রাজধানী ঢাকার অদূরে সাভার উপজেলার অধীন আশুলিয়ায় রয়েছে পোশাক খাতের প্রায় বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর অফিস কিংবা কারখানা।
সার্বিক দিক বিবেচনায় কমপ্লায়েন্ট বা মানে উত্তীর্ণ বলে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও রয়েছে অনেকগুলোর। সংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তাদেরও দাবি কারখানার কর্মীদের ন্যায্য সুযোগ-সুবিধা দিয়ে থাকেন তারা। কিন্তু তা দিয়েও লাভ হচ্ছে না। নিয়মিত বিরতিতে শ্রম অসন্তোষের কারণে বন্ধ রাখতে হচ্ছে কাজ। পোশাক শিল্প-কারখানার প্রেক্ষাপটে এটি একটি বড় ধরনের বিপর্যয়।
বিরাজমান শ্রম অসন্তোষের কারণে প্রায় ২১ দিন বন্ধ রাখতে হয়েছে ওই এলাকার একটি মাঝারি আকারের কারখানা (নাম প্রকাশ করতে চায়নি কর্তৃপক্ষ)। এ পরিস্থিতিতে ক্রয়াদেশ দেয়া নিয়ে অস্বস্তির মধ্যে রয়েছেন কারখানাটিতে নিয়মিত কাজ করানো এক বিদেশী ক্রেতা। আশুলিয়ার বাইরে অন্য এলাকায় কারখানা থাকলে ক্রয়াদেশ দিতে প্রস্তুত রয়েছেন বলে এরই মধ্যে জানিয়ে দেয়া হয়েছে।
শিল্প পুলিশের হিসাবে দেশের শিল্প অধ্যুষিত আশুলিয়া, গাজীপুর, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, ময়মনসিংহ, খুলনা, কুমিল্লা ও সিলেট—এ আট এলাকায় কারখানা রয়েছে নয় হাজারের বেশি। এর মধ্যে পোশাক কারখানা ৩ হাজার ৪২৬টি। পোশাক পণ্য প্রস্তুত ও রফতানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর হিসাবে দেশে সরাসরি রফতানি করা সক্রিয় কারখানা প্রায় ২ হাজার ২০০। যার উল্লেখযোগ্য অংশই আশুলিয়ায় অবস্থিত। কিন্তু ধারাবাহিক শ্রম অসন্তোষের জেরে এ এলাকায় ক্রয়াদেশ দিতে অনাগ্রহ প্রকাশ করছেন বিদেশী ক্রেতারা।
সাভারের আশুলিয়া অঞ্চলের তৈরি পোশাক কারখানাগুলোয় নিয়মিত বিরতিতে শ্রম অসন্তোষ চলমান রয়েছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে আশুলিয়া অঞ্চলের শিল্প মালিকদের নিয়ে স্বতন্ত্র একটি প্লাটফর্ম গঠন করা হয়েছে। এর নেতৃত্বে রয়েছেন বিজিএমইএর সহায়ক কমিটির সদস্য এনামুল হক খান বাবলু। জানতে চাইলে তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সবদিক বিবেচনায় আশুলিয়ার কারখানাগুলো দেশের সেরা। খুব রক্ষণশীল হিসাবেও পোশাক রফতানি বাবদ মোট আয়ের অন্তত ২৫ শতাংশ আসে এ এলাকার কারখানাগুলোর কাজের মাধ্যমে। অন্যান্য এলাকার কারখানাগুলো মজুরি ও সুযোগ-সুবিধার বিচারে করুণ দশা। তাই আশুলিয়া এলাকায় যখন কিছু ঘটে তখন বুঝতে হবে যে “সামথিং ইজ ভেরি রং”।’
আশুলিয়ার কারখানাগুলো নিয়ে ক্রেতারা বেশ অস্তস্তিতে আছেন জানিয়ে এনামুল হক খান বলেন, ‘ক্রয়াদেশ দেবে না—এ কথা না বলে তারা বলছে, দেশের মধ্যে অন্য এলাকায় ক্রয়াদেশ দিতে আগ্রহী। উদ্যোক্তাদের মধ্যে যাদের শিল্প অধ্যুষিত একাধিক এলাকায় কারখানা রয়েছে, তারা ক্রয়াদেশ ধরে রাখতে পারছেন। কিন্তু যাদের কারখানা শুধু আশুলিয়ায় তারা ক্রেতাদের অস্বস্তি নিয়ে ভীষণ বিপদের মধ্যে রয়েছেন।’
