Home বাংলা নিউজ বড় হচ্ছে চামড়া ও চামড়াপণ্যের বিশ্ববাজার, পিছিয়ে বাংলাদেশ

বড় হচ্ছে চামড়া ও চামড়াপণ্যের বিশ্ববাজার, পিছিয়ে বাংলাদেশ

চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের বৈশ্বিক বাজার প্রতিবছরই বড় হচ্ছে। তবে দেশের মধ্যেই বিপুল পরিমাণ কাঁচা চামড়ার সরবরাহ থাকলেও বাংলাদেশ রপ্তানি বাড়ানোর সুযোগ কাজে লাগাতে পারছে না। সাত বছর ধরে এই খাতের রপ্তানি একই জায়গায় ঘুরপাক খাচ্ছে। একদিকে দাম না পাওয়ায় প্রতিবছর কোরবানির পশুর চামড়া নষ্ট হচ্ছে, অন্যদিকে চামড়াপণ্য রপ্তানির জন্য বছরে ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকার চামড়া আমদানি করতে হচ্ছে। শুধু হেমায়েতপুরের চামড়াশিল্প নগরের দূষণের কারণে এগোতে পারছে না বাংলাদেশের চামড়াশিল্প।

বিশেষজ্ঞ ও খাত–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, সাভারের হেমায়েতপুরের ২০০ একর জমির ওপর পরিকল্পিত চামড়াশিল্প নগর বাস্তবায়নে ইতিমধ্যে ২১ বছর পার করেছে সরকার। চামড়াশিল্প নগরে জমি বরাদ্দ পেয়েছিল ১৫৪টি ট্যানারি। তার মধ্যে উৎপাদনে আছে ১৪২টি। কিন্তু এখন পর্যন্ত চামড়াশিল্প নগরের কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার (সিইটিপি) পুরোপুরি কার্যকর করা যায়নি। এতগুলো বছরেও কঠিন বর্জ্য ফেলার স্থায়ী জায়গা বা ডাম্পিং ইয়ার্ডের কাজ শুরু হয়নি। ফলে বুড়িগঙ্গার পর এখন ধলেশ্বরী নদীও দূষণের শিকার হচ্ছে।

চামড়াশিল্প নগর পরিবেশবান্ধব করতে না পারার ব্যর্থতার মাশুল দিচ্ছে সম্ভাবনাময় চামড়াশিল্প খাত। রপ্তানি বৃদ্ধি না পাওয়ায় কাঁচা চামড়ার দামেও ধস নেমেছে—এমন দাবি করে চামড়াশিল্পের ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিশ্বের বড় ব্র্যান্ডের কাছে বেশি দামে চামড়া বা চামড়াপণ্য বিক্রি করতে হলে এলডব্লিউজি সনদ থাকতে হয়। শিল্পনগরের দূষণ বন্ধ না হওয়ায় সেই সনদের জন্য ট্যানারিগুলো আবেদন করতে পারছে না। বাধ্য হয়ে কমপক্ষে অর্ধেক দামে চীনাদের কাছে চামড়া রপ্তানি করতে হয়। 

এলডব্লিউজি বা লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপ একটি বৈশ্বিক ব্যবস্থা। চামড়াপণ্য উৎপাদনে ইতিবাচক সামাজিক ও পরিবেশগত দায়িত্বশীল ভূমিকাকে উৎসাহিত করা এই উদ্দেশ্য।

চামড়াশিল্প নগরের বেহাল পরিস্থিতির উন্নতি না হলেও সরকার এই খাতের রপ্তানি বাড়াতে চায়। তারই অংশ হিসেবে গত মার্চে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানিতে উৎসে কর ১ শতাংশ থেকে কমিয়ে দশমিক ৫০ শতাংশ করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এ ছাড়া চামড়াশিল্পের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়নের জন্যও আলাদা করে একটি কর্তৃপক্ষ করার উদ্যোগ নিয়েছে শিল্প মন্ত্রণালয়। 

জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রথম আলোকে বলেন, পরিবেশগত মানদণ্ডের চ্যালেঞ্জের কারণে দেশের কাঁচা চামড়া ও চামড়া পণ্যের রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। চামড়াশিল্প নগরের বর্তমান সিইটিপি দিয়ে এলডব্লিউজি সনদ অর্জন সম্ভব নয়। এটি খুবই দুর্ভাগ্যজনক। তাই সিইটিপি ব্যবস্থাকে নতুনভাবে ঢেলে সাজাতে হবে। 

