রপ্তানিমুখী পোশাক তৈরির কোম্পানি এসরোটেক্স গ্রুপের পাঁচটি কারখানা মিলে গেল সপ্তাহে লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ১৯ শতাংশ উৎপাদন করতে পেরেছে। আগামী তিন মাসের জন্য যে ক্রয়াদেশ তাদের হাতে আছে, তাও উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে না শ্রমিক বিক্ষোভের কারণে।
এসরোটেক্সে গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আসাদুল ইসলাম অসহায় ভঙ্গিতে গণমাধ্যমকে বললেন, অবস্থা এমন চললে কারখানাগুলো পুরোপুরি বন্ধের কথা ভাবতে হবে তাদের। ‘শ্রমিকরা কথা শোনে না। তাদের কথায় আমাদের চলতে হচ্ছে। তিনদিন লে অফ ঘোষণা করেছি। শ্রমিকরা সেসব দিনের পারিশ্রমিকও চাইছে।’ শ্রমিকদের এমন দাবিকে ‘দিনে দুপুরে ডাকাতি’ বলছেন আসাদুল ইসলাম।
প্রায় ২১ হাজার শ্রমিক নিয়ে কাজ চালিয়ে আসা এসরোটেক্সের পাঁচ কারখানা মিলে প্রতি মাসে দেড় কোটি থেকে এক কোটি ৬০ লাখ ডলারের পোশাক রপ্তানি করে। কিন্তু শ্রমিকরা সেপ্টেম্বরে ২৬ কর্মদিবসের কাজ করেছেন মাত্র ১৬ দিন। ব্যাংক ঋণ নিয়ে শ্রমিকদের বেতন দিতে হচ্ছে জানিয়ে আসাদুল বলেন, ‘এভাবে কতদিন তারা ঋণ দেবে। চিন্তা করছি, কারখানা বন্ধ করে দেব। এভাবে চলতে থাকলে তো আর কোনো উপায় নেই।’
শুধু এসরোটেক্সেই না, শ্রমিক অসন্তোষের ধাক্কায় এ খাতের বহু বড় কোম্পানির একই দশা। ক্ষমতার পালাবদলে আইনশৃঙ্খলার অবনতির মাঝে পোশাক খাতের শ্রমিকদের অসন্তোষ, আন্দোলন, কর্মবিরতি এবং একের পর এক কারখানা বন্ধের ঘটনায় রপ্তানি আয়ে ৮৫ শতাংশের মত অবদান রাখা এ খাতের ভবিষ্যৎ নিয়ে নানামুখী শঙ্কা দানা বাঁধছে।
উৎপাদন তলানীতে নেমে যাওয়া, কার্যাদেশ পাশের দেশে চলে যাওয়া, আয় কমে ব্যাংক ঋণে নির্ভরশীলতার পাশাপাশি সামনের দিনে বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে দেশের রপ্তানিতে অবদান রাখা অনেক বড় কোম্পানির।
দেশে প্রায় ২ হাজার ৮০০ পোশাক কারখানা আছে, যারা সরাসরি পোশাক রপ্তানির সঙ্গে জড়িত। অব্যাহত শ্রমিক অসন্তোষ ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে ১২ সেপ্টেম্বর কেবল আশুলিয়ার শিল্পাঞ্চলের ৮৬টি কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ও ১৩৩টি কারখানায় সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ। একই দিন এক সংবাদ সম্মেলনে সরকারের তরফে জানানো হয়, ৫০টির বেশি কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। প্রতিদিনই বহু কারখানা বন্ধ থাকছে। তাতে পোশাকের কার্যাদেশ বাতিল হয়ে যাচ্ছে।
সরকারের ভাষ্যে ২০% কার্যাদেশ ‘বাতিল’
শ্রমিক অসন্তোষের প্রেক্ষিতে প্রায় ১৫ থেকে ২০ শতাংশ কার্যাদেশ বাতিল হয়ে গেছে বলে গত ১২ সেপ্টেম্বরের সংবাদ সম্মেলনে জানান শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। তবে এসরোটেক্স গ্রুপের এমডি আসাদুল ইসলামের ভাষ্য, কার্যাদেশ কমে যাওয়ার চেয়েও বড় শঙ্কা অপেক্ষা করছে সামনের দিনে। তার ভাষায়, ‘এভাবে চলতে থাকলে ইন্ডাস্ট্রিই চলবে না।’
একই সুরে কথা বললেন স্প্যারো গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শোভন ইসলামের। পৃথিবীর ২০টি দেশের ৪০টি ক্রেতা প্রতিষ্ঠানকে পোশাক রপ্তানি করে এই গ্রুপ। শোভন বলেন, ‘ক্রেতারা সাধারণত এমন সমস্যা হলে ভাবেন ৪-৫ দিনেই সমাধান হবে। বেশি গেলে ৭ দিনে হবে। অথচ মাস পেরিয়ে গেছে, কোনো সমাধান হয়নি। আমরা শ্রমিকদের ১৮ দফা মেনেছিলাম। কিন্তু দিন দিন দফা বাড়ছেই। খুবই হতাশাজনক।’
