Home বাংলা নিউজ ব্যাপক চাহিদার মধ্যে এয়ার ফ্রেইটে পণ্য পাঠাতেও চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন পোশাক রপ্তানিকারকরা

ব্যাপক চাহিদার মধ্যে এয়ার ফ্রেইটে পণ্য পাঠাতেও চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন পোশাক রপ্তানিকারকরা

সাম্প্রতিক সময়ের ইন্টারনেট বন্ধ থাকা ও কারফিউয়ের ঘটনায় উৎপাদন ও পণ্যের জাহাজীকরণ ব্যাহত হয়েছে, এতে চালানের লিডটাইম (বায়ারদের আদেশ থেকে শুরু করে পণ্য পৌঁছানো পর্যন্ত সময়) কমে আসছে তৈরি পোশাকের রপ্তানিকারকদের। এরমধ্যে একাধিক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছেন তারা। এমনকী বিমানযোগে পণ্য পাঠানোর (এয়ার ফ্রেইটে) ব্যয়বহুল উপায় বেঁছে নিয়েও স্বস্তির পথ পাচ্ছেন না। এয়ার ফ্রেইটের চাহিদা হঠাৎ করে এভাবে বেড়ে যাওয়ায় আকাশপথে চালান পাঠাতেও হিমশিম দশা।  

ব্যবসায়ীরা বলছেন, চালান না হওয়া পণ্য ও কনটেইনারের জট তৈরি হওয়ায় বিমান ও জাহাজে পণ্য পরিবহন – উভয় ক্ষেত্রেই একই ধরনের সমস্যায় পড়তে হচ্ছে তাঁদের। এমনকী কিছু বায়ার সাতদিন পর্যন্ত ডেডলাইন বাড়ানোর পরেও লিডটাইম পূরণ করতে তারা পারছেন না।  

পোশাক শিল্পের সংশ্লিষ্টরা জানান, বিপুল পরিমাণ কার্গো বা পণ্যের কারণে ইতোমধ্যেই ‘ওভারলোডেড’ অবস্থা ঢাকার বিমানবন্দরে। পরিস্থিতি এমন যে, কার্গোবাহী ফ্লাইট যথেষ্ট না থাকায় কিছু পণ্য রাখা হয়েছে নির্দিষ্ট কার্গো এরিয়ার বাইরে। 

কিউট ড্রেস ইন্ডাস্ট্রির ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেখ এইচ এম মুস্তাফিজ টিবিএসকে বলেন, “আমাদের কানাডিয়ান বায়ারের পাঠানো ছোট একটি কনসাইনমেন্ট ঢাকা বিমানবন্দর থেকে খালাস করতেও এখন সমস্যা হচ্ছে। গত ২৭ জুন এই পার্সেল আসে; যদিও এতে থাকা পোশাক পণ্যগুলোর প্রাইস টিকেট লাগানোর পরে, ২০ জুলাইয়ের মধ্যেই সেগুলো বায়ারের কাছে ফেরত পাঠানোর কথা ছিল।” 
এখন ওই বায়ার যত দ্রুতসম্ভব পণ্যগুলো পাঠানোর চাপ দিচ্ছে বলেও জানান তিনি। 

মুস্তাফিজ বলেন, “কানাডার ওই বায়ারের সাথে আমাদের কথাবার্তা হয়েছে, তারা আরও দুই সপ্তাহ সময় হয়তো বাড়াতে পারে। তা নাহলে ব্যয়সাপেক্ষ এয়ার শিপমেন্টে (বিমানযোগে) পাঠাতে হবে।”  

তারই মত অভিজ্ঞতার কথা জানান, স্প্যারো গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শোভন ইসলাম। তিনি বলেন, ‘আমার পণ্যগুলো খালাসের জন্য ঢাকা বিমানবন্দরে যাই, যেগুলো গত ১৫ দিন ধরে সেখানে স্তূপাকারে রাখা হয়েছে।’

