ভারতে পোশাক রপ্তানিতে চমক দেখিয়ে চলেছে বাংলাদেশ। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে ৫৫ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করেছেন বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৫০ শতাংশ বেশি। গত ২০২১-২২ অর্থবছরের এ ছয় মাসে ৩৬ কোটি ৫৯ লাখ ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছিল। অন্যদিকে একক দেশ হিসেবে পোশাক রপ্তানি থেকে সবচেয়ে বেশি বিদেশি মুদ্রা আসা যুক্তরাষ্ট্র থেকে এই ছয় মাসে বেড়েছে মাত্র ১ শতাংশ।
গত বছরের সেপ্টেম্বরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের পর থেকেই বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাক রপ্তানিতে উল্লম্ফন দেখা যাচ্ছে। আগামী দিনগুলোতেও বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ জনসংখ্যার দেশ ভারতে পোশাক রপ্তানির এই ইতিবাচক ধারা অব্যাহত থাকবে বলে আশার কথা শুনিয়েছেন সরকারের নীতিনির্ধারক, অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী নেতারা।
তারা বলছেন, এমনিতেই ভারতে রপ্তানি বাড়ছিল। অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে গত অর্থবছরে পণ্য রপ্তানি ২ বিলিয়ন (২০০ কোটি) ডলারের মাইলফলক ছুঁয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের মধ্য দিয়ে দুই দেশের মধ্যে বিনিয়োগ ও বাণিজ্য সম্প্রসারণে নতুন মাত্রা পেয়েছে। তার ফলেই রপ্তানি বাড়ছে।
অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ভারতে ১৫ কোটি ২০ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছিলেন বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা। আগস্টে তা বেড়ে ২২ কোটি ২৪ লাখ ডলারে ওঠে। সেপ্টেম্বরে তা আরও বেড়ে ২৪ কোটি ডলারে ওঠে। অক্টোবরে রপ্তানি হয়েছে ১৭ কোটি ৬৭ লাখ ডলারের বিভিন্ন ধরনের পণ্য।
নভেম্বরে পণ্য রপ্তানি থেকে ১৭ কোটি ৭৫ লাখ ডলার আয় হয়েছে। সবশেষ ডিসেম্বরে ১৭ কোটি ১৭ লাখ ডলারের বিদেশি মুদ্রা দেশে এসেছে ভারতে পণ্য রপ্তানি থেকে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) বৃহস্পতিবার দেশভিত্তিক পণ্য রপ্তানির হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, সব মিলিয়ে চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে (জুলাই-ডিসেম্বর) পণ্য রপ্তানি থেকে ২৭ দশমিক ৩১ বিলিয়ন ডলার আয় করে বাংলাদেশ। এ সংখ্যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ১০ দশমিক ৫৮ শতাংশ বেশি।
এ আয়ের মধ্যে ২৩ বিলিয়ন ডলার বা ৮৪ দশমিক ২০ শতাংশই এসেছে তৈরি পোশাক খাত থেকে। ছয় মাসে এ খাতে প্রবৃদ্ধি হয় ১৫ দশমিক ৫৬ শতাংশ।
ইপিবির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা দেয়, জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে ভারতে পোশাক রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে সবচেয়ে বেশি। এই ছয় মাসে ভারতে ১১৪ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে, যা আলোচ্য সময়ের মোট রপ্তানি আয়ের ৪ দশমিক ১৭ শতাংশ। আর গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৭ দশমিক ৩১ শতাংশ বেশি।
ভারতে সার্বিক পণ্য রপ্তানিতে ৭ শতাংশের কিছু বেশি প্রবৃদ্ধি হলেও পোশাক রপ্তানি বেড়েছে ৫০ শতাংশ। এ ছয় মাসে ভারতে রপ্তানি আয়ের অর্ধেকেরও বেশি ৫৫ কোটি ডলার এসেছে তৈরি পোশাক থেকে। এর মধ্যে নিট পোশাক থেকে আসে ২৫ কোটি ৩১ লাখ ডলার; বেড়েছে ৫৬ দশমিক ৫৬ শতাংশ। আর ওভেন পোশাক রপ্তানি থেকে আসে ২৯ কোটি ৫৭ লাখ ডলার; প্রবৃদ্ধি হয় ৪৪ দশমিক ৮০ শতাংশ।
অন্য পণ্যের মধ্যে পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি থেকে আসে ১১ কোটি ৫৫ লাখ ৫০ হাজার ডলার। গত অর্থবছরের জুলাই-আগস্ট সময়ে এসেছিল ১০ কোটি ৩৩ লাখ ডলার; বেড়েছে ১২ শতাংশ। চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি থেকে আসে ৫ কোটি ৩৮ লাখ ৩৩ হাজার ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ে এসেছিল ৪ কোটি ২৩ লাখ ডলার।
কটন ও কটন প্রোডাক্টস থেকে এসেছে ১ কোটি ৯৫ লাখ ৭০ হাজার ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ে এসেছিল এর চেয়ে একটু বেশি ২ কোটি ১২ লাখ ডলার। প্লাস্টিক পণ্য থেকে এসেছে ৩ কোটি ২২ লাখ ৬০ হাজার ডলার। গত অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে এসেছিল ৮৮ লাখ ৭০ হাজার ডলার।
ইপিবির তথ্যে দেখা যায়, একক দেশ হিসেবে পোশাক রপ্তানি থেকে সবচেয়ে বেশি বিদেশি মুদ্রা আসে যে দেশ থেকে, সেই যুক্তরাষ্ট্র থেকে জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে ৪২৭ কোটি ৮৫ লাখ (৪ দশমিক ২৮ বিলিয়ন) ডলার আসে। প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ১ দশমিক ১১ শতাংশ।
ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে জার্মানিতে পোশাক রপ্তানি ৩ দশমিক ৫৪ শতাংশ বেড়ে ৩ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছায়। স্পেন ও ফ্রান্সে রপ্তানি যথাক্রমে ১৭ দশমিক ৬২ শতাংশ এবং ৩৩ দশমিক ০৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ১ দশমিক ৭০ বিলিয়ন ডলার এবং ১ দশমিক ৪১ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়।
অন্যদিকে এ ছয় মাসে পোল্যান্ডে রপ্তানি ১৮ দশমিক ৪৩ শতাংশ কমে। যুক্তরাজ্য এবং কানাডায় রপ্তানি যথাক্রমে ১১ দশমিক ৮৯ শতাংশ এবং ২৮ দশমিক ৪২ শতাংশ বেড়ে ২ দশমিক ৩৯ বিলিয়ন এবং ৭৭ কোটি ৬১ লাখ ডলারে পৌঁছায়।
প্রচলিত বাজারগুলো ছাড়াও অপ্রচলিত বাজারে পোশাক রপ্তানি গত অর্থবছরের একই সময়ের মধ্যে ৩২ দশমিক ১৯ শতাংশ বেড়ে ৩ দশমিক ০৫ বিলিয়ন ডলার থেকে ৪ দশমিক ০৪ বিলিয়ন ডলারে ওঠে। অপ্রচলিত বাজারের মধ্যে জাপানে রপ্তানি ৪২ দশমিক ৫৪ শতাংশ বেড়ে ৭৫ কোটি ৪৭ লাখ ডলার হয়।
পোশাক রপ্তানিকারকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, ‘এ কথা ঠিক যে, গত নভেম্বর ও ডিসেম্বরে প্রত্যাশার চেয়েও বেশি রপ্তানি আয় দেশে এসেছে। এটা যদি আমরা ধরে রাখতে পারি, তাহলে পোশাক শিল্পের জন্য খুবই ভালো হবে।’