ছেলেদের পোশাকের চাহিদা মেটাতে বর্তমানে রেডিমেড ব্র্যান্ডের পোশাকের চাহিদা বাড়লেও কদর কমেনি ব্র্যান্ড টেইলারিংয়ের। সত্তরের দশকে ব্র্যান্ড টেইলারিং এর শুরু হয় এদেশে। সেই জৌলুস না থাকলেও এখনও কেউ কেউ সেই ধারা ধরে রেখেছে। আর গত তিন দশকে দাপটের সঙ্গে ব্যবসা করে যাচ্ছে দেশিয় পোশাকের ব্র্যান্ডগুলো। আগে ব্র্যান্ড বিষয়টি কিছু মানুষের মধ্যে থাকলেও সেটিকে করেছে সার্বজনীন এই দেশিয় ব্র্যান্ডগুলো।
রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোড, গাউসিয়া, চাঁদনী চক, নিউ মার্কেট- গাউসুল আজম মার্কেট এলাকাগুলো একসময় পরিচিত ছিলো দর্জি ঘরের নামে। অভিজাত ঘরানার দর্জির দোকানগুলো মূলত এখান থেকেই শুরু।
তবে দর্জি বাড়ির ধারণা বদলে দিয়ে সত্তরের দশকে ব্র্যান্ড টেইলারিং এর শুরু করে গাউসিয়ার ইব্রাহীম টেইলার্স। এই টেইলার্সের খোঁজে গাউসিয়ায় গেলে এক সময়ের জনপ্রিয় এই টেইলার্সের কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। তবে দীর্ঘদিন ধরে যারা এখানে দর্জির কাজ করছেন তাদের কাছে জানা গেলো এই পুরোনো টেইলার্সের জায়গা আর তাদের জনপ্রিয়তার গল্প।
পাওয়া যায় সেই ইব্রাহীম টেইলার্সের ম্যানেজার আব্দুল মতিনকে। যিনি এখন চাঁদনী চক মার্কেটের ব্যবসায় সমিতির সভাপতি। তিনি বললেন ইব্রাহীম টেইলার্সে যারা কাটিং মাস্টার হিসেবে কাজ করেছে তারাই এখন রাজধানীতে ব্র্যান্ড টেইলারিংকে ধরে রেখেছে।
তিনি বলেন, ‘গার্মেন্টস তো এখন দেখা যাচ্ছে। কিন্তু ঐ সময় ইব্রাহীম এগুলো নিয়ে এসেছিল। তখন একটা মোটা কট কাপড় ছিল। এটার প্রচুর চাহিদা ছিল। খুব উচ্চ শ্রেণির লোকজন পড়তো।’
এই ইব্রাহীম টেইলার্সে যারা যেতেন তার মধ্যে ছিলেন বাংলাদেশের অন্যতম আলোকচিত্রী আক্কাস মাহমুদ। যখন জানতে চাওয়া হলো কেমন ছিল তখনকার ফ্যাশন তখন তিনি জানালেন আগের অভিজাত ঘরানার টেইলারের বানানো কাপড় পরলে সহজেই বুঝা যেতো যা বর্তমানের কোন ব্র্যান্ড তাদের কাপড়ে তুলে ধরতে পারেনি।
আক্কাস মাহমুদ বলেন, ‘ইব্রাহীম টেইলার্সের জিন্স প্যান্টের ফিটিং ছিল অন্যরকম। মানুষ দেখলেই বুঝতে এটা ইব্রাহীমের থেকে বানানো। ওদের সুতাটা আলাদা ছিল অন্য সবার থেকে।’
আগের মতো জৌলুস না থাকলেও ২৯ বছর ধরে টেইলার্সের কাজ ধরে রেখেছে মগবুল’স। যেখানে শার্ট, প্যান্ট এবং স্যুট বানাতে অপেক্ষায় থাকেন মন্ত্রী-এমপিরা।
টেইলার্স এর কর্ণধার জানালেন, শুধু মন্ত্রী এমপি নন একটা সময় অনেক নায়ক-নায়িকারাও আসতেন তার দোকানে। তবে এই পেশায় দিন দিনই কারিগর সংকট বাড়ছে। তাই একটা সময় এ পেশা হারিয়ে যাবে বলে শঙ্কা তার।
মগবুল’স এর স্বত্বাধিকারী খন্দকার মো. মকবুল হুদা বলেন, ‘৬৪ জেলার মধ্যে প্রায় ৪০ জন ডিসি আমাদের কাস্টমার। আমাদের কারিগর ছিল ৫২ জন আর এখন এর সংখ্যা ২০ জন। আমার ধারণা ব্যবসা নাও ধাকতে পারে।’
