১৯৭৭-৭৮ সালে ২২টি প্রতিষ্ঠানের রফতানিকৃত পোশাক পণ্য থেকে বাংলাদেশ আয় করে ৪০ হাজার ডলার। প্রায় চার দশক পর এখন এ খাতের রফতানি আয় ২ হাজার ৮০০ কোটি ডলার। ২০২১ সাল নাগাদ এ শিল্প থেকে ৫ হাজার কোটি ডলার রফতানি আয়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। দীর্ঘ এ অভিযাত্রায় সস্তা শ্রমই এ শিল্পের সক্ষমতার সবচেয়ে বড় ভরসার জায়গা হয়ে আছে। ফলে কাঁচামাল উত্পাদন থেকে শুরু করে পোশাক খাতের সম্প্রসারণে অনেকগুলো সম্ভাব্য ক্ষেত্র থাকলেও দক্ষ শ্রম ও উদ্যোক্তাসুলভ মানসিকতার অভাবে বাংলাদেশ ঘুরপাক খাচ্ছে ‘সেলাইঘর’ পর্যায়েই। এক্ষেত্রে ‘শ্রমিকদের নিম্নমজুরিই টিকে থাকার অবলম্বন’— শিল্প মালিকদের এমন মানসিকতাই প্রতিবন্ধক হয়ে উঠছে। ফলে সস্তা শ্রমের শক্তিই প্রকারান্তরে এ খাতের জন্য ‘ফাঁদ’ হয়ে দেখা দিচ্ছে।
জানা গেছে, ১৯৮৫ সালে পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের নিম্নতম মজুরি ছিল ৫৪২ টাকা। ১৯৯৪ সালে এটি বেড়ে ৯৩০ টাকায় দাঁড়ায়। এর এক যুগ পর ২০০৬ সালে মজুরি বেড়ে হয় ১ হাজার ৬৬২ টাকা। এর পর ২০১০ সালে নিম্নতম মজুরি বাড়িয়ে ৩ হাজার টাকা করা হয়। সর্বশেষ ২০১৩ সালে মজুরির নিম্নতম হার নির্ধারণ করা হয় ৫ হাজার ৩০০ টাকা। প্রতিবারই নিম্নতম মজুরি বৃদ্ধির জন্য এ খাতের শ্রমিকদের আন্দোলন করতে হয়েছে। আর অনেকটা নিয়ম মেনেই মজুরি বৃদ্ধিতে অনীহা জানিয়েছেন শিল্প মালিকরা। এ ধারায় কোনো পরিবর্তন হয়নি। অথচ চলতি বছরের জানুয়ারিতে প্রকাশিত দেশভিত্তিক মজুরির তুলনামূলক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বাংলাদেশে মজুরির বর্তমান হার বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় এখনো অনেক কম। ডলারের হিসাবে দেশের পোশাক শিল্পে মজুরি মাসিক ৬৫ ডলার। অথচ মঙ্গোলিয়ায় মাসিক ন্যূনতম মজুরি ৭৮, মিয়ানমারে ৭৮, পাকিস্তানে ৯৪, কম্বোডিয়ায় ১৪০, ভিয়েতনামে ১৩৬, ইন্দোনেশিয়ায় ৮৬ ও চীনে ১৪৫ ডলার।
বিশ্লেষকরা বলছেন, চার দশকে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের অনেক উন্নয়ন হলেও যথেষ্ট টেকসই হয়নি এখনো। এ সময়ের মধ্যে মালিক ও ক্রেতাপক্ষ সম্পদশালী হলেও ‘স্বল্প পুঁজিতে অধিক মুনাফা’র মানসিকতার কারণেই টেকসই হয়নি। যদিও কর্মপরিবেশ থেকে শুরু করে শ্রমিকের জীবনমানের উন্নয়নসহ সব ক্ষেত্রই আরো টেকসই করার সম্ভাবনা ছিল। অথচ শ্রমিককের মজুরি বৃদ্ধির কথা উঠলেই বাজার হারানোর প্রশ্ন তোলা হয়। কিন্তু এটি উদ্যোক্তাসুলভ আচরণ নয়।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. শফিক উজ জামান বণিক বার্তাকে বলেন, নিম্নমজুরির ফাঁদে দীর্ঘদিন ধরে আটকে রয়েছে দেশের পোশাক শিল্প। বিদেশী ক্রেতাদের ধরে রাখতে সস্তা শ্রম কখনই দীর্ঘমেয়াদি কোনো সমাধান হতে পারে না। ফলে ক্রমেই আমরা বিপর্যয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। আমাদের শিল্পোদ্যোক্তারা সৃজনশীল না হওয়ায় তারা বহুমুখী পণ্য উত্পাদন করতে পারছেন না।
তিনি বলেন, এ শিল্পের অগ্রগতি পরিকল্পনায় নিম্নমজুরি ছাড়াও ভর্তুকি ও বিদেশের অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য সুবিধার ওপর নির্ভর করা হচ্ছে। কারখানা সংস্কার হচ্ছে, কিন্তু শ্রমিকের জীবনমান নয়। এভাবে ৫০ বিলিয়ন ডলারের রফতানি আয়ের লক্ষ্য যদিও বা অর্জন হয়, প্রতিযোগী দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা নিয়ে সংশয় থেকেই যাচ্ছে।
