তৈরি পোশাক আমদানিতে বিশ্বে শীর্ষস্থানে রয়েছে ইউরোপ। বিশ্বে মোট পোশাক আমদানির প্রায় এক-চতুর্থাংশ করে থাকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) দেশগুলো। এই বাজারেও ছড়ি ঘোরাচ্ছে চীনের পোশাক। চীনের পেছনেই রয়েছে বাংলাদেশ। যদিও ইইউর বাজারে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের ব্যবধান কমছে। আবার রপ্তানি বৃদ্ধির হার চীনের চেয়ে বাংলাদেশের বেশি।
আগামী কয়েক বছরের মধ্যে ইইউর বাজারে পোশাক রপ্তানিতে চীনকে টপকে বাংলাদেশ কি শীর্ষস্থানে পৌঁছাতে পারবে? এ নিয়ে দেশের তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকেরা বলছেন, ভূরাজনীতিসহ নানা কারণে চীনের পোশাক রপ্তানি কমছে। ফলে বাংলাদেশের পক্ষে শীর্ষ পোশাক রপ্তানিকারক দেশ হওয়া অসম্ভব কিছু নয়। যদিও রপ্তানির পাশাপাশি প্রতিবছর বাংলাদেশের সামনে চ্যালেঞ্জও বাড়ছে।
ইইউর বাজারে চীনকে টপকানো বাংলাদেশের পক্ষে সম্ভব। তবে সময় লাগবে। কারণ, আমরা নানামুখী চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছি। গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ছে। সামনের বছর মজুরিও বাড়বে। আবার উন্নয়নশীল দেশের কাতারে যুক্ত হলে ২০২৯ সালের পর পণ্য রপ্তানিতে অগ্রাধিকারমূলক বাজারসুবিধা (জিএসপি) পাব না আমরা।
ফজলুল হক, এমডি, প্লামি ফ্যাশনস
ইউরোস্ট্যাটের তথ্য অনুযায়ী, ইইউর বাইরের দেশগুলো থেকে ২০২২ সালের জানুয়ারি–নভেম্বর পর্যন্ত ১১ মাসে ৯ হাজার ৫১৭ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক আমদানি করেছে ইইউভুক্ত ২৭টি দেশ। তার মধ্যে ২ হাজার ৭৯৮ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে চীন।
দেশটির এই রপ্তানি আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৯ দশমিক ২৯ শতাংশ বেশি। অন্যদিকে একই সময়ে অর্থাৎ ২০২২ সালের প্রথম ১১ মাসে বাংলাদেশ থেকে ইইউতে ২ হাজার ১১৮ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি চীনের চেয়ে দ্বিগুণ—৩৮ শতাংশ।
গত বছরের প্রথম ১১ মাসে চীনের চেয়ে প্রবৃদ্ধিতে এগিয়ে থাকলেও বাংলাদেশের রপ্তানি দেশটির চেয়ে ৬৮০ কোটি ডলার কম। অবশ্য ব্যবধান আগের চেয়ে কমেছে। ২০১৮ সালে চীনের চেয়ে বাংলাদেশের রপ্তানি ১ হাজার ৮৬ ডলার কম ছিল। ২০২১ সালে সেই ব্যবধান কমে ৮৮৯ কোটি ডলারে নামে, যা ২০২২ সালে আরও কমেছে।
জানতে চাইলে নারায়ণগঞ্জের প্লামি ফ্যাশনসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ফজলুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘ইইউর বাজারে চীনকে টপকানো বাংলাদেশের পক্ষে সম্ভব। তবে সময় লাগবে। কারণ, আমরা নানামুখী চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছি। গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ছে। সামনের বছর মজুরিও বাড়বে। আবার স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বেরিয়ে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে যুক্ত হলে ২০২৯ সালের পর পণ্য রপ্তানিতে অগ্রাধিকারমূলক বাজারসুবিধা বা জিএসপি পাব না আমরা। তখন আমাদের জিএসপি প্লাসের জন্য নিজেদের যোগ্য করে গড়ে তুলতে হবে।’