দেশের বাইরে অন্য দেশে ক্রয়াদেশ চলে যাচ্ছে, এ কথাটি আংশিক সঠিক, আংশিক ভুল—এ তথ্য জানিয়ে এনামুল হক খান বলেন, ‘অনেক ক্রয়াদেশ এখন চীন থেকে সরে যাচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই এগুলোর গন্তব্য হওয়ার কথা ছিল বাংলাদেশ। বিরাজমান পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের পাশাপাশি ভারত, ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়ায়ও সে ক্রয়াদেশ যাচ্ছে। ঢালাওভাবে সব ক্রয়াদেশ চলে যাচ্ছে এটি ঠিক নয়। কারণ কারখানাগুলো এখন ক্রয়াদেশে পরিপূর্ণ। সব কারখানায়ই উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্ডার রয়েছে। কিন্তু এর মানে এও না যে ভারতে ক্রয়াদেশ যাচ্ছে না। উদ্বৃত্ত হলে তা অন্যান্য গন্তব্যে যেতেই পারে। যুক্তরাষ্ট্রের নীতির প্রভাবে চীন থেকে প্রচুর ক্রয়াদেশ সরে যাচ্ছে বিধায় এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। আগে এ ধরনের পরিস্থিতিতে বেশির ভাগ ক্রয়াদেশ বাংলাদেশেই চলে আসত।’
বিজিএমইএর তথ্য অনুযায়ী, গতকাল ঢাকা ও চট্টগ্রামে সংগঠনটির সক্রিয় কারখানার মধ্যে সচল ছিল ২ হাজার ৯৩। শ্রম আইনের ১৩-এর (১) ধারায় বন্ধ ছিল ছয়টি। কারখানা খোলা রাখার পর কাজ বন্ধ, স্ব-বেতনে ছুটি বা শ্রমিক চলে গেছে এমন কারখানা ছিল তিনটি। এর মধ্যে আশুলিয়া এলাকায় গতকাল ১৩-এর (১) ধারায় বন্ধ কারখানাগুলো হলো এজে সুপার গার্মেন্টস লিমিটেড, এমএএম গার্মেন্টস লিমিটেড, ফিরোজা গার্মেন্টস লিমিটেড ও নাসা সুপার গার্মেন্টস লিমিটেড। শ্রমিকরা কাজ না করে চলে গেছেন বা কাজ বন্ধ রাখা হয় নাসা বেসিকস লিমিটেড ও বেক্সিমকো গ্রুপের কারখানায়।
সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বর্তমান শ্রমিক অসন্তোষের প্রেক্ষাপটে আশুলিয়ার অধিকাংশ কারখানায়ই ক্রেতারা আর ক্রয়াদেশ দিতে চাচ্ছেন না। সেগুলো ওইখান থেকে অন্য এলাকায় যাচ্ছে। অনেক মালিক আছেন যাদের আশুলিয়ায়ও কারখানা আছে, আবার অন্য এলাকায়ও রয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে তেমন সমস্যা হচ্ছে না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এখন আশুলিয়ার বাইরে যে মালিকের কারখানা নেই, তিনি হয়তো ক্রয়াদেশ পাবেন না বা কমে যাবে। তবে দেশের বড় ও ভালো কারখানাগুলো আশুলিয়ায়। ওই এলাকায় অসন্তোষের ইন্ধনদাতারা অন্য এলাকায়ও পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করতে চেষ্টা শুরু করে দিয়েছে। আজ (গতকাল) ১৩-এর (১) ধারায় চারটা কারখানা বন্ধ করে দিতে হয়েছে। যদিও কারখানাগুলো ক্রয়াদেশে পূর্ণ ছিল। যদি শ্রমিকরা কারখানায় প্রবেশ করে কার্ড পাঞ্চের পর কাজ না করে বসে থাকেন তাহলে তো চালু রেখে কোনো লাভ নেই। দাম কম হলেও এখন ক্রয়াদেশ ভালো আসছে কিন্তু কাজের পরিবেশের কারণে নেয়া যাচ্ছে না।’