‘হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে গিয়ে বিপুল পরিমাণ পণ্য স্তূপাকারে রাখা অবস্থায় দেখি। দীর্ঘ লাইনে আরও অনেক ট্রাকও অপেক্ষা করছিল।’ তিনি যোগ করেন যে, ক্লিয়ারিং ও ফরোয়ার্ডিং এজেন্টদের (সিঅ্যান্ডএফ) সাম্প্রতিক ধর্মঘটের কারণে এয়ারপোর্টের স্বাভাবিক কার্যক্রমে ব্যাঘাত ঘটেছে, এছাড়া কারফিউয়ের মধ্যে অনেক এয়ারলাইন তাদের ফ্লাইট পরিচালনা বাতিলও করেছে।

শোভন টিবিএসকে বলেন, রপ্তানি পণ্য সাধারণত ঢাকা বিমানবন্দর থেকে পাঠাতে সাত দিন সময় লাগে; আর সেখানে আসা পণ্যগুলি ছাড়তে কমপক্ষে ১৫ দিন সময় লাগে। ফলস্বরূপ, এখন খোলা জায়গায় এবং এমনকি রাস্তায় পণ্যের স্তূপ হয়ে যাচ্ছে।

বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি কবির আহমেদ জানান, কার্গো এরিয়ায় জায়গার অভাব এবং কার্গোবাহী এয়ারলাইনের অভাবসহ বেশকিছু কারণেই পণ্যের স্তূপ জড়ো হয়েছে। ডিসেম্বরের শেষদিক থেকে পোশাক রপ্তানিকারকরাও সময়মতো পণ্যের চালান পাঠানোর জন্য ব্যাপক চাপের মধ্যে আছেন। 

কবির বলেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনের পর থেকে ঢাকা বিমানবন্দরে রপ্তানিযোগ্য কার্গোর লোড বিপুলভাবে বেড়ে গেছে। টার্কিশ, এমিরেটস, কাতার ও সৌদি এয়ারলাইনের মতো বিভিন্ন এয়ার ফ্রেইটার বাংলাদেশে তাঁদের কার্যক্রম সীমিত করায় বিমানবন্দরের কার্গো হ্যান্ডলিং সক্ষমতাও অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে।

‘ডেডিকেটেড কার্গো ফ্লাইট না থাকায়, আমাদের প্রায়ই পণ্য পাঠানোর জন্য যাত্রীবাহী ফ্লাইটের ওপর নির্ভর করতে হয়,’ যোগ করেন তিনি। 

তুসুকা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরশাদ জামাল বলেন, ভারতের চেয়ে বেশি ভাড়া দিয়েও ঢাকা থেকে ফ্লাইটের ব্যবস্থা করা খুব কঠিন হয়ে পড়েছে। বায়ারদের লিডটাইম পূরণে ৮০ হাজার পিস পোশাকপন্য এয়ার ফ্রেইটের মাধ্যমে নিজস্ব খরচে ইউরোপে পাঠিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এতে তাঁদের প্রায় ৩ কোটি ২০ লাখ টাকা লেগেছে বলে জানান তিনি। 

শীর্ষ একটি এয়ারলাইন অপারেটর জানিয়েছে, ঢাকা বিমানবন্দরের পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে, এমনকী গতকাল তাদের উড়োজাহাজ পার্ক করাতেও সমস্যার মধ্যে পড়তে হয়েছে।

বাড়ছে ভারত হয়ে রপ্তানি

কবির আহমেদ বলেন, এই পরিস্থিতিতে পণ্য পাঠানোর জন্য ভারতের বিমানবন্দরগুলো ব্যবহারে বাধ্য হচ্ছেন অনেক রপ্তানিকারক। ‘ভারতের বিমানবন্দর দিয়ে বাংলাদেশি পণ্য পরিবহনের পরিমাণ অনেকটা বেড়েছে। চলতি বছরের জুনে যা পৌঁছেছে প্রায় ১৪ হাজার টনে। আগে প্রতি মাসে এটা ১৫০ থেকে ২০০ টন পর্যন্ত হতো’ – বলে জানান তিনি।

তিনি আরও জানান, চলতি মাসে চার্টার বা ভাড়ায় চালিত দুটি বিমানের বাংলাদেশ থেকে কার্যক্রম শুরুর কথা রয়েছে। যা পোশাক রপ্তানিকারকদের জন্য কিছুটা হলেও সহায়ক হবে। আগামী বছরের জুনে ঢাকা বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল চালুর কথা রয়েছে, তারপর এই পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে।

