কোনো কারখানার ১৫ শতাংশ শ্রমিক একমত হলেই সেখানে ট্রেড ইউনিয়ন গঠন করা যাবে। এমন বিধান যুক্ত করে শ্রম আইন সংশোধন করা হচ্ছে। বর্তমান আইনে ট্রেড ইউনিয়ন করার ক্ষেত্রে ২০ শতাংশ শ্রমিকের সম্মতির বিধান রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সংশোধিত শ্রম আইনে সংযোজন, বিয়োজন ও নতুন মিলিয়ে শতাধিক ধারায় পরিবর্তন আসছে। এর মধ্যে কিছু ধারা নতুন করে যুক্ত হচ্ছে, কিছু বাদ দেওয়া হচ্ছে। আর কিছু ধারা সংশোধন করা হচ্ছে। এসব বিষয়ে একমত হয়েছে শ্রম আইন সংশোধনে গঠিত ত্রিপক্ষীয় পরামর্শ পরিষদ (টিসিসি)।
সরকারের পক্ষ থেকে ১৫ শতাংশ শ্রমিকের সম্মতির কথা বলা হলেও শ্রমিক সংগঠনগুলো চায় ২০ জন শ্রমিকের সম্মতিতে ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার। আর আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) চায় ট্রেড ইউনিয়ন করার ক্ষেত্রে কোনো সুনির্দিষ্টসংখ্যক শ্রমিকের সম্মতির বিধান না থাকুক।
২০০৬ সালে শ্রম আইন প্রণয়নের পর এবার তৃতীয় দফায় তা সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর আগে ২০১৩ ও ২০১৮ সালে দুই দফা আইনটি সংশোধন করা হয়েছিল। শ্রম আইন সংশোধনে সম্প্রতি শ্রম উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেনকে সভাপতি করে ৬০ সদস্যের নতুন টিসিসি গঠিত হয়েছে। সরকার, মালিক ও শ্রমিক তিন পক্ষের ২০ জন করে মোট ৬০ সদস্য রয়েছেন টিসিসিতে। এর সহসভাপতি শ্রমসচিব এ এইচ এম সফিকুজ্জামান। তাঁর সভাপতিত্বে গত ৮, ১৫ ও ২৯ জানুয়ারি তিন দফা বৈঠক হয়েছে। আজ ৪ ফেব্রুয়ারি শ্রম উপদেষ্টার সভাপতিত্বে বৈঠকে সংশোধিত আইনের চূড়ান্ত খসড়া তৈরির কথা রয়েছে।
শ্রমিকদের জন্য গঠিত অংশগ্রহণ তহবিলের ব্যবহারের বিধানেও পরিবর্তন আনা হচ্ছে। বিদ্যমান নিয়মে বলা আছে, প্রতিবছর এই তহবিলে জমা অর্থের দুই-তৃতীয়াংশ সমান অনুপাতে সব সুবিধাভোগীর মধ্যে নগদে বণ্টন করা হবে। বাকি এক-তৃতীয়াংশ বিনিয়োগ করা যাবে, যার মুনাফা সব সুবিধাভোগীর মধ্যে সমান হারে বণ্টন করা হবে। এখন বলা হয়েছে, প্রতিবছর এই তহবিলে জমা অর্থ সমান অনুপাতে সব সুবিধাভোগীর মধ্যে বণ্টন করা হবে।
টিটিসির পক্ষ থেকে এরই মধ্যে আইনে আরও যেসব সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে—কোনো ট্রেড ইউনিয়নের সভাপতিসহ শীর্ষ নেতাদের এক জেলা থেকে অন্য জেলায় বদলি করা যাবে না। বর্তমান আইনে এ ধরনের ব্যক্তিদের বদলি করতে না পারার বিধান রয়েছে। এ ছাড়া কোনো শ্রমিককে অন্যায্যভাবে বরখাস্ত করা হলে সরকার তাঁকে চাকরিতে পুনর্বহালের নির্দেশ দিতে পারবে বলেও বিধান যুক্ত করা হচ্ছে। যদি কোনো কারখানা কর্তৃপক্ষ চাকরি পুনর্বহালে ব্যর্থ হয়, তাহলে সংশ্লিষ্ট শ্রমিককে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণের আদেশ দিতে পারবে সরকার। ট্রেড ইউনিয়নের মেয়াদ হবে দুই বছরের পরিবর্তে তিন বছর।
শ্রম আইন নিয়ে কাজ করা আইনজীবী জাফরুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, আইএলও ও শ্রমিকপক্ষ চায় সহজে ট্রেড ইউনিয়ন করার সুযোগ। মালিকপক্ষের সহযোগিতা না থাকলে যত শিথিলই করা হোক না কেন, তা কার্যকর হবে না। তিনি মনে করেন, সরকারের সদিচ্ছার অভাব ও মালিকপক্ষের অসহযোগিতার কারণেই বিদ্যুৎসহ অনেক খাতের ট্রেড ইউনিয়নের নিবন্ধন ঝুলে আছে।
