Home বাংলা নিউজ যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশ এগিয়েছে, কমছে চীনের অংশ; জানুয়ারি-এপ্রিলে ২৯% প্রবৃদ্ধি

যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশ এগিয়েছে, কমছে চীনের অংশ; জানুয়ারি-এপ্রিলে ২৯% প্রবৃদ্ধি

যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি ২০২৫ সালের প্রথম চার মাসে ২৯.৩৩ শতাংশ বেড়ে পৌঁছেছে ২.৯৮ বিলিয়ন ডলারে—এই প্রবৃদ্ধি বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির বাজারে অন্যান্য প্রতিযোগীদের তুলনায় এগিয়ে। ইউএস অফিস অফ টেক্সটাইলস অ্যান্ড অ্যাপারেল (ওটিইএক্সএ) এই তথ্য জানিয়েছে।

বাণিজ্য বিশ্লেষক ও রপ্তানিকারকরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যকার চলমান বাণিজ্য উত্তেজনার ফলে আমেরিকান বায়াররা চীনের পোশাকের ওপর নির্ভরতা কমাতে চাইছেন। ফলে নতুন সুযোগ তৈরি হচ্ছে, এবং বাংলাদেশসহ কয়েকটি দেশ এই বাজার পরিবর্তনের বড় সুবিধাভোগী হয়ে উঠছে।

জানুয়ারি-এপ্রিল সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে মোট পোশাক আমদানি প্রায় ১১ শতাংশ বাড়ে। এ সময় যুক্তরাষ্ট্রে চীনের পোশাক রপ্তানি ছিল প্রায় স্থবির, যা মাত্র ০.৬৬ শতাংশ বেড়েছে। অন্যদিকে, ভিয়েতনাম ১৬.০৬ শতাংশ, ভারত ২০.৩০ শতাংশ এবং পাকিস্তান ১৯.৫৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে রপ্তানিতে।

ওটিইএক্সএ’র তথ্যমতে, শুধুমাত্র এপ্রিল মাসেই যুক্তরাষ্ট্রে চীনের পোশাক রপ্তানি কমেছে ১৩ শতাংশ, বিপরীতে বাংলাদেশের বেড়েছে প্রায় ৩৮ শতাংশ। ওই মাসে রপ্তানি প্রবৃদ্ধিতে শীর্ষে ছিল কম্বোডিয়া (৩৯ শতাংশ), এরপর পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা (২৬ শতাংশ করে), ভারত (১০ শতাংশ), ভিয়েতনাম (২ শতাংশ) এবং ইন্দোনেশিয়া (৩ শতাংশ)।

বাণিজ্য বিশ্লেষকদের মতে, চীনের রপ্তানিতে হঠাৎ পতনের প্রধান কারণ ছিল এপ্রিলে চীনা পণ্যের ওপর মার্কিন সরকারের ১২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ—যা অন্যান্য দেশের জন্য এতটা কঠোর ছিল না।

“এই শুল্ক পরিবর্তন চীনের বাজার হিস্যা দখলে স্পষ্টতই প্রভাব ফেলেছে, আর বাংলাদেশসহ কিছু দেশ এর সুফল পাচ্ছে,” বলেন আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের সাবেক সদস্য ড. মোস্তফা আবিদ খান।

তাঁর মতে, “যুক্তরাষ্ট্রে চীন যে বাজার হারিয়েছে, তারই একটি অংশ বাংলাদেশ দখল করতে পেরেছে।”

তবে বাংলাদেশের নিটওয়্যার প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) সাবেক সভাপতি ফজলুল হক মনে করেন, এপ্রিলে শুল্ক পরিবর্তনের প্রকৃত প্রভাব মে মাসের রপ্তানি পরিসংখ্যান থেকেই আরও স্পষ্ট বোঝা যাবে।

টিবিএসকে তিনি বলেন, “চীন থেকে নির্ভরতা কমাতে ইতোমধ্যে মার্কিন বায়াররা অর্ডার শিফট (অন্য দেশে অর্ডার সরিয়ে নিতে) শুরু করেছে, আর সেই অর্ডারের বড় একটি অংশ বাংলাদেশে আসছে। এ কারণেই বাংলাদেশ তুলনামূলক বেশি প্রবৃদ্ধি দেখছে।”

তিনি আরও বলেন, “এটা নিঃসন্দেহে ইতিবাচক যে বাংলাদেশ মার্কিন বাজারে প্রতিযোগীদের তুলনায় ভালো করছে। যদি ট্রাম্প-যুগের নতুন ট্যারিফ (শুল্ক) আমাদের ওপর প্রযোজ্য না হয়, তাহলে সামনে আরও শক্তিশালী পারফরম্যান্স দেখা যাবে।”