বাংলাদেশের নিট পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারকদের সমিতি- বিকেএমইএ’র নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেছেন, লিডটাইম পূরণে শীর্ষ পোশাক রপ্তানিকারক মাইক্রো ফাইবার গ্রুপ কিছুদিন আগে তাঁদের পণ্য সমুদ্রপথে দুবাই পাঠায়, সেখান থেকে তা বিমানযোগে মূল গন্তব্যে পাঠানো হয়। ‘চট্টগ্রাম বন্দর ও ঢাকা বিমানবন্দরে কনটেইনার জটের যে পরিস্থিতি, তাতে রপ্তানিকারকটি এই উপায় বেঁছে নিতে বাধ্য হয়’- বলে জানান তিনি।

ঢাকা থেকে বিমানযোগে পণ্য পাঠানোর খরচ

শিল্পের অভ্যন্তরীণরা জানান, ঢাকা থেকে ইউরোপে প্রতি কিলোগ্রাম কার্গো বিমানে পাঠানোর খরচ পাঁচ মাস আগের ২ ডলার থেকে বেড়ে ৬ ডলারে পৌঁছেছে। একইভাবে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য নির্ধারিত চালানের জন্য এয়ার ফ্রেইট খরচ গেল ডিসেম্বরের ৩ ডলারের তুলনায় প্রতি কিলোগ্রামে বেড়ে সাড়ে ৭ থেকে ৮ ডলার হয়েছে।

বাংলাদেশ থেকে যে খরচ তার চেয়ে অন্তত ১ ডলার কম দর চাইতে পারে ভারতের এয়ারলাইনগুলো। প্রতিবেশী দেশটির বিমানবন্দরগুলো দিয়ে এয়ার শিপমেন্ট বাড়ার এটাই প্রধান কারণ। তবে এসব বিমানবন্দরে পণ্য নিতে অতিরিক্ত ১,৬০০ কিলোমিটার সড়কপথে পরিবহনের প্রয়োজন হয় বলে জানান তিনি।  

ঢাকা থেকে এয়ারফ্রেইটের খরচ বেশি যেকারণে

নাম না প্রকাশের শর্তে একজন রপ্তানিকারক বলেন, প্রতি কেজি কার্গো হ্যান্ডলিংয়ের জন্য বাংলাদেশ বিমান নেয় ১৮ সেন্ট, ভারতে যা হলো ১১ সেন্ট। কবির আহমেদ জানান, এখানে এয়ারলাইনগুলো অতিরিক্ত আরও ৪ থেকে ৫ সেন্ট নেয়, যাতে মোট খরচ দাঁড়ায় ২৪ থেকে ২৫ সেন্টে। 

বাংলাদেশ থেকে প্রতি কিলোগ্রাম পণ্যের এয়ারফ্রেইটের খরচ যেখানে প্রায় ৬ ডলার, সে তুলনায় ইউরোপের গন্তব্য অনুযায়ী ভারতে তা ৩ থেকে ৪ ডলার।

ওই রপ্তানিকারক জানান, বেনাপোল স্থলবন্দর থেকে কলকাতা, নয়াদিল্লি বা মুম্বাইয়ে পণ্য পরিবহনের অতিরিক্ত হ্যান্ডলিং খরচ দেওয়ার পরেও ভারতীয় কার্গো এজেন্টদের মাধ্যমে পাঠাতে প্রতি কিলোগ্রামে সর্বোচ্চ ১ ডলার পর্যন্ত সাশ্রয় করা যায়। 

গত ১৮ জুলাই থেকে ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ ছিল দেশে, যা পাঁচদিন পরে চালু হয়। আর ১৯ জুলাই রাত থেকে কারফিউ জারি করা হয়, যা এখন দেশের কিছু কিছু জায়গায় শিথিল করা হয়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মধ্যে সরকার এসব পদক্ষেপ নেয়, এই আন্দোলন ঘিরে সহিংসতায় প্রায় ২০০ জনের প্রাণহানি ঘটেছে বলে জানা গেছে। 

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here