এমন চলতে থাকলে ‘অস্তিত্ব সংকট’ তৈরি হবে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘সত্যি বলতে ওভারনাইট ক্রয়াদেশ পড়ে না। অর্ডার তিনমাস আগেই বুকিং দেওয়া থাকে। কিন্তু আমরা উৎপাদন করতে পারছি না। অর্ডার এক্সিকিউট না করা গেলে অর্ডার পেয়েই বা কী! ১০-২০ শতাংশ অর্ডারের বিষয়ে ক্রেতারা বলছেন, এখন আর তাদের দরকার নেই। ক্রেতারা নতুন করে নেগোশিয়েট করছেন না।’
শ্রমিক অসন্তোষ প্রথমে আশুলিয়াতে থাকলেও দেশের বিভিন্ন জায়গায় সেটা ‘ছড়িয়ে যাচ্ছে’ বলে জানান শোভন।
ক্রয়াদেশ অন্যান্য দেশে
চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই ভালো যাচ্ছে না বাংলাদেশের। জুলাই জুড়ে কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে নৈরাজ্য, সহিংসতা আর সংঘাতের পর কারফিউ জারি হয়। প্রথমবারের মত দীর্ঘ সময়ের জন্য ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউটের কবলে পড়ে সারা পৃথিবীর সঙ্গে দেশের বাণিজ্য যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। এতে বিশ্ব বাজারে তৈরি হয় ‘আস্থার সংকট’।
আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুৎ হলে হাল ধরেন মুহাম্মদ ইউনূস। পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে তার ভালো সম্পর্ক থাকায় আশার আলো দেখেছিলেন পোশাক খাতের ব্যবসায়ীরা। তবে আশার প্রদীপ নিভে যায় ক্ষমতার পালাবদলের পর আইনশৃঙ্খলার অবনতি হলে। বিভিন্ন শিল্প কারখানায় হামলা হয়। ঝুট ব্যবসার দখলদারিত্ব ও চাঁদাবাজি নিয়ে এ খাতে ফের অস্থিরতা তৈরি হয়। আর শ্রমিক অসন্তোষ যেন কফিনে ‘শেষ পেরেক’ ঠোকে। প্রতিযোগিতামূলক দেশগুলো এ সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে বা ক্রেতারাও তাদের দিকে ঝুঁকছে।
এ খাতের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি রফিকুল ইসলাম বলছেন, ৩০ শতাংশের মত কার্যাদেশ অন্যান্য দেশে চলে গেছে। স্প্যারো গ্রুপের শোভনও একই কথা বলেছেন। তার ভাষ্য, ‘যখন ক্রেতারা বলছেন এখন আর লাগবে না। আমরা বুঝি তারা অন্য দেশে এ কার্যাদেশ দিয়েছেন।’ এক কোটি ৭০ লাখ পোশাকের একটি কার্যাদেশ হাতছাড়া হওয়ার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘প্রতিটি পোশাকের মূল্য ৪ ডলার করে হলেও সবগুলোর মূল্য কত হয় তা হিসাব করে দেখুন। এ আদেশটি ২-৩টি কোম্পানি মিলে পেত। দ্য এন্টায়ার অর্ডার হ্যাভ অলরেডি মুভড।’
উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হাতছাড়া হওয়া কার্যাদেশগুলো বাংলাদেশের প্রতিযোগী দেশ ভারত, ভিয়েতনাম, শ্রীলঙ্কা, ইন্দোনেশিয়া এবং পাকিস্তানে যাচ্ছে। কার্যাদেশ বাতিল হওয়ার বিষয়টি ১২ সেপ্টেম্বরের হওয়া সংবাদ সম্মেলনে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদও বলেছেন। ওইদিন তিনি বলেন, ‘আমরা ইতোমধ্যে এমন কিছু তথ্য পেয়েছি যেটা ওই বিষয়টিই ইঙ্গিত করে। এটা একটি সিজনাল বিজনেস। মার্কেটে যে প্রোডাক্ট যাবে সেটা তিন মাস আগেই প্রস্তুত করতে হয়। সেই অর্ডারগুলো অনেক জায়গায় বাতিল হয়ে যাচ্ছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি কিছু নির্দিষ্ট দেশের ব্যবসায়ীরা অর্ডারটা নেওয়ার জন্য লবিং করছে, উঠে পড়ে লেগেছে।’
রপ্তানি কত কমবে?
