তৈরি পোশাক খাতের বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের হিস্যা ধরে রাখতে কারখানাগুলোতে কার্বন নিঃসরণ হ্রাস অপরিহার্য। আর এর জন্য সরকারি নীতি সহায়তা এবং ব্র্যান্ড, ক্রেতা ও উৎপাদনকারীদের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি অংশীদারত্ব অত্যন্ত জরুরি বলে মন্তব্য করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
১৩ ডিসেম্বর (শুক্রবার) ঢাকায় বাংলাদেশ ওয়ার্কিং গ্রুপ অন এক্সটার্নাল ডেবট আয়োজিত দ্বিতীয় বাংলাদেশ এনার্জি প্রসপারিটি ২০৫০ সম্মেলনের সমাপনী দিনে বক্তারা এ কথা বলেন।
১১ ডিসেম্বর থেকে বিয়াম ফাউন্ডেশনে শুরু হওয়া তিন দিনব্যাপী এই অনুষ্ঠানে নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে রূপান্তর এবং বৈশ্বিক ও দেশীয় সংকটের মধ্যেও টেকসই বিদ্যুৎ নীতি অর্জনের ওপর জোর দেওয়া হয়।
বাংলাদেশের পোশাক ও পরিবহন খাতে কার্বন নিঃসরণ হ্রাস নিয়ে একটি সেশনে এথিক্যাল ট্রেডিং ইনিশিয়েটিভের প্রোগ্রাম এভিডেন্স অ্যান্ড লার্নিংয়ের সিনিয়র ম্যানেজার মুনির উদ্দিন শামীম পোশাক খাতে জ্বালানি রূপান্তর বিষয়ে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশের কার্বন নিঃসরণের গ্রাফ ঊর্ধ্বমুখী। ‘তৈরি পোশাক খাতে নিঃসরণ কমাতেই হবে আমাদের ব্যবসা ধরে রাখতে। আর কোনো বিকল্প নেই।’
ইউরোপে কার্যকর হতে যাওয়া নতুন আইন ‘হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ডিউ ডিলিজেন্স’-এর (এইচআরইডিডি) প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ২০২৭ সালের পর আইনটি যখন বাস্তবায়ন শুরু হবে, তখন সব ব্র্যান্ডের জন্যই এ আইন মানা বাধ্যতামূলক হবে।
আন্তর্জাতিক এবং জাতীয় বিধিমালা ও নীতিমালার উপস্থাপনায় জানানো হয়, বর্তমানে অনেক ক্রেতাকেই নবায়নযোগ্য জ্বালানি সার্টিফিকেট (আরইসি) দেখাতে হয়।
এথিক্যাল ট্রেডিং ইনিশিয়েটিভ (ইটিআই) হলো ট্রেড ইউনিয়ন, এনজিও ও কোম্পানিগুলোর একটি জোট, যা বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খলে মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নয়নে কাজ করে।
মুনির উদ্দিন শামীম জানান, বর্তমানে বাংলাদেশে ২০০টির বেশি পোশাক কারখানা লিড সনদপ্রাপ্ত—যা শিল্পের মোট ইউনিটের ৪ শতাংশ। এই সনদপ্রাপ্ত কারখানাগুলো সবুজ কারখানা হিসেবে বিবেচিত।
তিনি বলেন, ক্রেতারা এখন পণ্যের গুণগত মানের পাশাপাশি এর উৎপাদন প্রক্রিয়াজুড়ে যে শ্রমিক জড়িত, তাদের অধিকার রক্ষা হচ্ছে কি না সেটিও দেখছে।
‘তাই ইউরোপীয় বাজার ধরতে উৎপাদনকারীকে কমপ্লায়েন্স মেনে চলতে হবে। আমাদের লিড সার্টিফাইড পোশাক কারখানা আরও বাড়াতে হবে।’
ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) জোট হিসেবে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি বাজার। দেশের মোট রপ্তানি আয়ের ৫০ শতাংশের বেশি আসে ইইউ অঞ্চল থেকে। আর দেশের মোট রপ্তানি আয়ের ৮০ শতাংশের বেশি আসে তৈরি পোশাক শিল্প থেকে।
ইউরোপের শীর্ষস্থানীয় ফ্যাশন ব্র্যান্ড লিন্ডেক্স।
লিন্ডেক্স বাংলাদেশের লিয়াজোঁ অফিসের দক্ষিণ এশিয়ার টেকসই উন্নয়ন ব্যবস্থাপক কাজী মোহাম্মদ ইকবাল হোসেন বলেন, লিন্ডেক্স একটি সুইডিশ ব্র্যান্ড। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, ভিয়েতনাম, তুরস্ক, চীন, হংকং, ইতালিসহ বিভিন্ন দেশে রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির উৎপাদন অফিস আছে।
তিনি বলেন, ইউরোপীয় ভোক্তারা মূল্যের চেয়ে উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত সামাজিক ও পরিবেশগত বিষয়গুলোকে অগ্রাধিকার দেয়। পণ্য যে অঞ্চলে তৈরি হচ্ছে, সেই অঞ্চলের মানুষের ওপর এর প্রভাব সম্পর্কে তারা সতর্ক।
‘তারা দেখে এসব ব্র্যান্ডকে যারা পণ্য সরবরাহ করে, তারা কতটা টেকসই—যাকে আমরা বলি “গ্রিন ক্লেইমস”। এটা প্রতিষ্ঠানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ,’ বলেন তিনি।
ইকবাল আরও বলেন, ইউরোপীয় বাজারে গত দুই-তিন বছরে কর্পোরেট সাসটেইনেবিলিটি ডিউ ডিলিজেন্স ডিরেক্টিভ, এক্সটেন্ডেড প্রোডিউসার রেসপন্সিবিলিটি-র (ইপিআর) মতো অনেক নতুন আইন প্রনণয়ন হয়েছে। এসব আইনের অধীনে ২০২৬ থেকে ২০২৮ সালের মধ্যে সামাজিক ও পরিবেশগত নীতিমালা মেনে পণ্য বিক্রি বাধ্যতামূলক হয়ে যাবে।
