পোশাক রপ্তানিতে এশিয়ার অন্যান্য প্রতিযোগী দেশ – ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া ও ভারতের তুলনায় বাংলাদেশই শ্রম মানদণ্ড নিয়ে কড়া সমালোচনার সম্মুখীন হচ্ছে…
শ্রমিকদের জীবননির্বাহের মজুরি দাবি থেকে শুরু করে মানবাধিকারের মতোন বিভিন্ন বিষয়ে – প্রধান প্রধান ক্রেতাদের থেকে প্রচণ্ড চাপের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প (আরএমজি); যেগুলো সমাধানের পদক্ষেপ না নিলে, দেশের সর্ববৃহৎ রপ্তানি এ খাত পড়তে পারে গভীর অনিশ্চিয়তায়।
যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাজ্য এসব বিষয়ে তাদের উদ্বেগ জানাচ্ছে; অথচ সামষ্টিকভাবে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানির ৭০ শতাংশই হয় এসব গন্তব্যে।
ন্যূনতম মজুরির দাবিতে শ্রমিকদের আন্দোলনের মধ্যে একের পর এক তাদের এসব উত্থাপিত বিষয়ে নিজস্ব প্রতিক্রিয়া জানাতে সরকার যখন ব্যতিব্যস্ত, তারমধ্যে পোশাক শিল্পেও ভবিষ্যৎ নিয়ে উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে।
পোশাক রপ্তানিতে এশিয়ার অন্যান্য প্রতিযোগী দেশ – ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া ও ভারতের তুলনায় বাংলাদেশই কেন শ্রম মানদণ্ড নিয়ে এমন কড়া সমালোচনার সম্মুখীন হচ্ছে – এসব ঘটনায় সে প্রশ্নও সামনে আসছে।
শ্রম অধিকার, উৎপাদনশীলতা ও রপ্তানিতে বৈচিত্র্য যোগ করার মতোন বিষয়গুলো অবজ্ঞা করে, দীর্ঘদিন ধরে সস্তা শ্রমকে একমাত্র শক্তির উৎস হিসেবে গ্রহণ করে– গড়ে উঠেছে দেশের এই ৪৭ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানিমুখী শিল্প।
এর আগে ২০১৮ সালে নির্ধারণ করা হয়েছিল পোশাক শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি, সে তুলনায় সর্বশেষ তা ৫৬ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে, যা আগামী ১ ডিসেম্বর থেকে কার্যকর করা হবে। কিন্তু, তারপরেও নতুন মজুরি কাঠামোকে আঞ্চলিক প্রতিযোগীদের চেয়ে যথেষ্ট কম বলেই মনে করছে বেশকিছু শ্রম অধিকার গোষ্ঠী।
তারা বলছে, মূল্যস্ফীতির সাথে সমন্বয় করলে দেখা যায়, বাংলাদেশে মজুরি বৃদ্ধি আসলে সামান্যই রয়ে গেছে। সে তুলনায়, মূল্যস্ফীতির সাথে সামঞ্জস্য রাখতে বছরে গড়ে ৫ শতাংশ হারে ন্যূনতম মজুরি বাড়ায় ভিয়েতনাম। যেখানে দেশটির বার্ষিক মূল্যস্ফীতি হার প্রায় ৪ শতাংশের কাছাকাছি থাকছে।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান– সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মুস্তাফিজুর রহমান টিবিএসকে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের শ্রম খাতের উন্নতি সাধনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আহ্বান জানিয়ে আসলেও, আমরা এসব উদ্বেগ নিরসনকে অগ্রাধিকার দিতে ব্যর্থ হয়েছি।’
তিনি বলেন, ‘রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলগুলোয় (ইপিজেড) শ্রমিক ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা, শ্রমিক সংগঠন তৈরির প্রক্রিয়াকে সহজতর করাসহ তাদের বিভিন্ন কনসার্নের জায়গা আমরা অবহেলা করেছি।’
এই প্রেক্ষাপটে, শ্রমিক অধিকার ক্ষুণ্ণকারীদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার নতুন যে হুঁশিয়ারি দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র মূলত সে বিষয়ে উদ্বেগ ব্যক্ত করে মুস্তাফিজুর বলেন, বাংলাদেশ এতে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হতে পারে। একে যথেষ্ট গুরুত্বের সাথে নিতে হবে।
প্রসঙ্গত, গত ৬ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি জে ব্লিঙ্কেন বলেন, বিশ্বজুড়ে যারা শ্রমিক ইউনিয়নের নেতা, শ্রমিক অধিকারের পক্ষের কর্মী ও শ্রমিক সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে হুমকি ও ভয়ভীতি প্রদর্শন ও আক্রমণ করবে, তাদেরকে জবাবদিহির আওতায় আনা হবে।
@পদক্ষেপের আহ্বান কি অবহেলিত হচ্ছে?