ফতুল্লাহ ফ্যাশনস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফজলে শামীম এহসান বলেন, ডোনাল্ড ট্রাম্পের রাজনৈতিক প্রভাব বেড়ে যাওয়ার পর থেকেই মার্কিন ক্রেতারা চীনের সঙ্গে ব্যবসা বাড়ানো নিয়ে সতর্ক হয়ে ওঠেন। তিনি বলেন, “অনেকেই চীন থেকে অর্ডার কমাতে শুরু করে, যার ফলে বাংলাদেশের পাশাপাশি ভিয়েতনামও পোশাক রপ্তানিতে লাভবান হয়েছে।”

বাংলাদেশ এ সময়ে রপ্তানিকৃত পোশাকের ইউনিট সংখ্যা বা পরিমাণে ২৮.৩০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে, যা ভলিউম বৃদ্ধির দিক থেকে ভারত ও পাকিস্তানের পরে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ।

তবে মূল্য এবং পরিমাণ—দুই দিকেই প্রবৃদ্ধি ঘটলেও সেটি রপ্তানিকারকদের জন্য দর কষাকষির বলিষ্ঠ অবস্থান তৈরি করতে পারেনি। অর্থাৎ, রপ্তানির প্রতি ইউনিটের মূল্য বা দাম খুব একটা বাড়ানো হয়নি।

বাংলাদেশের ইউনিট মূল্য মাত্র ০.৮০ শতাংশ বেড়েছে, যেখানে ভিয়েতনামের ক্ষেত্রে এই বৃদ্ধি ৩.৫৮ শতাংশ। বিপরীতে, চীন, ভারত ও পাকিস্তান—তিন দেশই ইউনিট মূল্যে পতনের মুখে পড়েছে, যা বাজারজুড়ে মূল্যচাপের ইঙ্গিত দেয়।

রপ্তানিকারক ও বিশ্লেষকরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়ছে—এটি তারই প্রতিফলন। তবে, এই সামান্য মূল্যবৃদ্ধি একটি উদ্বেগজনক প্রবণতা প্রকাশ করে: বাংলাদেশি রপ্তানিকারকরা বেশি পণ্য পাঠালেও—প্রায় একই বা আরও কম মুনাফার মার্জিন রেখেই তা করতে বাধ্য হচ্ছেন।

অন্যদিকে, বিশ্লেষকদের মতে, ভিয়েতনামের ইউনিট মূল্য বাড়াতে পারা দেশটির উচ্চ মূল্য সংযোজন বা শক্তিশালী ব্র্যান্ড অবস্থানের ইঙ্গিত দেয়—যা বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হতে পারে। ভবিষ্যতে টেকসই প্রবৃদ্ধি ও মুনাফাযোগ্যতা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশেরও এদিকে মনোযোগী হওয়া জরুরি।

চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে মোট ২৬ বিলিয়ন ডলারের পোশাকপণ্য আমদানি হয়েছে। তালিকায় শীর্ষে রয়েছে ভিয়েতনাম, দেশটির রপ্তানিমূল্য ছিল ৫.০৯ বিলিয়ন ডলার। এরপর রয়েছে চীন (৪.৩৫ বিলিয়ন ডলার) এবং বাংলাদেশ (২.৯৮ বিলিয়ন ডলার)। অন্যান্য শীর্ষ রপ্তানিকারকের মধ্যে ছিল ইন্দোনেশিয়া, ভারত, মেক্সিকো, হন্ডুরাস, কম্বোডিয়া, পাকিস্তান ও দক্ষিণ কোরিয়া।

শুল্ক ঘিরে অনিশ্চয়তা

ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন সাময়িকভাবে বাংলাদেশি পণ্যে নতুন শুল্ক আরোপ তিন মাসের জন্য স্থগিত রেখেছে। তবে এই মেয়াদ চলতি মাসেই শেষ হচ্ছে। ফলে এরপরে কী হতে যাচ্ছে—তা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আমদানিকারক ও বাংলাদেশের রপ্তানিকারকদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা তাগাদা দিয়ে বলছেন, কালবিলম্ব না করে এখনই আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য আলোচনা শুরু করা জরুরি।

ড. মোস্তাফা আবিদ খান বলেন, “বাংলাদেশ এখনও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক কোনো বাণিজ্য আলোচনা শুরু করেনি, ফলে ভবিষ্যতের ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না।”

তিনি আরও বলেন, “বাংলাদেশ যেসব পণ্য চীন থেকে আমদানি করে, তার প্রায় ৫০ শতাংশই পুনঃরপ্তানি হয়। তাই যুক্তরাষ্ট্র চীন থেকে এই ধরনের ফ্যাব্রিক বা সুতা আমদানির ক্ষেত্রে কী অবস্থান নেয়, তা আমাদের জানা জরুরি। মার্কিন বাজারে সম্ভাবনা থাকলেও এটিকে ঘিরে অনিশ্চয়তা থেকেই যাচ্ছে।”

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here