তিনি আরও বলেন, টেকসই পরিবেশ তৈরি এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় অবদান রাখতে ২০৩০ সালের মধ্যে ৫০ শতাংশ কার্বন নির্গমন কমানোর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ হয়েছে। ‘এই লক্ষ্য অর্জনে বাংলাদেশকে দ্রুত কাজ করতে হবে।’
বাংলাদেশের প্রধান প্রতিযোগী দেশ ভিতেনাম, কম্বোডিয়া, ভারত, পাকিস্তান নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে অত্যন্ত সক্রিয়ভাবে কাজ করছে। লিন্ডেক্স বাংলাদেশের কর্মকর্তা সতর্ক করে বলেন, ‘তারা যদি ২০৩০-এর মধ্যে কার্বন নির্গমন কমানোর লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারে আর বাংলাদেশ যদি না করতে পারে, তাহলে বাংলাদেশ কম মূল্যে পণ্য দিলেও এখান থেকে পণ্য কিনবে না।’
‘কারণ ইউরোপে যদি পণ্য বিক্রি করতে না দেয়া হয়, তাহলে বাংলাদেশ থেকে পণ্য কেনার কোনো মানে হয় না,’ বলেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, ‘ইউরোপীয় ক্রেতাদের প্রভাবিত করার জন্য পণ্য ছাড়ের চেয়ে আপনি সামাজিক এবং পরিবেশগত কী ধরনের এক্সিলেন্স করছেন, এটা বড় ধরনের মার্কেটিং টুল। আমরা কার্বন নিঃসরণ কত শতাংশ কমাচ্ছি, সেটা আমাদের বড় মার্কেটিং টুল।’
সেশনে বক্তব্য রাখতে গিয়ে ক্লাইমেট-টেক কোম্পানি সলশেয়ার-এর ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড ইনোভেশনের পরিচালক সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ কার্বন নিঃসরণ দ্রুত কমাতে সমন্বিত প্রচেষ্টা এবং সৌরশক্তি বৃদ্ধির ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে এথিক্যাল ট্রেডিং ইনিশিয়েটিভের প্রোগ্রাম এভিডেন্স অ্যান্ড লার্নিং বিভাগের সিনিয়র ম্যানেজার মুনির উদ্দিন শামীম ব্র্যান্ড, ক্রেতা এবং সরবরাহকারীদের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্ক তৈরি, দায়িত্বশীল ক্রয়ের চর্চা, জ্বালানি রূপান্তরকে মূলধারায় আনা, জলবায়ু ইস্যুতে যৌথ দায়িত্ব গ্রহণ এবং প্রযুক্তিগত দক্ষতার ওপর জোর দেন।
অন্য সুপারিশগুলোর মধ্যে রয়েছে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগগুলোকে (এসএমই) সহায়তা দেওয়া; সরকার, ক্রেতা ও কারখানার মধ্যে কার্যকর সেতুবন্ধন তৈরি করা; সব কারখানার জন্য সাসটেইনিবিলিটি রিপোর্টিং বাধ্যতামূলক করা; সচেতনতা ও সক্ষমতা বাড়ানো এবং নীতি সহায়তা।
মুনির উদ্দিন শামীম অর্থনৈতিক কূটনীতি শক্তিশালী করা, সহজ অর্থায়ন প্রাপ্তি, শিল্প খাতে কার্বন নিঃসরণ কয়ামতে বাজেট বরাদ্দ, কর অব্যাহতি এবং সরকারের নীতিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তার সুপারিশ করেন।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি ফজলে শামীম এহসান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, ইউরোপের বাজারে বাংলাদেশের অবস্থান আরও শক্তিশালী করার জন্য তারা কাজ শুরু করে দিয়েছেন। ‘প্রতিটি কারখানাকে জ্বালানি সাশ্রয়ী করার জন্য আমরা কাজ করছি।’
তিনি জানান, একটি পাইলট প্রকল্পও নেওয়া হয়েছে। এর আওতায় প্রতিটি কারখানাr একটি ম্যাপিং করা হবে, তারা এখন কোথায় আছে।
ফজলে শামীম আরও বলেন, তারা একটি সফটওয়ার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথা বলেছেন। ইন্টারন্যাশনাল অ্যাপারেল ফেডারেশনের সঙ্গেও যোগাযোগ করেছেন। ‘বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ একসঙ্গে কাজ করছে। এর জন্য আমরা ক্রেতাদের কাছেও ফান্ড চাচ্ছি।’
তিনি জানান, তাদের প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রতি পিস পোশাক তৈরিতে কতটুকু কার্বন নিঃসরণ হয়, তা জানতে একটি গবেষণা পরিচালনা করা হবে। ‘ইউরোপীয় ইউনিয়ন যখন বলবে এই পণ্যর জন্য এতটুকু কার্বন নিঃসরণ করা করা যাবে, তখন সেই অনুযায়ী নিঃসরণ কমানোতে কাজ করা হবে।’
ফজলে এলাহি বলেন, ‘আমাদের এর জন্য সরকারের সহায়তা প্রয়োজন । সরকার যেন দ্রুত স্মার্ট গ্রিড করে। সেখান থেকে আমরা গ্রিন এনার্জি কিনতে পারব। আমার কাছে হিসাব থাকবে কতটুকু গ্রিন এনার্জি আমি ব্যবহার করেছি।’