শ্রমিকদের জন্য গঠিত অংশগ্রহণ তহবিলের ব্যবহারের বিধানেও পরিবর্তন আনা হচ্ছে। বিদ্যমান নিয়মে বলা আছে, প্রতিবছর এই তহবিলে জমা অর্থের দুই-তৃতীয়াংশ সমান অনুপাতে সব সুবিধাভোগীর মধ্যে নগদে বণ্টন করা হবে। বাকি এক-তৃতীয়াংশ বিনিয়োগ করা যাবে, যার মুনাফা সব সুবিধাভোগীর মধ্যে সমান হারে বণ্টন করা হবে। এখন বলা হয়েছে, প্রতিবছর এই তহবিলে জমা অর্থ সমান অনুপাতে সব সুবিধাভোগীর মধ্যে বণ্টন করা হবে।
সংশোধনের ব্যাপারে চূড়ান্ত খসড়া দাঁড় করানোর কাজ চলছে। এরপর তা যাবে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে।
শ্রমসচিব এ এইচ এম সফিকুজ্জামান
সংশোধিত আইনে বলা হয়েছে, বেসরকারি যেসব প্রতিষ্ঠানে ১০০ জন স্থায়ী শ্রমিক থাকবেন, সেখানে ভবিষ্য তহবিল (প্রভিডেন্ট ফান্ড) গঠন বাধ্যতামূলক। বর্তমানে তিন-চতুর্থাংশ শ্রমিকের লিখিত আবেদনের ভিত্তিতে এ ধরনের তহবিল গঠনের বিধান রয়েছে।
শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, প্রস্তাবিত সংশোধনীর ১০১ ধারার মধ্যে ৭৯টির ব্যাপারেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে টিসিসি। ২২টির ব্যাপারে ফায়সালা হয়নি।
শ্রমসচিব এ এইচ এম সফিকুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, সংশোধনের ব্যাপারে চূড়ান্ত খসড়া দাঁড় করানোর কাজ চলছে। এরপর তা যাবে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে। উপদেষ্টা পরিষদ অনুমোদন করলেই সংশোধিত আইনটি অধ্যাদেশ আকারে জারি হবে। তিনি বলেন, ‘আগামী মাসের মধ্যেই এটি করার পরিকল্পনা রয়েছে। জেনেভায় আইএলও কার্যালয়ে আমরা মার্চের কথাই বলে এসেছি।’
নারীশ্রমিকের জন্য যেসব পরিবর্তন
নারীশ্রমিকদের প্রসূতি ছুটি ১১২ দিনের পরিবর্তে ১২০ দিন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বর্তমান আইনে আছে, নারীশ্রমিক সন্তান প্রসবের ৫৬ দিনের মধ্যে কোনো কাজ করবেন না। সেটি এখন ৬০ দিন করা হচ্ছে।
বর্তমানে চা–বাগানের ক্ষেত্রে মজুরিসহ বার্ষিক ছুটি রয়েছে প্রতি ২২ দিন কাজের জন্য এক দিনের। নতুন নিয়মে হবে প্রতি ১৮ দিনের জন্য এক দিনের। উৎসব ছুটিও দুই দিন বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। প্রতি পঞ্জিকাবর্ষে প্রত্যেক শ্রমিকের উৎসব ছুটি হবে ১১ দিনের পরিবর্তে ১৩ দিন।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের সভাপতি কল্পনা আক্তার বলেন, ছোটখাটো কিছু ধারা সংশোধনের মাধ্যমে আপাতদৃষ্টে মনে করা হচ্ছে, নারীশ্রমিকের সুবিধা বাড়ছে। কিন্তু নারীশ্রমিকদের প্রসূতি ছুটিবিষয়ক ধারাটি যেভাবে বদল করা হচ্ছে, তাতে তাদের মজুরি কমে যেতে পারে। তিনি শ্রম কমিশনের প্রতিবেদন জমা হওয়ার পর শ্রম আইন সংশোধনের পক্ষে। তাঁর মতে, কমিশনের প্রতিবেদনে অনেক সুপারিশ উঠে আসার কথা, যা শ্রম আইন সংশোধনে সহায়ক হবে।
শ্রমিকের প্রতি বৈষম্য নয়
‘শ্রমিকদের প্রতি বৈষম্য নিষিদ্ধ’ নামে একটি নতুন ধারা যুক্ত করা হচ্ছে। বলা হয়েছে, কোনো নিয়োগকর্তা কোনো কর্মীর সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ করতে পারবেন না। জাতি, বর্ণ, লিঙ্গ, ধর্ম, রাজনৈতিক মতামত, জাতীয়তা, সামাজিক অবস্থান, বংশ বা প্রতিবন্ধিতার কারণে কোনো ব্যক্তিকে আলাদা করা, বাদ দেওয়া বা কম গুরুত্ব দেওয়া যাবে না।