বৈশ্বিক বিভিন্ন অধিকার গোষ্ঠী, সংস্থা ও সরকারের তরফ থেকে বাংলাদেশের ওপর চাপ দেওয়া হচ্ছে। এরমধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চাপটা আসে যুক্তরাষ্ট্র থেকে।
গত ১৬ নভেম্বর, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন তার বক্তব্যে বাংলাদেশের পোশাক শ্রমিক অধিকার কর্মী কল্পনা আক্তারের নাম উল্লেখ করেন এবং তার মতো অধিকারকর্মীদের সুরক্ষায় যুক্তরাষ্ট্র পাশে থাকবে বলেও অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন।
তার আগের দিন, জেনেভা-ভিত্তিক বৈশ্বিক অধিকার গোষ্ঠী ইন্ডাস্ট্রিঅল জানায়, গত ৯ নভেম্বর ঘোষিত ন্যূনতম মজুরি ‘শোচনীয়-রকম অপর্যাপ্ত এবং এর মাধ্যমে শ্রমিকদের দারিদ্র্য সীমার নিচেই রাখা হয়েছে।’
তাদের স্থানীয় অঙ্গসংগঠনও ঘোষিত ন্যূনতম মজুরি পুনঃপর্যালোচনার আহ্বান এবং পোশাক শ্রমিক ও শ্রমিক নেতাদের গণহারে গ্রেপ্তার বন্ধের আহ্বান জানায়।
ফেয়ার ওয়ার, অ্যামফরি, এথিক্যাল ট্রেডিং ইনিশিয়েটিভ (ইটিআই), ফেয়ার লেবার অ্যাসোসিয়েশন এবং মোন্ডিয়াল এফএনভি প্রধানমন্ত্রীকে দেওয়া এক চিঠিতে বলেছে, নতুনভাবে নির্ধারিত ন্যূনতম মজুরি শ্রমিকদের মৌলিক চাহিদা পূরণ এবং তাদের মানসম্মত জীবনধারণের জন্য যথেষ্ট নয়।
যৌথভাবে লেখা ওই চিঠিতে তারা বলেছে, ‘প্রধান প্রধান পোশাক উৎপাদনকারী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশেই বৈধ ন্যূনতম মজুরি ও জীবননির্বাহের মজুরির মধ্যে ব্যবধান সর্বোচ্চ।’ যা তৈরি পোশাকের বাংলাদেশের পোশাকখাতের আন্তর্জাতিক শ্রম মানদণ্ড প্রতিপালনের ক্ষেত্রে বড় চ্যালেঞ্জ এবং নির্ভরযোগ্য আন্তর্জাতিক সরবরাহকারী হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান ধরে রাখাকেও প্রতিকূলতার মুখে ফেলেছে।
তাদের এই উদ্বেগের যথেষ্ট গুরুত্ব আছে, কারণ চিঠিতে সইকারী সংস্থাগুলো প্রায় ২,৫০০ আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড, খুচরা বিক্রেতা, সরবরাহকারী ও শ্রমিক সংগঠনের প্রতিনিধিত্ব করে। বাংলাদেশের প্রায় ২,৯০০ কারখানার সাথেও তাদের সম্পর্ক আছে।
এদিকে সম্প্রতি বাংলাদেশ সফর করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের এভ্রিথিং বাট আর্মস (ইবিএ) বাণিজ্য নীতির পর্যালোচনাকারী মিশন। তারাও জানিয়েছে, ইবিএ সুবিধা পাওয়া অব্যাহত রাখতে এবং ভবিষ্যতে ইউরোপের বাজারে জিএসপি সুবিধা পেতে হলে বাংলাদেশকে শ্রম ও মানবাধিকারের বিষয়ে আরও কাজ করতে হবে।
এ মাসের শেষদিকে প্রকাশিত হওয়ার কথা ইইউ’র জিএসপি প্রতিবেদন, যেখানে মিশনের পর্যালোচনার প্রতিফলন থাকবে।