আশির দশকে শুরু হওয়া রাজধানীর জনপ্রিয় টেইলার্স সানমুন পুরুষদের ফরমাল পোশাক তৈরিতে এখনো তাদের জায়গা ধরে রেখেছে। রুচিসম্মত ভালো মানের কাপড় আর ফিটিং পেতে তাই ক্রেতারা এখানেই ভিড় করেন। তবে বর্তমানে ক্রেতারা সময় বাঁচাতে রেডিমেড ফরমাল পোশাকের দিকেই বেশি ঝুঁকছেন।
বর্তমানে বাজারে ব্র্যান্ডের ফরমাল পোশাক তৈরিতে কাজ করছে রেমন্ড, বেলমন্ট, টপ টেন। এগুলোতে ক্রেতারা তাদের পোশাক বানানোর পাশাপাশি নিজের পছন্দসই কাপড় কেনার সুযোগও পাচ্ছে। ফলে দিন দিনই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে এসব দেশিয় ব্র্যান্ড।
পুরুষদের রেডিমেড ফরমাল পোশাক নিয়ে ১৯৮৩ সালে যাত্রা শুরু করে ক্যাটস আই। ফরমাল সাদা ও নীল রঙের শার্ট এবং প্যান্ট ছাড়াও শেরওয়ানি পাঞ্জাবি এবং ম্যান্ডারিন ভেস্টগুলোও তাদের স্বতন্ত্রতা প্রকাশ করে৷ এলিফ্যান্ট রোডের মনসুর ভবনে তাদের যাত্রা শুরু হলেও বর্তমানে তাদের দেশের বিভিন্ন জেলায় শাখা রয়েছে।
গেলো ৪০ বছরে বর্তমানে তৈরি পোশাকখাতের আমূল পরিবর্তন এনেছে অনেকগুলো দেশিয় ব্র্যান্ড। যাদের মধ্যে রয়েছে ইনফিনিটি, ইয়েলো, সেইলর, সারা, টুয়েলভসহ বেশি কিছু প্রতিষ্ঠান।
তিনটি সাব ব্র্যান্ড – লুবনান, রিচম্যান এবং ইনফিনিটি মেগামল নিয়ে ২০০৩ সালে যাত্রা শুরু করে লুবনান ট্রেড কনসোর্টিয়াম লিমিটেড। এই প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৯০ শতাংশ ফেব্রিকসই দেশিয়। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ৪৭টি শাখা রয়েছে এই প্রতিষ্ঠানের। প্রায় হাজারেরও বেশি পোশাককর্মী দিয়ে দেশের ভেতরেই নিজস্ব কারখানায় তৈরি হচ্ছে নানা ডিজাইনের পোশাক। স্মার্ট, রিজনেবল ও ফ্যাশনেবল হওয়ায় ক্রেতাদের কাছে চাহিদাও বেশি এবং বর্তমানে দেশের বাইরে রপ্তানির চেষ্টাও করছে প্রতিষ্ঠানটি।
ইনফিনিটির পরিচালক নাইমুল হক খান বলেন, ‘আমাদের দেশের পণ্যের বিশ্বব্যাপী একটা চাহিদা আছে। বিশ্বের বড় বড় ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলো আমাদের দেশ থেকে পণ্য নিচ্ছে। বাংলাদেশের মানুষেরও এখন বাইরের দেশের কাপড়ের প্রতি দুর্বলতা নাই।’
ফ্যাশন ও ব্র্যান্ড নিয়ে যারা কাজ করছেন তারা বলছেন দেশিয় ব্র্যান্ডগুলো তাদের পোশাকে সংস্কৃতি আর রুচিশীলতা ধরে রাখায় ক্রেতাদের একদিকে যেমন আস্থা ধরে রেখেছে অন্যদিকে আগে ব্র্যান্ড জিনিসটা কিছু মানুষের মধ্যে থাকলেও সেটিকে করেছে সার্বজনীন।
নির্মাতা কাউসার মাহমুদ বলেন, ‘দেশের ব্র্যান্ডের মধ্যে যাদের কারখানা আছে, তারা পোশাকের প্রতি তাদের অভিজ্ঞতার ছাপ রেখেছে। ব্র্যান্ড জিনিসটা আগে কিছু মানুষের মধ্যে ছিল। আর এখন এটা সবার মধ্যে ছড়িয়ে গেছে।’
প্রযুক্তির সাথে তাল মিলিয়ে যদি এই দেশিয় পোশাক ব্র্যান্ডগুলোকে দেশের বাইরে তুলে ধরা যায়, তাহলে বিশ্ববাজারেরও এই দেশিয় ব্র্যান্ডগুলোর একটি শক্ত অবস্থান তৈরি হবে বলে মনে করছেন ফ্যাশন বিশেষজ্ঞরা।