চামড়া ও চামড়া পণ্যের রপ্তানির চিত্র 

করোনাকাল বাদ দিলে চামড়া পণ্যের বৈশ্বিক বাজার যে প্রতিবছর বড় হচ্ছে, তা প্রায় সব পণ্যবাজার গবেষণা ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান বলছে। তেমনই দুটি প্রতিষ্ঠান—যুক্তরাজ্যভিত্তিক টেকনাভিওর এবং যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সিএমআই কনসালটিংয়ের সমীক্ষা অনুযায়ী, ২০১৬ সালে বিশ্বে চামড়াজাত পণ্য, অর্থাৎ জুতা, স্যান্ডেল, ব্যাগ ইত্যাদির বাজারের আকার ছিল প্রায় ২১ হাজার ৭৪৯ কোটি ডলারের। চলতি বছর সেটি বেড়ে ২৮ হাজার ২৭০ কোটি ডলারে দাঁড়াবে। তার মানে গত আট বছরে বাজার বড় হয়েছে প্রায় ৩০ শতাংশ। ২০৩৩ সালে এই বাজারের আকার বেড়ে ৫৫ হাজার ২৯০ কোটি ডলারে গিয়ে দাঁড়াবে, এমন পূর্বাভাস রয়েছে।

বৈশ্বিক বাজার বড় হলেও এর সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের রপ্তানি বাড়েনি। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী, গত ২০১৬-১৭ অর্থবছরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানি হয়েছিল ১২৩ কোটি ডলার। তার মধ্যে চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানি ছিল ১০০ কোটি ডলার। পরের টানা তিন বছর রপ্তানি কমেছে। মাঝে দুই বছর কিছুটা বাড়লে গত ২০২২-২৩ অর্থবছর রপ্তানি আবার কমেছে। গত অর্থবছর ১২২ কোটি ডলারের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি হয়। এর মধ্যে চামড়াপণ্য ছিল ১১০ কোটি ডলারের। আর চলতি অর্থবছরের ১১ মাসে (জুলাই-মে) চামড়া পণ্যের রপ্তানি ছিল ৮৩ কোটি ডলার।

বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের হিস্যা খুবই নগণ্য হলেও অন্য দেশগুলো পিছিয়ে নেই। ভিয়েতনাম ২০২৩ সালে ২ হাজার ৪০০ কোটি ডলারের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি করে। একই অর্থবছরে ভারতের রপ্তানি ছিল ৫২৮ কোটি ডলার। তার মানে বাংলাদেশের চেয়ে ভিয়েতনাম ১৯ এবং ভারত ৪ গুণ বেশি রপ্তানি করছে।

এলডব্লিউজি ট্যানারি কম দেশে

২০০৫ সালে নাইকি, অ্যাডিডাস ও টিম্বারল্যান্ডের মতো কয়েকটি বৈশ্বিক ব্র্যান্ড ও জুতা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান মিলে এলডব্লিউজি গঠন করে। পরিবেশ সুরক্ষায় জোর দিয়ে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের উৎপাদন নিশ্চিত করাই সংস্থাটির লক্ষ্য। বর্তমানে বিশ্বে এক হাজারের বেশি ব্র্যান্ড ও সরবরাহ খাতের প্রতিষ্ঠান এলডব্লিউজির সদস্য।

সংস্থাটির ওয়েবসাইটের তথ্যানুযায়ী, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের চামড়া খাতের ১ হাজার ২৮৫টি প্রতিষ্ঠান এলডব্লিউজির সনদ পেয়েছে। এই সংস্থার সনদ পাওয়া সবচেয়ে বেশি কারখানা রয়েছে ইতালিতে, ২৫৪টি। তারপর ভারতে ২৫১টি ও চীনে ২০৬টি সনদ পাওয়া কারখানা আছে। পাকিস্তানে এলডব্লিউজির সনদ পাওয়া ট্যানারির সংখ্যা ৪৫।

দেশে চামড়া খাতের সাতটি প্রতিষ্ঠান এখন পর্যন্ত এলডব্লিউজি সনদ পেয়েছে। সেগুলো হচ্ছে এপেক্স ফুটওয়্যার, রিফ লেদার, এবিসি লেদার, সুপারেক্স লেদার, সাফ লেদার, সিমোনা ট্যানিং এবং অস্টান লিমিটেড। এর মধ্যে তিনটি কারখানা কাঁচা চামড়া থেকে ফিনিশড চামড়া উৎপাদন করে। 

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, হেমায়েতপুরের চামড়াশিল্প নগরের দূষণ বন্ধ না হওয়ায় সেখানকার কোনো ট্যানারিকে সনদ দিতে নিরীক্ষা (অডিট) না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এলডব্লিউজি কর্তৃপক্ষ। তবে সেখানকার কোনো ট্যানারি যদি নিজস্ব ইটিপি স্থাপন করে, তাহলে তারা নিরীক্ষা করবে। তারই অংশ হিসেবে চামড়াশিল্প নগরের সিমোনা ট্যানিং এলডব্লিউজি সনদ পেয়েছে। 

কাঁচা চামড়ার দাম কম

কোরবানির পর চামড়ার বাজারে একটি গরুর কাঁচা চামড়ার দাম গতবারের তুলনায় ঢাকায় ৫০-১০০ টাকা বৃদ্ধি পায়। তারপরও এবার সরকার নির্ধারিত দরের চেয়ে কমপক্ষে ২৭৫-৩০০ টাকা কমে বিক্রি হয়েছে একেকটি চামড়া। ঈদের দিন পুরান ঢাকার পোস্তায় বড় ও মাঝারি আকারের গরুর কাঁচা চামড়া সর্বোচ্চ ৮০০-৯০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। ঢাকার বাইরে দাম ছিল আরও কম। অন্যদিকে ছাগলের চামড়া কিনতে অনীহা দেখিয়েছেন আড়তদারেরা। ছাগলের চামড়া ফেলে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। 

