যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে এককভাবে পোশাক রপ্তানিতে শীর্ষে রয়েছে চীন। চীনের বড় শক্তি সস্তা পোশাক আর পোশাকের বৈচিত্র্য। চীনের চেয়ে দামি পোশাক রপ্তানি করলেও শুধু বৈচিত্র্যের কারণে দ্বিতীয় অবস্থানে ভিয়েতনাম। যদিও চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে দেশটি চীনকে টপকে গেছে। বাংলাদেশের বড় শক্তি সুতার কাপড়ের পোশাক রপ্তানি। তবে তুলাবিহীন পোশাকে বৈচিত্র্য কম। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের মতো বড় বাজারে বাংলাদেশ ঘুরেফিরে তৃতীয় অবস্থানে আটকে আছে।
যুক্তরাষ্ট্র গত বছর বিশ্বের ২০০ দেশ থেকে ৮ হাজার ১৩২ কোটি ডলারের ৬৩৯ ক্যাটাগরি বা ধরনের পোশাক আমদানি করেছে। এর মধ্যে চীন সবচেয়ে কম দামে অর্থাৎ প্রতি পিস ২ দশমিক ৬২ মার্কিন ডলার দামে তৈরি পোশাক রপ্তানি করেছে। তারপরই রয়েছে বাংলাদেশ, ৩ দশমিক ৯১ ডলার। সস্তা পোশাক রপ্তানিতে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকলেও বৈচিত্র্যের ধরনে অনেক পিছিয়ে বাংলাদেশ। চীন ৬২৮টি, ভিয়েতনাম ৫২১ ও ভারত ৫৫৯ ধরনের পোশাক রপ্তানি করলেও বাংলাদেশ করেছে ৪৬১ ধরনের তৈরি পোশাক। যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কমিশনের তথ্যভান্ডার থেকে এমন তথ্য মিলেছে।
বাণিজ্য–ঘাটতি কমাতে যুক্তরাষ্ট্র যেসব দেশ থেকে পণ্য আমদানি করে, সেসব দেশের ওপর গত ২ এপ্রিল ন্যূনতম ১০ শতাংশ পাল্টা শুল্ক বা রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ আরোপ করেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ৫৭ দেশের ওপর বিভিন্ন হারে বাড়তি পাল্টা শুল্ক বসানো হয়। ৯ এপ্রিল পাল্টা শুল্ক কার্যকরের দিন অনেকটা ‘ইউটার্ন’ করে তা তিন মাসের জন্য স্থগিত করেন ট্রাম্প। যদিও সব দেশের ওপর ন্যূনতম ১০ শতাংশ পাল্টা শুল্ক কার্যকর করা হয়।
সস্তা পোশাকে শীর্ষে চীন, দ্বিতীয় বাংলাদেশ
যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি তথ্যভান্ডারের সংরক্ষিত শীর্ষ পাঁচ রপ্তানিকারক দেশের পরিসংখ্যান তুলনা করে দেখা যায়, গত বছর চীন গড়ে প্রতি পিস পোশাক ২ ডলার ৬২ সেন্টে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করেছে। ভিয়েতনাম প্রতি পিস পোশাক রপ্তানি করেছে ৪ ডলার ৬২ সেন্টে। বাংলাদেশের প্রতি পিসের রপ্তানি মূল্য ছিল ৩ ডলার ৬৩ সেন্ট। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শীর্ষ পাঁচ রপ্তানিকারক দেশের মধ্যে বেশি দরে পোশাক রপ্তানি করেছে ইন্দোনেশিয়া। তারা প্রতি পিস পোশাক রপ্তানি করেছে ৫ ডলার ৪৬ সেন্ট। মোজা ও গ্লাভস ছাড়া এই হিসাব করা হয়েছে।
চার ধরনের পোশাকের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, চীন গড়ে প্রতি পিস ট্রাউজার বা প্যান্টজাতীয় পোশাক রপ্তানি করছে ৩ ডলার ৭৮ সেন্টে। বাংলাদেশের রপ্তানি প্রতি পিস ৫ ডলার ১৮ সেন্ট। এ ক্ষেত্রে চীন গত বছর ২২৯ কোটি ডলারের ট্রাউজার রপ্তানি করেছে, বাংলাদেশের রপ্তানি ৩০৭ কোটি ডলারের। অবশ্য ভিয়েতনাম প্রতি পিস ট্রাউজার ৫ ডলার ৮৪ সেন্টে রপ্তানি করেছে। দেশটি গত বছর যুক্তরাষ্ট্রে ৩৮৯ কোটি ডলারের ট্রাউজার রপ্তানি করেছে।
