৪০ বছর পার করা তৈরি পোশাক খাত থেকে প্রণোদনা উঠিয়ে নেয়াকে ইতিবাচকভাবে দেখছেন অনেক অর্থনীতিবিদ। প্রতিষ্ঠিত খাতকে অব্যাহতভাবে নগদ প্রণোদনা না দিয়ে পিছিয়ে পড়া কিংবা নতুন শিল্পকে এগিয়ে নিতে প্রণোদনায় বৈচিত্র্য আনার পরামর্শ তাদের। যদিও রপ্তানিকারকদের মধ্যে রয়েছে তীব্র প্রতিক্রিয়া। সুবিধা হারিয়ে তাদের শঙ্কা, এতে রপ্তানি যেমন কমবে, তেমনি নতুন উদ্যোক্তা ও বাজার হারাতে পারে বাংলাদেশ।
তৈরি পোশাক শিল্প রপ্তানিতে যেমন শীর্ষে তেমনি প্রণোদনা প্রাপ্তির ক্ষেত্রেও শীর্ষস্থানে তৈরি পোশাক। বাজেটে বরাদ্দ তালিকার অগ্রভাগেও এই খাত। চলতি অর্থবছরে রপ্তানি ও রেমিট্যান্স প্রণোদনা বাবদ ১৫ হাজার ২২৫ কোটি টাকা বরাদ্দ থাকলেও এর প্রায় ৭০ শতাংশ বা ১১ হাজার ২২৫ কোটি টাকা পান পোশাক রপ্তানিকারকরা।
এমন সব সুবিধা নিয়েই চার দশক পার করেছে পোশাক শিল্প। এই সময়ে তৈরি পোশাক শিল্পে আকার যেমন বেড়েছে তেমনি বেড়েছে বিনিয়োগ। সেইসাথে বেড়েছে রপ্তানি, এগিয়েছে দেশ। তবে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে নগদ প্রণোদনা কমানোর সিদ্ধান্তের পর থেকে ক্ষতির মুখে পড়েছে এ খাত। শুল্ক বন্ড ও ডিউটি ড্র-ব্যাক এর পরিবর্তে পোশাক মালিকরা যে বিকল্প নগদ সহায়তা পেয়ে থাকেন সেই হার চার শতাংশ থেকে কমিয়ে আনা হয়েছে মাত্র দেড় শতাংশে। যা সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করছে তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের।
বিকেএমইএ নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘এই ইন্ডাস্ট্রিটা আমদানি নির্ভর একটা রপ্তানি শিল্পে পরিণত হবে। তাহলে বিদেশি রিজার্ভ কমবে, ডলার সংকট আরও বাড়বে। নগদ সহায়তার যে সিদ্ধান্তটা এখন দেয়া হয়েছে, এটা এখন না করে আপনারা ২০২৬ সালে যান। ২০২৬ সালের পরও কিন্তু এটা তিন বছর পাওয়া যাবে। তাহলে আমরা কি এতোই সাফিসিয়েন্ট হয়ে গেছি যে, আমাদের এগুলো সুবিধা নেয়ার প্রয়োজন নেই।’
বিটিএমএ সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন বলেন, ‘আমাদের যে অবস্থা এতে করে আমাদের মনে হয় ২০২৬ সালে সিদ্ধান্ত নেয়া কঠিন হয়ে যাবে। আমরা যারা একবার উদ্যোক্তা হয়েছি, আমাদের সেলসম্যান বানাইয়েন না। আমরা অন্যের পণ্য বাজারে এনে বিক্রি করে ভাত খাবো। বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশ হতে যাচ্ছে। আমরা যে ভেসেলে উঠেছি সে শিপ থেকে আমাদের যে নামানোর জন্য যারা ষড়যন্ত্র করছে, এই সমস্ত পলিসির জন্য আমাদের সে শিপ থেকে নামতে হবে। এটা হবে আমাদের জন্য দুঃখজনক ঘটনা।’
পণ্য রপ্তানিতে ভর্তুকি থেকে বেরিয়ে আসতে পাঁচ মাসের ব্যবধানে গেল ৩০ জুনের প্রজ্ঞাপনে এবার খাতভেদে নগদ সহায়তা কমবে সর্বোচ্চ পাঁচ শতাংশ পর্যন্ত। আর পোশাক কারখানার নগদ সহায়তা কমবে সর্বোচ্চ ৩ দশমিক ২ শতাংশ। ইউরো অঞ্চলে পোশাক রপ্তানিতে বিশেষ সহায়তা এক শতাংশ থেকে কমিয়ে করা হয়েছে দশমিক ৫ শতাংশ। ক্ষুদ্র ও মাঝারি কারখানার রপ্তানি প্রণোদনা এক থেকে কমিয়ে তিন শতাংশ, নতুন বাজারে প্রণোদনা তিন থেকে কমে দুই শতাংশ, আর রপ্তানিতে বিশেষ নগদ সহায়তা দশমিক ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে করা হয়েছে দশমিক ৩ শতাংশ।
তবে, সবচেয়ে ক্ষতির মুখে পড়বে ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কেজ শিল্প। যেখানে কমবে দেশিয় কাঁচামাল ব্যবহার করে পোশাক উৎপাদন। কেননা দেশিয় কাঁচামাল কিংবা দেশি সুতা ব্যবহার করে উৎপাদিত পোশাক নতুন বাজারে রপ্তানি করলে যে পাঁচ শতাংশ নগদ সহায়তা দেওয়া হতো তা কমিয়ে আনা হয়েছে তিন দশমিক পাঁচ শতাংশে। রপ্তানিকারকেরা বলছেন, একদিকে ব্যবসার খরচ বাড়ছে, অন্যদিকে প্রণোদনা কমছে। এতে পণ্য রপ্তানিতে দেশিয় কারখানাগুলোর প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমবে।
মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘এখনকার যে ইনসেন্টিভের হিসাবটা দেয়া হয়েছে সুতার দামের যে পার্থক্যটুকু আছে সেটুকুই যদি আমি আমলে নেই তাহলে কিন্তু আমি লোকাল সুতা কিনবো না। এতে করে আমার দেশের সুতা কারখানা বন্ধ হলে লাভ হবে ভারতের, কারণ সুতার বাজার তখন ভারতের বাজারে পরিণত হবে। বিকল্প কোনোকিছু না ভেবে অর্থ মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ ব্যাংক এই যে ইনসেন্টিভটা এখন কমিয়ে দিলো, এখনই বিদায় করে দেয়ার ব্যবস্থা করবো, কারণটা কী?’