ট্যানারিশিল্প মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) নেতারা গত বুধবার জানান, এবার প্রায় পাঁচ লাখ কাঁচা চামড়া নষ্ট হয়েছে, যার বেশির ভাগই ছাগলের। আর আনুমানিক ৯০ লাখ চামড়ায় লবণ যুক্ত করা হয়েছে।

সর্বশেষ ২০১৩ সালের কোরবানির সময় গরুর চামড়ার দাম ছিল বর্গফুটপ্রতি ৮৫-৯০ টাকা। এরপর চামড়ার দাম কমতে থাকে। ২০১৯ সালে কোরবানির পশুর চামড়ার দামে বড় ধরনের ধস নামে। ন্যূনতম দাম না পেয়ে দেশের অনেক অঞ্চলে চামড়া সড়কে ফেলে ও মাটিতে পুঁতে দেওয়ার ঘটনা ঘটে। তাতে প্রায় ২৪২ কোটি টাকার চামড়া নষ্ট হয়। 

দাম না পেয়ে দেশে চামড়া নষ্ট হওয়ার ঘটনা ঘটলেও বিদেশ থেকে চামড়া আমদানি বাড়ছে। ২০১৮ সালে প্রায় ৯০০ কোটি টাকার চামড়া আমদানি হয়েছিল। এনবিআরের তথ্যানুযায়ী, গত বছর ১ হাজার ৬৪৬ কোটি টাকায় ১১ হাজার ৭১৮ টন বিভিন্ন ধরনের চামড়া আমদানি করে বিভিন্ন চামড়াপণ্য রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান। 

শিল্পনগরের উন্নয়ন কীভাবে 

১৯৫১ সালের ৩ অক্টোবর এক গেজেটের মাধ্যমে ভূমি অধিগ্রহণ করে সরকার নারায়ণগঞ্জ থেকে চামড়াশিল্পকে ঢাকার হাজারীবাগে এনেছিল। তবে সেখানে বর্জ্য শোধনের কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ফলে প্রতিদিন প্রায় ২৪ হাজার ঘনমিটার বর্জ্য নালা দিয়ে বুড়িগঙ্গা নদীতে গিয়ে পড়ত। রাস্তার পাশে ও ডোবায় ফেলা হতো কঠিন বর্জ্য।

পরিবেশদূষণ রোধে ২০০৩ সালে সাভারের হেমায়েতপুরে চামড়াশিল্প নগর প্রকল্প নেওয়া হয়। ব্যয় ধরা হয় ১৭৬ কোটি টাকা। পরে কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগারসহ নানা খাতে ব্যয় বাড়িয়ে মোট প্রকল্প ব্যয় দাঁড়ায় ১ হাজার ৭৯ কোটি টাকায়। সিইটিপি নির্মাণের কার্যাদেশ দেওয়া হয় ২০১২ সালে। সেটি নির্মাণের পর পুরোপুরি চালু না করেই ২০১৭ সালে কোরবানির ঠিক আগে হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি হেমায়েতপুরে স্থানান্তর করা হয়। 

হেমায়েতপুর সিইটিপির তরল বর্জ্য পরিশোধনের সক্ষমতা দৈনিক ২৫ হাজার ঘনমিটার। তবে ট্যানারিগুলো পুরোদমে চামড়া প্রক্রিয়াজাত করলে এটির সক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি বর্জ্য উৎপাদন হয়। এখন পর্যন্ত পরিশোধিত তরলে ক্লোরাইড ও বায়োলজিক্যাল অক্সিজেন ডিমান্ড (বিওডি) নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে আনা যায়নি। 

ট্যানারি মালিকেরা বলছেন, চামড়াশিল্প নগরের সিইটিপি ও কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এখনো অসম্পূর্ণ। কোরবানির পর বাড়তি চাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য রেশনিং করে চামড়া প্রক্রিয়াজাতের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। গত বছরও এভাবে করা হয়েছিল। তাতে দূষণ বন্ধ হয়নি, কেবল মাত্রা কমেছিল। 

জানতে চাইলে বিটিএর সাধারণ সম্পাদক সাখাওয়াত উল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, ‘দেশের চামড়াশিল্পের বর্তমান পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতির জন্য আমাদের প্রথমে ২০টি ট্যানারির এলডব্লিউজি সনদ পাওয়ার লক্ষ্য নিয়ে এগোনো দরকার। এটি হয়ে গেলে বাকিগুলো ধাপে ধাপে হয়ে যাবে। তার জন্য সিইটিপি পুরোপুরি কার্যকর করার উদ্যোগ দরকার।’

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here