আশুলিয়ার বড় একজন পোশাক রপ্তানিকারক বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের এক কোম্পানি প্রতিবছর তাদের ১ কোটি পোশাকের আদেশ দিত। কিন্তু সেই ক্রেতা এখন অন্য দেশে ‘চলে যাচ্ছে’ জানিয়ে তিনি বলেন, আশুলিয়াকে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতারা ‘রিস্কি জোন’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
সুরমা গার্মেন্টস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফয়সাল সামাদ বলেন, বারবার শ্রমিক আন্দোলনে কারখানা বন্ধের জেরে ৯০০ কোটি টাকার মত ক্ষতি হচ্ছে তাদের। ক্ষতির মুখে পড়েছে অনন্ত গার্মেন্টসও। কারখানা বন্ধের কারণে পণ্য জাহাজীকরণের (শিপিং) সময় ফসকে যাওয়ায় তাদের প্রায় ১০ লাখ পোশাক আটকে (ব্যাকলগ) গেছে। এখন আকাশপথে বিপুল অর্থ ব্যয়ে তাদের পণ্য পাঠাতে হবে। যেহেতু উৎপাদন ব্যহত হচ্ছে, কার্যাদেশ বাতিল হচ্ছে, শিপমেন্ট সঠিক সময়ে করা যাচ্ছে না, এর প্রভাব পড়ছে সরাসরি রপ্তানি আয়ে। এখনকার চেয়েও বেশি ভাটার শঙ্কা দেখা যাচ্ছে চলতি অর্থবছরের তৃতীয় প্রান্তিকে।
বাংলাদেশ ২০২২-২৩ অর্থবছরে রপ্তানি থেকে আয় করে ৫ হাজার ৫৫৫ কোটি ডলার। এর মধ্যে পোশাক রপ্তানি থেকেই আসে ৪ হাজার ৬৯৯ কোটি ডলার, যা মোট রপ্তানি আয়ের ৮৪ দশমিক ৫৮ শতাংশ।
পোশাক খাতের সবচেয়ে রমরমা সময় যায় জানুয়ারি-মার্চ সময়ে। ওই সময়টায় যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপসহ পশ্চিমা বিশ্বের দেশগুলোতে ছুটি ও ভ্রমণের আমেজ থাকায় তখন বাংলাদেশের পণ্যের বিক্রি বাড়ে। ওই সময়ের পণ্যের কার্যাদেশ পেতে নমুনা পাঠাতে হয় অগাস্টের ছুটির আগে। কিন্তু দেশে জুলাই থেকে শুরু হওয়া অস্থিরতা ঘিরে কারখানা বন্ধ, আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম বন্ধ থাকা ও ইন্টারনেট ব্ল্যাক আউটের কবলে পড়ে অনেকেই নমুনা পাঠাতে সমস্যায় পড়েছেন বা পিছিয়ে পড়েছেন।
রপ্তানিকারকরা বলছেন, ইন্টারনেট ও যোগাযোগ বন্ধ থাকায় বিদেশি ক্রেতাদের মধ্যে ‘আস্থার’ যে সংকট প্রথমে হয়েছিল, তার মাশুল এমনিতেই গুনতেই হত। এখন শ্রমিক অসন্তোষের কারণে অচলায়তন তৈরি হল। এর জেরে জানুয়ারি-মার্চ সময়ে ৬০০ কোটি (৬ বিলিয়ন) ডলার পর্যন্ত রপ্তানি কমে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন শোভন ইসলাম।
তাছাড়া রপ্তানিকারকরা যে ৩০ শতাংশ কার্যাদেশ বাতিলের কথা বলছেন, তাতেও একই পরিমাণ রপ্তানি কমার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। সঙ্গে চলতি কার্যাদেশের উৎপাদন ও রপ্তানি সঠিক সময়ে না করা গেলে এর পরিমাণ আরও বাড়বে।
সুত্র: বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর