পণ্য রপ্তানির তথ্যে গরমিলের বিষয়টি সামনে আসার আগে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছিল, গত ২০২৩–২৪ অর্থবছরের তৃতীয় প্রান্তিক জানুয়ারি-মার্চে ১ হাজার ৩৮১ কোটি মার্কিন ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে। তার বিপরীতে কাঁচামাল আমদানি হয়েছিল ৩৮৪ কোটি ডলারের। তখন প্রকৃত পোশাক রপ্তানি হয়েছিল ৯৯৭ কোটি ডলার বা ৭২ দশমিক ২০ শতাংশ।
অবশ্য পণ্য রপ্তানির তথ্য সংশোধনের পর উঠে এসেছে, ওই প্রান্তিকে (তৃতীয়) তৈরি পোশাকের প্রকৃত রপ্তানি কমে ৫৭ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। কাঁচামাল আমদানির তথ্য ঠিক থাকলেও পণ্য রপ্তানি কমে যাওয়ার কারণে পোশাক খাতে প্রকৃত রপ্তানি কমেছে ৪০৮ কোটি ডলার।
তৈরি পোশাক খাত নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ দুটি ত্রৈমাসিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণে প্রকৃত পোশাক রপ্তানিতে গরমিলের তথ্য বেরিয়ে এসেছে। এতে দেখা যায়, রপ্তানির তথ্য সংশোধন করায় গত দুই অর্থবছরের (২০২২-২৩ ও ২০২৩-২৪) সাত প্রান্তিকে তৈরি পোশাক খাতের প্রকৃত রপ্তানি কমেছে। মূলত পোশাক রপ্তানি থেকে তুলা, সুতা, কাপড় ও সরঞ্জামের আমদানি ব্যয় বাদ দিয়ে নিট বা প্রকৃত রপ্তানির হিসাব করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অনেকে প্রকৃত রপ্তানি আয়কে পোশাক খাতের মূল্য সংযোজন হিসেবেও অভিহিত করে থাকেন।
রপ্তানি আয় বাড়িয়ে দেখানোর কারণে গত ২০২২-২৩ অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে (অক্টোবর–ডিসেম্বর) তৈরি পোশাক রপ্তানিতে মূল্য সংযোজন এক লাফে ৫১ শতাংশ থেকে বেড়ে ৬৭ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। তার পরের পাঁচ প্রান্তিকে মূল্য সংযোজন ৭০ থেকে ৭২ শতাংশের মধ্যে ঘুরপাক খায়। তখন পোশাকশিল্পের অনেক উদ্যোক্তা বিষয়টি নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন। কারণ, তার আগের ছয় প্রান্তিকে পোশাক রপ্তানিতে মূল্য সংযোজন বেশির ভাগ সময়ই ছিল ৫১ থেকে ৫৭ শতাংশ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের চতুর্থ প্রান্তিক এপ্রিল-জুনে ৮৮৪ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছিল। ওই প্রান্তিকে কাঁচামাল আমদানির পরিমাণ ছিল ৩৮০ কোটি ডলার। তার মানে সর্বশেষ অর্থবছরের চতুর্থ প্রান্তিকে পোশাক রপ্তানিতে মূল্য সংযোজন ছিল ৫০৪ কোটি ডলার বা ৫৭ শতাংশ।
সামনের দিনগুলোতে মূল্য সংযোজন কমবে বলে আমাদের আশঙ্কা। তার কারণ, প্রণোদনা হ্রাস করার পর অনেকে সুতা আমদানিতে মনোযোগী হচ্ছেন। কারণ, প্রতি কেজি বিদেশি সুতা ব্যবহারে ২০-৩০ সেন্ট কম লাগছে। তা ছাড়া গ্যাস–সংকটের কারণেও অনেক উদ্যোক্তা সুতা ও কাপড় আমদানিতে মনোযোগী হচ্ছেন।
—মোহাম্মদ হাতেম, সভাপতি, বিকেএমইএ।
বাংলাদেশ ব্যাংক গত জুলাইয়ে হঠাৎ প্রকৃত পণ্য রপ্তানির ভিত্তিতে লেনদেনে ভারসাম্যের তথ্য প্রকাশ করে। এর ফলে পণ্য রপ্তানির হিসাবে বড় গরমিলের তথ্য উঠে আসে। তখন বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছিল, রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) দীর্ঘদিন ধরে রপ্তানির হিসাব প্রকাশ করলেও সে অনুযায়ী আয় দেশে আসছে না। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা যাচ্ছে, এত পণ্য রপ্তানি হয়নি। তাই আয় বেশি আসার যৌক্তিকতা নেই। সে জন্য প্রকৃত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে প্রতিবেদন তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।
তারপর টানা তিন মাস পণ্য রপ্তানির হিসাব প্রকাশ করা বন্ধ রাখে ইপিবি। যাচাই-বাছাই শেষে চলতি মাসে আবার সংস্থাটি রপ্তানির তথ্য প্রকাশ করতে শুরু করেছে। রপ্তানির তথ্যে গরমিলের বিষয়টি সামনে আসার আগে ইপিবি জানিয়েছিল, গত অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে (জুলাই-মে) পণ্য রপ্তানি হয়েছিল ৫ হাজার ১৫৪ কোটি ডলার। তবে চলতি অক্টোবর মাসে সংস্থাটি জানায়, গত অর্থবছরে পণ্য রপ্তানি হয়েছে ৪ হাজার ৪৪৭ কোটি ডলারের। তার মানে গত অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসেই ৭০৭ কোটি ডলারের রপ্তানি বেশি দেখিয়েছিল ইপিবি। একইভাবে পোশাক রপ্তানির হিসাবও বেশি দেখানো হয়েছিল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মোট ৩ হাজার ৬১৩ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়। এই রপ্তানি তার আগের অর্থবছরের তুলনায় ৫ দশমিক ৮৯ শতাংশ কম। আলোচ্য অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে বরাবরের মতো যুক্তরাষ্ট্রেই সর্বোচ্চ ৬৬২ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়। এ ছাড়া জার্মানিতে ৪৫২ কোটি, যুক্তরাজ্যে ৪২০ কোটি, স্পেনে ৩৩৮ কোটি ও ফ্রান্সে ২০২ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়।
জানতে চাইলে নিট পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক বর্তমানে প্রকৃত পোশাক রপ্তানির যে তথ্য দিচ্ছে, সেটি বিশ্বাসযোগ্য। যদিও সামনের দিনগুলোতে মূল্য সংযোজন কমবে বলে আমাদের আশঙ্কা। তার কারণ প্রণোদনা হ্রাস করার পর অনেকে সুতা আমদানিতে মনোযোগী হচ্ছেন। কারণ, প্রতি কেজি বিদেশি সুতা ব্যবহারে ২০-৩০ সেন্ট কম লাগছে। তা ছাড়া গ্যাস–সংকটের কারণেও অনেক উদ্যোক্তা সুতা ও কাপড় আমদানিতে মনোযোগী হচ্ছেন।’ এসব সমস্যার বিকল্প সমাধান না থাকলে মূল্য সংযোজন আরও কমবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।