমএর তথ্যানুযায়ী, দেশে এখন সুতার কল আছে ৫১০টি। তাদের সুতা উৎপাদনের ক্ষমতা বছরে ৩৮০ কোটি কেজি। আর ছোট, মাঝারি ও বড় কাপড় তৈরির মিল রয়েছে প্রায় ২০ হাজার। তাদের বার্ষিক কাপড় উৎপাদনের সক্ষমতা ৭০০ কোটি মিটার। এ ছাড়া ডেনিম কাপড় তৈরির কারখানা আছে ৪০টি। তাদের বার্ষিক উৎপাদনক্ষমতা ৭০ কোটি মিটার ডেনিম কাপড়। এতে করে রপ্তানিমুখী নিট পোশাক খাতের সুতার চাহিদার ৮০ শতাংশ ও ওভেন পোশাক খাতের কাপড়ের চাহিদার ৬০ শতাংশ সরবরাহ করছে দেশীয় বস্ত্র খাতের কারখানা।
জানতে চাইলে বিটিএমএর সভাপতি মোহাম্মদ আলী বলেন, পোশাক খাতে আমদানিনির্ভরতা যত কমবে, মূল্য সংযোজনও তত বাড়বে। দেশীয় কারখানাগুলোও বেঁচে থাকবে।