পোশাক শিল্প মালিকরা সস্তা শ্রমকে শক্তির বদলে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছেন। এ কারণে বর্তমান বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বৃদ্ধিতে শ্রমিকের দক্ষতা বৃদ্ধি অত্যন্ত জরুরি হলেও এক্ষেত্রে পর্যাপ্ত উদ্যোগ নেই। পাশাপাশি শ্রমিক ও তার পরিবারের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিতেও খুব অল্পসংখ্যক শিল্প মালিকই এগিয়ে এসেছেন। অথচ শ্রমিকদের দুপুরের খাবার, চিকিত্সা, ডে-কেয়ার সেন্টারসহ বিভিন্ন সেবা ও প্রণোদনা নিশ্চিত করা গুটিকয় প্রতিষ্ঠানের দিকে তাকালে দেখা যায়, সেখানে মালিকদের মুনাফা কমেনি। বরং অসন্তোষ কম থাকায় শ্রমিকের উত্পাদন সক্ষমতা বেড়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের এক গবেষণায় দেখা গেছে, পশ্চিমা পুঁজির চাহিদা মেটাতে সস্তা শ্রমের ওপর নির্ভর করে অধিক মুনাফা লাভে পোশাক শিল্পের যে স্তরগুলো তৈরি হয় তা হলো— কাঁচামাল উত্পাদন, নকশা করা, সেলাই করা, মধ্যস্বত্বভোগীদের মাধ্যমে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের পণ্য বাজারে বিক্রি। এ স্তরগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের পোশাক শিল্প মূলত ‘সেলাই করা’ অংশে সীমাবদ্ধ। পোশাক তৈরির এ বৈশ্বিক প্রক্রিয়ায় উত্পাদিত পণ্যের বাজার ব্র্যান্ড কোম্পানিগুলোর নিয়ন্ত্রণেই থাকে। ফলে এ কোম্পানিগুলোর প্রয়োজনেই আমাদের দেশের পোশাক শিল্প পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়। এ কারণেই দেশের প্রধান শিল্প খাত হলেও স্থানীয় পুঁজি ও শ্রম উভয়ই চরম সংকটে রয়েছে।
খাতটির শ্রমিক প্রতিনিধিরা জানান, পোশাক শিল্পে কর্মরতদের মধ্যে একটি বড় অংশ নিম্নহারে মজুরি পান। এ খাতের ৮০ শতাংশ নারী শ্রমিকের মজুরি ৫ হাজার ৩০০ থেকে ৭ হাজার টাকার মধ্যে। অন্যদিকে ৭০ শতাংশ পুরুষ শ্রমিক ৫-৭ হাজার টাকা মজুরি পান। এদের অধিকাংশই আর্থসামাজিক দুরবস্থার কারণে এ পেশায় রয়েছেন। এ শিল্প শ্রমিকদের স্বপ্ন দেখাতে ব্যর্থ হচ্ছে। যদিও খাতটির উদ্যোক্তারা স্বপ্ন দেখছেন এ শ্রমিকদের দিয়েই শিল্প আরো অনেক দূর এগিয়ে নেয়ার।
জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক কর্মচারী লীগের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম রনি বলেন, পোশাক শিল্পের হাত ধরে মালিকের উন্নয়ন হলেও শ্রমিকের হয়নি। এ শিল্পকে আরো এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু এখনো এ খাতের মূল শক্তি হচ্ছে সস্তা শ্রম। এ মানসিকতার পরিবর্তন না হলে খাতের টেকসই উন্নয়ন বিঘ্নিত হওয়ার পাশাপাশি কর্মসংস্থানও হুমকির মধ্যে পড়বে।
সম্প্রতি প্রকাশিত এক আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্যমতে, দেশের পোশাক শিল্পের মজুরি কাঠামোয় শিক্ষানবিশ ব্যতীত শ্রমিকদের মোট সাতটি গ্রেড রয়েছে। সপ্তম গ্রেডের একজন শ্রমিক খাদ্য, যাতায়াত, চিকিত্সা, বাড়িভাড়া ও মূল বেতনসহ মোট ৫ হাজার ৩০০ টাকা মজুরি পান। আর গ্রেড ৪ ও ৩-এর শ্রমিকরা পান যথাক্রমে ৬ হাজার ৪২০ ও ৬ হাজার ৮৫০ টাকা। ঢাকা শহরে দারিদ্র্যসীমা মজুরি ধরা হয়েছে মাসিক ৭ হাজার ১৭২ টাকা। আর বিশ্বব্যাংকের দারিদ্র্যসীমা মজুরি ৭ হাজার ৪১৮ টাকা। অর্থাত্ পোশাক শ্রমিকের মজুরি ঢাকার দারিদ্র্যসীমার নিচে। অথচ দেশের উত্পাদন, নির্মাণ, কৃষি ও মত্স্য খাতের শ্রমিকদের মজুরি এর চেয়ে বেশি। এসব খাতের গড় মজুরি ৮ হাজার ৮৪৬ টাকা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি মো. সিদ্দিকুর রহমান বলেন, পোশাক শিল্পের শ্রমিকরা বর্তমান মজুরি হার নিয়ে সন্তুষ্ট। সর্বশেষ মজুরি বৃদ্ধির পর বর্তমানে সব শ্রমিকই সামান্য হলেও সঞ্চয় করছেন। এ পরিস্থিতিতে কোনো শ্রমিক যদি ভবিষ্যত্ নিয়ে আশাবাদী হতে না পারেন, তার অন্য কোনো খাতে চেষ্টা করা উচিত। জীবনযাপনের মান একেকজনের একেক রকম। সবার চাহিদা মেটানো সম্ভব নয়। আর জীবনযাপনের মানোন্নয়নে শুধু পোশাক শিল্পের ওপর নির্ভরতা তো কোনো কাজের কথা হতে পারে না। শিল্প সক্ষমতার বাইরে কোনো কিছু চিন্তা করলে তা হবে অবাস্তব। আমাদের সবাইকে দেশের শিল্প সমস্যা অভ্যন্তরীণ প্রেক্ষাপটেই চিন্তা করতে হবে, আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে নয়।