শার্ট রপ্তানিতেও চীনের চেয়ে বেশি দাম পাচ্ছে বাংলাদেশ। গত বছর বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ৮০ কোটি ডলারের শার্ট রপ্তানি করে। প্রতি পিস শার্টের গড় রপ্তানি মূল্য ছিল ৪ ডলার ৮৮ সেন্ট। চীন গড়ে ৪ ডলার ৬২ সেন্টে প্রতি পিস শার্ট রপ্তানি করেছে। অবশ্য ভিয়েতনাম বেশি দামে শার্ট রপ্তানি করেছে, প্রতি পিস ৬ ডলার ৮৯ সেন্ট। আর ইন্দোনেশিয়ার রপ্তানি করা শার্টের গড় মূল্য ছিল ৬ ডলার ৯০ সেন্ট।
টি-শার্ট ও সোয়েটার রপ্তানিতে দামের ক্ষেত্রে চীনের চেয়ে পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ। সবচেয়ে সস্তা টি-শার্ট রপ্তানি করে বাংলাদেশ। প্রতি পিসের গড় রপ্তানি মূল্য ১ ডলার ৬৬ সেন্ট। চীনের রপ্তানি করা টি–শার্টের গড় মূল্য ১ ডলার ৭৬ সেন্ট। ভিয়েতনাম প্রতি পিস টি–শার্ট ২ ডলার ৭৪ সেন্টে রপ্তানি করে। অন্যদিকে বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হওয়া প্রতি পিস সোয়েটারের গড় মূল্য ৩ ডলার ৯৪ সেন্ট। বাংলাদেশের প্রধান দুই প্রতিযোগী চীন ও ভিয়েতনাম সোয়েটারে এগিয়ে।
বৈচিত্র্যে এগিয়ে চীন-ভিয়েতনাম
যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে গত বছর বাংলাদেশ ৪৬১ ধরনের তৈরি পোশাক (আট সংখ্যার এইচএসকোড) রপ্তানি করেছে। এই সংখ্যা চীনের ৬২৮, ভিয়েতনামের ৫২১ ও ভারতের ৫৫৯। পোশাক ও কাপড়ভেদে ধরন বিভাজন করা হয়। বাংলাদেশ পিছিয়ে থাকার পেছনে মূল কারণ পোশাকে কম বৈচিত্র্য।
যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হয় ম্যান মেইড ফাইবার (এমএমএফ) বা কৃত্রিম তন্তুর কাপড়ে তৈরি পোশাক। এই পোশাক রপ্তানিতে শীর্ষে রয়েছে চীন। গত বছর দেশটি ১ হাজার ৩৩১ ডলারের কৃত্রিম তন্তুর পোশাক রপ্তানি করেছে। অন্যদিকে ভিয়েতনাম রপ্তানি করেছে ৯৩৫ কোটি ডলারের পোশাক।
বাংলাদেশের অবস্থান ঠিক উল্টো। গত বছর বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে যত পোশাক রপ্তানি করেছে তার ২৯ শতাংশ ছিল কৃত্রিম তন্তুর পোশাক। তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশের পেছনে থাকা ভারতের হার আরও কম, ২৬ শতাংশ। তার মানে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হওয়ার মোট তৈরি পোশাকের ৭১ শতাংশ তুলার (কটন) তৈরি, ভারতের এই হার ৭৪ শতাংশ। তার মানে বাংলাদেশ-ভারত উভয় দেশই কৃত্রিম তন্তুর পোশাক রপ্তানিতে চীন-ভিয়েতনামের চেয়ে পিছিয়ে।
তৈরি পোশাকের বৈচিত্র্যের কারণে চীন-ভিয়েতনাম কীভাবে এগিয়ে গেছে তার একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। চীন গত বছর যুক্তরাষ্ট্রে ১১৬ কোটি ডলারের মোজা রপ্তানি করেছে। বেশির ভাগই নন কটন। বাংলাদেশ এই পণ্য রপ্তানি করেছে ৫ লাখ ডলারের। ভিয়েতনামের রপ্তানি প্রায় ১২ কোটি ডলার।
কৃত্রিম তন্তুর তৈরি সোয়েটারজাতীয় পোশাক রপ্তানিতে শীর্ষে চীন ও ভিয়েতনাম। গত বছর চীন ৮৬ ও ভিয়েতনাম ৭৫ কোটি ডলারের সোয়েটার রপ্তানি করেছে, যেখানে বাংলাদেশের রপ্তানি মাত্র ১৫ কোটি ৬৪ লাখ ডলার। গ্লাভস রপ্তানিতেও এগিয়ে চীন। গত বছর প্রায় ৭২ কোটি ডলারের গ্লাভস রপ্তানি করেছে দেশটি, যেখানে বাংলাদেশ করেছে ২ কোটি ডলারের কম।
তথ্যভান্ডার অনুযায়ী, ৩৪১ ধরনের পোশাকে শীর্ষ স্থানে রয়েছে চীন। ভিয়েতনাম ৮৯ ধরনের পোশাকে শীর্ষে। এই পোশাকের বড় অংশই কৃত্রিম তন্তুর। বাংলাদেশ শীর্ষে রয়েছে ২৫ ধরনের পোশাকে। তার বেশির ভাগই কটন পোশাক।
বিষয়টি নিশ্চিত করে স্প্যারো গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শোভন ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, চীনের রপ্তানিকারকেরা ৫০০ থেকে ৩ হাজার পিসের ক্রয়াদেশের পোশাক তৈরি করে। পাশাপাশি লাখ লাখ পিসের বড় ক্রয়াদেশের কাজও করে। বাংলাদেশের কারখানাগুলোর চীনের মতো বড় ক্রয়াদেশের পোশাক উৎপাদন করার সক্ষমতা থাকলেও ছোট ক্রয়াদেশে মুনাফা করতে পারে না। অনেক চীনা কোম্পানি যুক্তরাষ্ট্রে গুদামে পোশাক মজুত করে ক্রেতাদের সরবরাহ করে। সব মিলিয়েই তাই চীন আমাদের থেকে কম দামে পোশাক উৎপাদন করতে পারে।
শক্তির জায়গা দুর্বল হচ্ছে
গত বছর যুক্তরাষ্ট্র ৬৩৯ ধরনের পোশাক আমদানি করেছে। এর মধ্যে শীর্ষ স্থানে রয়েছে কটন ট্রাউজার। এই পণ্য সবচেয়ে বেশি রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। গত বছর ১৪৪ কোটি ডলারের কটন ট্রাউজার রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। শীর্ষে থাকা পণ্যটির রপ্তানি গত বছরের চেয়ে সামান্য কম। তার মানে বাংলাদেশের শক্তির জায়গা দুর্বল হতে শুরু করেছে।
পরিমাণ ও শতাংশের হারের তুলনা করে দেখা গেছে, কটন পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশের বড় প্রতিদ্বন্দ্বী ভারত। দুই দেশেরই তুলার কাপড়ের পোশাকে নির্ভরতা বেশি। অন্যদিকে পরিমাণের হিসাবে তুলার কাপড়ের পোশাক রপ্তানিতে শীর্ষে রয়েছে ভিয়েতনাম। দেশটি গত বছর কটন পোশাক রপ্তানি করেছে ৫৭৬ কোটি ডলারের। বাংলাদেশের রপ্তানি ছিল ৫৭০ কোটি ডলারের।
বৈশ্বিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান প্রাইসওয়াটারহাউসকুপারসের (পিডব্লিউসি) এক গবেষণায় বলেছে, ২০৩০ সালের মধ্যে বৈশ্বিক পোশাক রপ্তানি বেড়ে ১ হাজার ১২১ বিলিয়ন বা ১ লাখ ১২ হাজার ১০০ কোটি মার্কিন ডলার ছাড়াবে। সেখানে কৃত্রিম তন্তু দিয়ে তৈরি পণ্যের হিস্যা হবে ৬০ শতাংশ। এখানে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে।
পরামর্শক প্রতিষ্ঠানটি বলছে, প্রতিযোগী দেশগুলোর মধ্যে বর্তমানে (২০২২ সালের হিসাব) চীন, ভিয়েতনাম, তুরস্ক ও ইতালি কৃত্রিম তন্তুর পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে। এর মধ্যে মোট পোশাক রপ্তানির বিপরীতে কৃত্রিম তন্তুর পোশাকে চীনের হিস্যা ৬২ শতাংশ, ভিয়েতনামের ৫৬ শতাংশ, তুরস্কের ৪৮ শতাংশ ও ইতালির ৪৪ শতাংশ। অন্যদিকে বাংলাদেশের মোট তৈরি পোশাক রপ্তানির ২৭ শতাংশ কৃত্রিম তন্তুর পণ্য।
করণীয় কী
তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বৈচিত্র্য বাড়াতে হলে কৃত্রিম তন্তুতে জোর দেওয়ার ওপর গুরুত্বারোপ করেন বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, কৃত্রিম তন্তুর পোশাকের রপ্তানি বাড়ানো গেলে রপ্তানি আয় বাড়বে। এ ধরনের পোশাকের দাম তুলনামূলক বেশি। বৈশ্বিক বাজার হিস্যাও দিন দিন বাড়ছে। যদিও আমাদের স্থানীয় উদ্যোক্তারা তুলা থেকে কৃত্রিম তন্তুর পোশাকে যাওয়ার জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত নন। ফলে যাঁরা প্রস্তুত, তাঁদের বিনিয়োগে উৎসাহ দিতে হবে।
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, পণ্যের বৈচিত্র্য আনতে হলে বিনিয়োগেও বৈচিত্র্য আনতে হবে। বর্তমানে সব পণ্য ও বাজারে প্রণোদনা দেয় সরকার। দেশি সুতা ব্যবহারেও প্রণোদনা দেওয়া হয়। এই প্রণোদনাকাঠামো পরিবর্তন করতে হবে। কৃত্রিম তন্তুর পোশাক রপ্তানিতে প্রণোদনা দিতে হবে। তাহলে কৃত্রিম তন্তুর তৈরি পোশাকের রপ্তানি বাড়বে।