কিছুতেই থামছে না দেশের তৈরি পোশাক খাতের শ্রমিক অসন্তোষ। আগস্টের শেষে শুরু হওয়া এ নৈরাজ্যের সঠিক কারণও বের করতে পারছেন না সংশ্লিষ্টরা। দাবি মানার পরও আন্দোলন-ভাঙচুর না থামায় দানা বাঁধছে নানা সন্দেহ। তবে সঠিক কারণ এখনো অধরা।
পোশাকখাতের সংশ্লিষ্টরা তাদের কিছু পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন জাগো নিউজের কাছে। চেষ্টা করেছেন সম্ভাব্য কারণ ও সমাধানের জায়গা খুঁজে বের করার। তাদের ধারণা, এ জায়গাগুলোতে সরকার যদি নজর দেয় তাহলে বের হতে পারে সম্ভাব্য সমাধান।
সাভার ও আশুলিয়ার বিভিন্ন কারখানায় চলছে বেশি সহিংসতা। সোমবার (৩০ সেপ্টেম্বর) বিক্ষুব্ধ, বিশৃঙ্খল শ্রমিকদের দমনে শেষ পর্যন্ত গুলি চালাতে বাধ্য হয় পুলিশ। এতে একজন মারাও গেছেন। সরকার, শ্রমিক নেতা ও মালিকপক্ষ একাধিক বৈঠক করেও এ অস্থিরতা নিরসনে ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেনি। সরকার, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং শ্রমিক ইউনিয়ন নেতারা মালিকদের শান্ত করার আশ্বাস দিলেও তা হয়নি।
এমনকি সরকারি গোয়েন্দা বা কারখানার মালিকরাও এর পেছনের কারণ শনাক্ত করতে পারেননি বা দোষীকে চিহ্নিত করতে পারেননি বলে অভিযোগ রয়েছে। মালিকরা একে ‘অজানা অস্থিরতা’ বলে অভিহিত করেছেন।
গত সপ্তাহে সহিংসতা ও অস্থিরতার তীব্রতা কিছুটা শান্ত হলেও এ সপ্তাহে আবারও তা মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। ক্রেতাদের চাপের মুখে কারখানা মালিক ও বিজিএমইএ বর্তমান অবস্থা নিয়ে চরম বাজে অবস্থা পার করছে। আকাশপথে পণ্য পাঠানোর জন্য রপ্তানিকারকদের ছাড় ও অতিরিক্ত চার্জ দিতে হয়। ফলে কমে লাভ।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ভুক্তভোগী কারখানার মালিকরা এ প্রতিবেদকের কাছে শ্রমিক অসন্তোষের পেছনে কিছু কারণ উল্লেখ করেছেন। দিয়েছেন সম্ভাব্য সমাধানের সূত্র।
যেসব কারণে শ্রমিক অসন্তোষ বলে দাবি সংশ্লিষ্টদের
>>‘আমাদের শক্তিশালী শিল্প পুলিশ রয়েছে এবং তারা অতীতে শ্রমিকদের অসন্তোষ দক্ষতার সঙ্গে নিয়ন্ত্রণ করেছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পুলিশের আন্তরিকতা অনুপস্থিত। তাদের ক্ষমতা ছিল কিন্তু এখন কার্যকরী নয়। এখানে অন্য কিছু লুকিয়ে আছে।’
>>‘কর্মীরা কাজ করতে ইচ্ছুক কিন্তু এক ধরনের বিশৃঙ্খলা তৈরি করে। তারা হুমকি দিচ্ছে, মারধর করছে। এরা স্থানীয় দুর্বৃত্ত এবং বেশির ভাগই ঝুট ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এটা করছে। দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা না নিলে এ খাত শান্ত হবে না।’
>>তবে বিজিএমইএর ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আব্দুল্লাহিল রাকিব বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে দৃঢ় সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। কিন্তু ধীরে ধীরে উন্নতি হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ব্যবস্থা নিতে শুরু করলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসবে।’
>>অন্য কারখানার মালিকরা এটাকে পরিকল্পিত অস্থিরতা বলে দাবি করেছেন। তাদের যুক্তি, কিছু নতুন শ্রমিকের মাধ্যমে অস্থিরতা উসকে দেওয়া হয়েছে।
>>এগুলো ছাড়াও কিছু কর্মী আছে যারা চাকরি থেকে বরখাস্ত হয়েছে বা চাকরি পেতে ব্যর্থ হয়েছে। রাজনৈতিক পরিবর্তনের কারণে কেউ সুবিধা পাচ্ছে না, তারা শ্রমিক অসন্তোষের নামে অরাজকতা তৈরি করছে।
>>কারখানার মালিকদের দাবি, একটি স্বার্থান্বেষী মহল শ্রমিকদের চাকরিচ্যুত করার জন্য নৈরাজ্য সৃষ্টিতে উৎসাহিত করছে। একজন শ্রমিককে বরখাস্ত করা হলে সে তার বেতনের চেয়ে বেশি পাবে।
>>একজন অপারেটর প্রতি মাসে সর্বনিম্ন ১৯-২০ হাজার টাকা বেতন পান। মালিকরা তাকে বরখাস্ত করলে তারা ৭০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা পাবেন। পরে তিনি অন্য একটি কারখানায় যোগ দেবেন।’ এমন যুক্তি দেন লুসাকা গ্রুপের চেয়ারম্যান হাফিজুর রহমান।
>>একজন মালিক স্থানীয় দুর্বৃত্তদের কাছ থেকে মারাত্মক হুমকি পান। তিনি তার অভিজ্ঞতা শেয়ার করে বলেন, আরেকটি কারণ হলো শিল্পএলাকা অপরাধপ্রবণ। এমন একটি দল আছে যাদের প্রকৃতপক্ষে কোনো চাকরি ছিল না, তারা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত। এগুলো রাজনৈতিক দলগুলোর দ্বারাও ব্যবহৃত হয়। আওয়ামী লীগ শাসনের পতনের পর এই দলগুলো রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগ নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে অনুপস্থিত।
তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন এলাকা থেকে দুর্বৃত্তরা আস্তানা গেঁড়েছে। সরকারি গোয়েন্দা সংস্থা এলাকায় পুরোপুরি নিয়োজিত নয়। ফলে তারা নেতৃত্ব দিচ্ছে। ব্যবস্থা না নিলে এসব আরও বাড়বে।’
এলাকার বেশির ভাগ কারখানার মালিক জানান, কোনো কোনো মামলায় কারা অপরাধী তা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জানে, কিন্তু গ্রেফতার করেনি। হতে পারে তারা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে সঠিক নির্দেশনা পাননি। কিন্তু এই প্রবণতা কর্মীদের মনোভাব পরিবর্তন করছে। ফলে শ্রমিকদের নৈরাজ্য থামছে না।
কারখানা মালিকদের অভিযোগের বিষয়ে মন্তব্য করে বিজিএমইএর ভারপ্রাপ্ত সভাপতি বলেন, ‘আমরা এখানে কিছু মিস করছি। আমি আশা করি সরকার ব্যবস্থা নেবে যাতে অস্থিরতা দীর্ঘায়িত না হয়।’