মোহাম্মদ আলী খোকন বলেন, ‘আমার দেশিয় সুতার কাপড় কেনার জন্য সে প্রণোদনাটা পায়। আসলে আমদানির ওপর পায় না তারা। যখন কেউ প্রণোদনা পাবে না, তখন বাইরের কাপড় আমদানি করবে, স্থানীয় কাপড় তারা কিনবে না। ডলার নেই বলা হচ্ছে কিন্তু স্থানীয় শিল্পগুলো বন্ধ হয়ে গেলে ডলার সংকট আরও তীব্র হবে।’
প্রতিষ্ঠিত খাতকে অব্যাহতভাবে নগদ প্রণোদনা না দিয়ে পিছিয়ে পড়া কিংবা নতুন শিল্পকে এগিয়ে নিতে প্রণোদনায় বৈচিত্র্য আনার কথা বলছেন অর্থনীতিবিদরা। নতুন বিনিয়োগ আসবে এমন খাতে সহায়তা বাড়ানোর পরামর্শ তাদের।
অর্থনীতিবিদ এবং বাংলাদেশের পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘প্রণোদনার উদ্দেশ্য হচ্ছে বিনিয়োগ বাড়ানো, নতুন কিছু নিয়ে আসা। সেজন্য আমি এই টাকাটা খরচ করবো। কিন্তু যারা ২০ বছর ধরে আছে তাদের আবার দিতে যাবো কেন? তারা তো প্রতিষ্ঠিত। তারা ২০ বছরে যদি স্থান অর্জন করতে না পারে তাহলে আর কোনোদিন পারবে না।’
আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘আরএমজি খাতে তারা জানে কীভাবে ব্যবসা করতে হয়, কীভাবে টিকে থাকতে হয়। তাদের আর সাবসিডাইজ করার প্রয়োজন আছে বলে আমার মনে হয় না। উৎসাহ দেয়ার জন্য ম্যানমেইড ফাইবার যারা করতে তাদের আমরা তিন বছরের জন্য একটা প্রণোদনা দেয়া যায়।’
গত ৩০ জানুয়ারি হঠাৎ এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে রপ্তানি খাতে নগদ সহায়তা কমানোর ঘোষণা আসে। এলডিসি থেকে উত্তরণ পরবর্তী রপ্তানি খাতে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রণোদনা কমানোর সিদ্ধান্তে প্রথম ধাপে খাতভেদে নগদ সহায়তা ১০ শতাংশ পর্যন্ত কমানো হয়েছিল। এবার খাতভেদে নগদ সহায়তা কমবে সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ পর্যন্ত।
সাধারণত কোনো খাতকে প্রতিযোগিতার সক্ষমতায় এগিয়ে নিতে কিংবা রপ্তানিতে উৎসাহ দিতে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত প্রণোদনা দেয়া হয়। তাই, ৪০ বছর পার করা পরিণত তৈরি পোশাক খাত থেকে যে প্রণোদনা উঠিয়ে নেয়া হচ্ছে তাকে ইতিবাচকভাবে দেখছেন অনেক অর্থনীতিবিদ। যদিও রপ্তানিকারকদের মধ্যে রয়েছে তীব্র প্রতিক্রিয়া। তারা বলছেন, এতে রপ্তানি যেমন কমবে তেমনি নতুন উদ্যোক্তা, নতুন বাজার তৈরি, পণ্যের বৈচিত্র্য কমার পাশাপাশি দেশিয় কাঁচামাল দিয়ে পোশাক তৈরি বন্ধ হওয়ার উপক্রম হবে। তাই শীর্ষ এ রপ্তানি খাতকে এখনই সংকুচিত না করে আন্তর্জাতিক বাজারের চাহিদা বিবেচনায় সম্ভাবনাময় ম্যানমেইড ফাইবারে বিনিয়োগের পাশাপাশি নীতিসহায়তার পরামর্শ সংশ্লিষ্টদের।
এমএসআরএস