একটি সংকটাপন্ন পরিস্থিতি মোকাবিলা করে তৈরি পোশাক খাত ঘুরে দাঁড়াচ্ছে বলে মনে করছে ব্যবসায়ীরা। বিশেষ করে পশ্চিমা বিশ্বে মূল্যস্ফীতি কমে আসা, বৈশ্বিক খুচরা পর্যায়ের দোকানগুলো বিভিন্ন উৎসবে তাদের শীতকালীন পোশাকের মজুত বিক্রি করে ফেলায় সামনে তৈরি পোশাকের ক্রয়াদেশ বাড়তে পারে বলে মনে করছেন তারা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, আন্তর্জাতিক সমস্যা কাটিয়ে উঠে চলতি বছরেই পোশাক খাতের ঘুরে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা রয়েছে। বহির্বিশ্বের কাছে আমাদের জাতীয় নির্বাচন একটি বড় বিষয় ছিল। সেটি কাটিয়ে উঠেছে বলে মনে করেন তারা।
পোশাক খাত সংশ্লিষ্ট এবং বৈশ্বিক ক্রেতাদের প্রতিনিধিরা জানান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যের মতো রপ্তানি গন্তব্যের প্রধান দেশগুলোর খুচরা পর্যায়ের দোকানগুলো ব্ল্যাক ফ্রাইডে, সাইবার মানডে, ক্রিসমাস ডে ও বক্সিং ডের মতো বিভিন্ন উৎসবের কল্যাণে নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে প্রচুর পণ্য বিক্রি করতে পেরেছে।
জানতে চাইলে বিজিএমএ সাবেক সভাপতি সালাম মুর্শেদী বলেন, তিনটি প্রধান কারণে আমাদের পোশক খাতে সঙ্কটাপন্ন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। তিনি বলেন, করোনা মহামারি কাটিয়ে উঠতে না উঠতে ইউক্রেইন-রাশিয়া যুদ্ধ বাধে। এর পরপরই ইসরাইল-ফিলিস্তিন যুদ্ধ আন্তর্জাতিক বাজারকে আরো অস্থির করে তোলে। সালাম মুর্শেদী বলেন, বর্তমানে লোহিত সাগরে বাণিজ্যিক জাহাজে ইয়েমেনের বিদ্রোহী হুথি গোষ্ঠীর ক্রমাগত হামলায় এশিয়া থেকে ইউরোপ-আমেরিকাগামী জাহাজগুলো বিকল্প পথ ব্যবহার করছে। ঘুরপথে জাহাজ পরিচালনা করতে গিয়ে লাগছে বাড়তি সময় ও খরচ। প্রায় ৫০ শতাংশ বেড়ে গেছে পণ্য পরিবহন খরচ। বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী সমুদ্র পথে ভেঙে পড়েছে সাপ্লাই চেইন। বিশ্ব অর্থনীতিতে পড়ছে নেতিবাচক প্রভাব। যা আমাদের পোশাক রপ্তানিকে বার বার বাধাগ্রস্ত করছে। তবে দেশের জাতীয় নির্বাচন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পজিটিভ প্রভাব ফেলেছে বলে মনে করছেন তিনি। এ ব্যবসায়ী নেতা বলেন, আমাদের জাতীয় নির্বাচন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে একটি বড় প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছে।
তিনি বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে একটি বড় চাপ ছিল। বর্তমান সরকার সেখানে সফলতার সঙ্গেই সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দিয়েছে। আন্তর্জাতিক মহলও সন্তুষ্ট হয়েছে। তারা নিয়মিত শুভেচ্ছা বার্তা পাঠাচ্ছে। তবে যতটুকু সমস্যা রয়েছে- সেখানে সরকারের নীতি সহায়তার হাত বাড়ানোর অনুরোধ জানিয়েছেন তিনি।
ইউএস সেন্সাস ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, গত এক বছরে তৈরি পোশাকের দোকানগুলোতে বিক্রি ধারাবাহিকভাবে ঊর্ধ্বমুখী ছিল। এ বিক্রি ২০২৩ সালের জানুয়ারির মাসিক ১৩ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে নভেম্বরে ২১ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। গত বছরের ডিসেম্বরে মার্কিন দোকানগুলোতে মাসিক বিক্রি হয়েছিল আনুমানিক ২৯ বিলিয়ন ডলার যা ২০২২ সালের ডিসেম্বরের তুলনায় ৯ শতাংশ বেশি।
ভারতীয় মার্কেট গবেষণা ফার্ম ওয়াজির অ্যাডভাইজরের মতে, ইয়ার-টু- ডেট হিসেবে ২০২৩ সালে পোশাক বিক্রয়ের পরিমাণ ২০২২ সালের তুলনায় ৬ শতাংশ বেশি ছিল। বৈশ্বিক থিংক ট্যাংক দ্য কনফারেন্স বোর্ড মার্কিন ভোক্তাদের মতে, ব্যয়ের অভিপ্রায় এবং মুদ্রাস্ফীতি, স্টকের দাম ও সুদহার নিয়ে তাদের দৃষ্টিভঙ্গির মাসিক মূল্যায়ন পরিচালনা করে। এটির সর্বশেষ সমীক্ষা অনুসারে, ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে আগের মাসের ১০২দশমিক শূন্য থেকে বেড়ে মার্কিন ভোক্তা আস্থা সূচক ১১০ দশমিক ৭ হয়েছে। আর এ সূচক ২০২২ সালের ডিসেম্বরের সূচকের চেয়েও কিছুটা বেশি। এদিকে যুক্তরাজ্যের বাজারেও খুচরা পর্যায়ে তৈরি পোশাকের বিক্রি বাড়ার কথা জানা গেছে।
চলতি বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিক থেকে বৈশ্বিক ক্রেতাদের কাছ থেকে পোশাকের অর্ডার বাড়বে বলে আশা প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সভাপতি ফারুক হাসান। ইউরোপ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মূল্যস্ফীতি হ্রাসের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিগত এক বছরে ব্র্যান্ডগুলো সফলভাবে তাদের মজুত বিক্রি শেষ করায় বাংলাদেশ থেকে তাদের পোশাকের সোর্সিং বাড়াবে বলে আশা করা হচ্ছে। কিছু ক্রেতা ইতোমধ্যেই আমাদের রপ্তানিকারকদের সঙ্গে অর্ডার বাড়াতে আলোচনা শুরু করছে।
আন্তর্জাতিকভাবে মূল্যস্ফিতির অস্থিরতা কমে আসবে বলে মনে করেন বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সহসভাপতি ফজলে শামীম এহসান। তিনি বলেন, ২০২৪ সালে অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (ওইসিডি) অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোর প্রত্যাশিত ১ দশমিক ২ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধিসহ মূল্যস্ফীতি ৩ দশমিক ২ শতাংশে হ্রাস পাবে বলে আশা করা হচ্ছে। আমরা ২০২৪ সালের দ্বিতীয় প্রান্তিকে দেশের পোশাক রপ্তানি বাড়তির পূর্বাভাস দেখতে পাচ্ছি। তিনি আরো মনে করেন, মুদ্রাস্ফীতি কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভোক্তাদের পোশাকক্রয়ে আরো বেশি ব্যয় করার সম্ভাবনা রয়েছে।
নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নতি : আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) নতুন এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে- তৈরি পোশাক খাতে পেশাগত নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নতিতে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়েছে। তবে অন্যান্য কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা বাড়ানো এবং সহিংসতা ও হয়রানির বিরুদ্ধে সুরক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি রয়েছে। আইএলওর প্রতিবেদনের শিরোনাম ‘পেশাগত নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থার মাধ্যমে কর্মক্ষেত্রে সহিংসতা ও হয়রানি প্রতিরোধ এবং মোকাবিলা’। গত ২৪ জানুয়ারি জেনেভায় আইএলও সদর দপ্তরে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে গবেষণার ফলাফল নিয়ে আলোচনা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে পেশাগত নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য (ওএসএইচ) ব্যবস্থা প্রাথমিকভাবে শ্রম আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। কর্মক্ষেত্রে স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা ও মর্যাদা উন্নীত করতে বাংলাদেশ সরকার জাতীয় পেশাগত নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যনীতি ২০১৩ এবং গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতি ২০১৫ গঠন করেছে। শ্রম আইনের ১০৯ ধারা কর্মক্ষেত্রে নারীদের সুরক্ষা দেয়। এই আইন বলছে- সম্মতি ছাড়া কোনো নারীকে রাতে কাজ করতে বাধ্য করা যাবে না। কর্মক্ষেত্রে কোনো নারীর শালীনতা বা সম্মানে আঘাত করা হয়- এমন কোনো আচরণ থেকে বাধা দেয় এই আইনের ৩৩২ ধারা। প্রতিবেদনটিতে শ্রম আইনে পরিবর্তনের ফলে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ ও নির্মূলে বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা তুলে ধরে প্রশংসা করা হয়েছে। ২০০৯ সালে হাইকোর্ট বিভাগ সরকারি-বেসরকারি সব কর্মক্ষেত্র ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য যৌন হয়রানি সংক্রান্ত নির্দেশিকা জারি করে। পেশাগত নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য কাঠামো কর্মক্ষেত্রে সহিংসতা ও হয়রানি প্রতিরোধে কার্যকর উপায় হিসেবে প্রমাণিত হচ্ছে বলে আইএলওর ওই প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
অনলাইন বাজারেও বাড়ছে পোশাক রপ্তানির সম্ভাবনা : বিজিএমইএ ও লাইটক্যাসলের যৌথভাবে প্রকাশিত গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, আগামী ২০২৭ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও আফ্রিকার অনলাইন বাজারে তৈরি পোশাক বিক্রি করে বাংলাদেশের বাড়তি ৪৮ কোটি ৯০ লাখ ডলার আয়ের সম্ভাবনা আছে। গত বৃহস্পতিবার প্রকাশিত গবেষণায় এ তথ্য জানায়। প্রকাশিত গবেষণায় বলা হয়- তবে উল্লেখ করা সময়ের মধ্যে বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মের জন্য ফ্রেমওয়ার্ক বাস্তবায়ন করতে হবে। ‘ইস্টাবলিশিং এ ভার্চুয়াল মার্কেটপ্লেস ফর বাংলাদেশি অ্যাপারেলস’ শীর্ষক গবেষণায় আরো বলা হয়েছে, ২০২৬ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও আফ্রিকার অনলাইন পোশাকের বাজার দাঁড়াবে ৩০৮ বিলিয়ন ডলারে।
বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) পরামর্শক প্রতিষ্ঠান লাইটক্যাসলের সহযোগিতায় ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স করপোরেশন (আইএফসি) এ গবেষণা পরিচালনা করেছে। গবেষণা অনুসারে, ২০২৭ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের অনলাইন পোশাক বাজারের শূন্য দশমিক ২০ শতাংশ, ইউরোপীয় ইউনিয়নে শূন্য দশমিক ১০ শতাংশ ও আফ্রিকায় শূন্য দশমিক ৭৫ শতাংশ পেতে পারে বাংলাদেশ। sources : sherpurnews