উদ্বেগের জায়গাগুলো অবশ্যই নিরসন করতে হবে, বলছেন বিশ্লেষকরা
শুধুমাত্র আন্তর্জাতিক চাপের কারণেই নয়, বরং বাংলাদেশের শ্রমিকদের সার্বিক কল্যাণ নিশ্চিত করতেও জরুরি ভিত্তিতে শ্রম অধিকারের ক্ষেত্রে থাকা বিভিন্ন সমস্যা জরুরিভাবে সমাধানের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন অর্থনীতিবিদ মুস্তাফিজুর রহমান।
এক্ষেত্রে সাম্প্রতিক সময়ে ৫৬ শতাংশ মজুরি বাড়ানোর উদ্যোগটি একটি অগ্রবর্তী পদক্ষেপ হতে পারে, একে যৌক্তিক মনে করছে মলিকপক্ষ ও সরকার।
তবে এটি আরো বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে বলে মনে করেন তিনি। মুস্তাফিজ বলেন, “দেশের অর্থনীতি বড় হচ্ছে, নোমিনাল জিডিপি সময়ে বছরে গড়ে ১৩ শতাংশের উপরে বাড়ছে। কম্পাউন্ডিং রেট এ হিসাব করলে ৫ বছরে তা ৭০ শতাংশের বেশি হয়। অর্থনৈতিক উন্নয়নের সাথে তাল মিলিয়ে শ্রমিকরা তাদের মজুরি বৃদ্ধির প্রত্যাশা করতেই পারে।”
“সব দায়িত্ব মালিকপক্ষের ওপর না চাপিয়ে– শ্রমিকদের বাসস্থান, খাদ্য রেশনের মতো বিষয়গুলোর দায়িত্ব নিতে পারে সরকার। একইভাবে, বিদেশি বায়ারদেরও এক্ষেত্রে সহযোগী ভূমিকা রাখতে হবে”- যোগ করেন তিনি।
অর্থনীতিবিদ ও পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই)- এর নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘আন্তর্জাতিক স্টেকহোল্ডাররা যেসব বিষয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে, দ্রুত ও কার্যকরভাবে অবশ্যই সেগুলো সমাধানের উদ্যোগ নিতে হবে। শ্রমিকদের উপর কঠোর হওয়া অগ্রহণযোগ্য এবং তা এড়িয়ে চলতে হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের সতর্কবার্তার বিষয়ে তিনি বলেন, “অতীতেও দেশের পোশাক খাতের উপর চাপ ছিল, তবে এবারের মত এত হাই-লেভেলের চাপ ছিল না, বিশেষত যখন সামনেই দেশের জাতীয় নির্বাচন।”
পরিস্থিতি ক্রমশ জটিল হচ্ছে এমন মন্তব্য করে আহসান এইচ মনসুর সতর্ক করে বলেন, সামনে আরও কঠিন সময় আসতে চলেছে। ‘আমাদের দ্রুত যুক্তরাষ্ট্র, ইইউ’র সাথে আলোচনায় বসতে হবে।”
গবেষণা সংস্থা– রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্ট (র্যাপিড)- এর চেয়ারম্যান ড. এম এ রাজ্জাক বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রের নতুন সিদ্ধান্তে পোশাক রপ্তানিকারকদের উপর একটা সাইকোলজিক্যাল (মানসিক) চাপ তৈরি হবে, কারণ ইইউ-ও তাদের অনুসরণ করে থাকে, ঐতিহাসিকভাবেও সেটা দেখা গেছে।”
সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্ট- এর সভাপতি রাজেকুজ্জামান রতন টিবিএসকে বলেন, “শ্রমিকের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হলে ভালো মজুরি লাগবে। নতুন যে ১১৩ ডলার মজুরি ঘোষণা করা হলো, তারপরেও বাংলাদেশে প্রতিযোগী দেশগুলোর মধ্যে প্রায় সবার নিচে। যেখানে ভারতে ১৭১ ডলার, শ্রীলঙ্কায় ১৬০ ডলার, নেপাল প্রায় ১৫০ ডলার এবং কম্বোডিয়ায় ২০০ ডলার। তাহলে আমাদের উদ্যোক্তারা পারেন না কেন?”- প্রশ্ন রাখেন তিনি।
শিল্পসংশ্লিষ্টরা যা বলছেন…
নিট পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারকদের সমিতি- বিকেএমইএ’র সাবেক সভাপতি ফজলুল হক মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের এই ঘোষণায় আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই, তবে সতর্ক হতে হবে। পাশাপাশি বাংলাদেশের শ্রম মানদণ্ড উন্নয়নে চেষ্টাও অব্যাহত রাখতে হবে।
তিনি বলেন, “বাংলাদেশের ওভারঅল লেবার স্ট্যান্ডার্ড প্রতিযোগী দেশগুলো যেমন: ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, চীন, ইন্ডিয়া, পাকিস্তানের তুলনায় ভালো।”
“ইনফ্লেশন (মূল্যস্ফীতি) বিবেচনায় মজুরি বৃদ্ধির দাবি শ্রমিকদের থাকতে পারে। কিন্তু, ইন্ডাস্ট্রির তার সাথে মানিয়ে নেওয়ার ক্যাপাসিটি রয়েছে কিনা, তাও বিবেচনায় নিতে হবে”- যোগ করেন তিনি।
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারকদের শীর্ষ সংগঠন- বিজিএমইএ’র সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, “বাংলাদেশ আইএলও’র কনভেনশন মেলে চলতে সম্পূর্ণ অঙ্গীকারবদ্ধ এ বিষয়ে আমরা ইইউ ও যুক্তরাষ্ট্রকে নিশ্চয়তা দিতে চাই। বর্তমানে সম্পূর্ণ বিষয়টি আমরা ভালোভাবে পর্যালোচনা করছি, এবং আইএলও, বায়ার, ব্র্যান্ডগুলো ও ইইউ, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে যেকোন সমস্যা সমাধানে উন্মুক্ত সংলাপে অংশ নেব।”
কারখানা পর্যায়ে উৎপাদনশীলতার প্রতি দীর্ঘদিনের অবহেলা থাকায় বিষয়টি স্বীকার করেন অন্যতম পোশাক রপ্তানিকারক ডিবিএল গ্রুপের ভাইস প্রেসিডেন্ট এম এ রহিম ফিরোজ বলেন, উৎপাদন খরচ বাড়তে থাকায় এখন কারখানাগুলো উৎপাদনশীলতা বাড়ানোকে গুরুত্ব দিতে বাধ্য হচ্ছে।
পরিস্থিতির গুরুত্ব ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, “(বিশ্ববাজারে) প্রতিযোগী থাকার চাপ রয়েছে, আর সেটা আমাদের উৎপাদনশীলতায় উন্নতি আনার দিকে মনোযোগ দিতে বাধ্য করেছে।”
শিল্পসংশ্লিষ্টরা দাবি করেন, বাংলাদেশের পোশাক শিল্প নজিরবিহীন মাত্রায় শ্রমিক বান্ধব পরিবেশ ও অন্যান্য কমপ্ল্যায়েন্স অর্জন করেছে; এবং বায়ার, ব্র্যান্ডসমূহ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাথে কার্যকর যোগাযোগের মাধ্যমে সেটি তাদের কাছে তুলে ধরতে হবে।