ফজলুল হক আরও বলেন, চীনের জায়গায় বাংলাদেশকে নিতে হলে সব ধরনের পোশাক উৎপাদনের সক্ষমতা অর্জন করতে হবে।
এদিকে অর্থের হিসাবে চীনের চেয়ে বাংলাদেশ পোশাক রপ্তানিতে পিছিয়ে থাকলেও পরিমাণে কিছুটা এগিয়ে রয়েছে। তার মানে, চীনের চেয়ে কম দামের পোশাক রপ্তানি করছে বাংলাদেশ। গত বছরের প্রথম ১১ মাসে চীন ১২১ কোটি কেজি কাপড়ের তৈরি পোশাক ২ হাজার ৭৯৮ কোটি ডলারে রপ্তানি করে। আর বাংলাদেশ ১২২ কোটি কেজি কাপড়ের তৈরি পোশাক পোশাক ২ হাজার ১১৮ কোটি ডলার দামে রপ্তানি করেছে।
ইউরোস্ট্যাটের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের জানুয়ারি-নভেম্বর সময়ে ইইউর আমদানি করা প্রতি কেজি কাপড়ের তৈরি পোশাকের গড় মূল্য ছিল ২২ ডলার ৩৯ সেন্ট। সেখানে চীনের রপ্তানি হওয়া পোশাকের গড় মূল্য ছিল ২৩ ডলার। আর বাংলাদেশের ১৭ ডলার ২১ সেন্ট। ২০২১ সালে বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হওয়া তৈরি পোশাকের গড় মূল্য ছিল ১৫ ডলার ৩৬ সেন্ট। সেই হিসেবে গত বছর পোশাকের গড় মূল্য ১২ শতাংশ বেড়েছে।
দেশে ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকিং ও ব্রোকারেজ হাউস পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান ক্যাল বাংলাদেশের এক গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, পোশাকশ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধি, বাণিজ্যযুদ্ধ, জিরো কোভিডসহ নানা কারণে চীনের ওপর অতিনির্ভরশীলতা কমাচ্ছে ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানগুলো। ২০১৬ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ইইউর বাজারে চীনের তৈরি পোশাক রপ্তানি গড়ে ১ দশমিক ৭ শতাংশ কমেছে। তবে বাংলাদেশের রপ্তানি গড়ে ৩ দশমিক ২ শতাংশ বেড়েছে। ভিয়েতনামের পোশাক রপ্তানি বেড়েছে ৩ দশমিক ৭ শতাংশ। অবশ্য ইইউতে ভিয়েতনামের পোশাক রপ্তানি বাংলাদেশের পাঁচ ভাগের এক ভাগ। গত বছরের প্রথম ১১ মাসে ভিয়েতনাম রপ্তানি করেছে মাত্র ৪১৫ কোটি ডলারের পোশাক।
সারা বিশ্বে যে পরিমাণ পোশাক বিক্রি হয়, তার ৭৩ শতাংশ এখন কৃত্রিম তন্তুর (এমএমএফ)। বাকি ২৭ শতাংশ তুলা থেকে তৈরি সুতার। অথচ বাংলাদেশের রপ্তানি করা পোশাকের মাত্র ২৬ শতাংশ কৃত্রিম তন্তুর। এটিকেই বড় প্রতিবন্ধকতা বলছেন নিপা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক খসরু চৌধুরী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘কৃত্রিম তন্তুর পোশাকে আমরা মারাত্মকভাবে পিছিয়ে রয়েছি। বর্তমানে বেশ কিছু কারখানা কৃত্রিম তন্তুর পোশাক রপ্তানি করলেও কাঁচামালের প্রায় পুরোটাই আমদানি করতে হয়। এখানে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। না হলে কাঁচামাল আমদানি করে ইইউর বাজারে চীনকে পেছনে ফেলা সম্ভব না।’