কারখানায় শিশু-কিশোরদের নিয়োগের জন্য দণ্ড ৫ হাজার টাকার পরিবর্তে হবে ২৫ হাজার টাকা এবং বেআইনি ধর্মঘটের জরিমানা ৫ হাজার টাকার বদলে ২০ হাজার টাকা করার কথা বলা হয়েছে।
মালিকপক্ষের প্রতিনিধি বাংলাদেশ নিট পোশাক উৎপাদক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম প্রথম আলোকে বলেন, আইএলও চায় ট্রেড ইউনিয়নের সহজীকরণ। সে জন্য ১০ জন মিলেও যাতে ট্রেড ইউনিয়ন করা যায়, এটা তারা চায়। এমনকি শ্রমিকেরাও তা চান। কারখানার মালিকেরা ১৫ শতাংশে রাজি হয়েছেন। সংখ্যায় করা হলে তা বাস্তবসম্মত হবে না।
ভবিষ্য তহবিল বাধ্যতামূলক করার বিষয়ে মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘এটা ঠিক হবে না। এমনকি শ্রমিকেরাও তা চান না। এ রকম ১৫টির মতো বিষয়ে আমরা এখন পর্যন্ত একমত হইনি। আমাদের মতামত ছাড়াও সরকার আইন সংশোধন করতে পারে। সে ক্ষেত্রে আমাদের কারখানা গুটিয়ে চলে যেতে হবে।’
মালিক-শ্রমিক মিলে শ্রম আইনের ১০১টি ধারা নিয়ে কাজ হচ্ছে, যা ইতিবাচক। তবে আইনটি এখনো আন্তর্জাতিক মানের বা সর্বজনীন হচ্ছে না। অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে না শ্রমিকদের ন্যূনতম অধিকারকে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান আহমেদ
যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউ যা চায়
যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধির (ইউএসটিআর) দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া অঞ্চলের একটি দল গত বছরের এপ্রিলে বাংলাদেশের শ্রম অধিকার পরিস্থিতির উন্নয়নে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে একটি কর্মপরিকল্পনা জানিয়ে যায়। ১১ দফার ওই কর্মপরিকল্পনার প্রথমটিই হচ্ছে ট্রেড ইউনিয়ন নেতা, শ্রমিক ও শ্রম অধিকারকর্মীদের যাঁরা নিপীড়ন করেন ও সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালান, তাঁদের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া।
এরপরই রয়েছে শ্রমিক নেতা ও শ্রমিকদের বিরুদ্ধে কাজ করে, এমন কারখানার মালিক ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকে জবাবদিহির আওতায় আনা। এ ছাড়া রয়েছে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ট্রেড ইউনিয়নগুলো যে মানের অধিকার ভোগ করে, সে অনুযায়ী বাংলাদেশের শ্রম আইন ও বিদ্যমান শ্রমবিধি সংশোধন।
আরও রয়েছে বাংলাদেশের রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলগুলোর (ইপিজেড) শ্রমিকেরা যাতে পুরোদমে ট্রেড ইউনিয়ন করতে পারেন, সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ; শিশুশ্রম বিলোপ ও শ্রমিকবিরোধী সব ধরনের সহিংসতা নিরসনসহ শ্রমিকবান্ধব শ্রম আইন করা ইত্যাদি। ইউরোপীয় ইউনিয়নও (ইইউ) প্রায় একই ধরনের কথা বলে আসছে।
সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে জানতে চাইলে শ্রমিক অধিকার-সংক্রান্ত গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান আহমেদ বলেন, মালিক-শ্রমিক মিলে শ্রম আইনের ১০১টি ধারা নিয়ে কাজ হচ্ছে, যা ইতিবাচক। তবে আইনটি এখনো আন্তর্জাতিক মানের বা সর্বজনীন হচ্ছে না। অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে না শ্রমিকদের ন্যূনতম অধিকারকে।