অস্ট্রেলিয়ায় যে দামে একটি পোশাক বিক্রি হয়, এর ২ শতাংশের কম মজুরি পান ওই পোশাক তৈরির সঙ্গে যুক্ত বাংলাদেশের শ্রমিকেরা। ধনী এ দেশটিতে দিন দিন বড় বড় পোশাক কোম্পানির আয় বাড়ছে। কিন্তু বাংলাদেশে সেসব পোশাক তৈরির সঙ্গে যুক্ত শ্রমিকের মজুরি সেই হারে বাড়ছে না। আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থা অক্সফাম-অস্ট্রেলিয়ার এক গবেষণায় এ চিত্র উঠে এসেছে। গত রোববার সংস্থাটি এ প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পণ্যের মূল্যের তুলনায় মজুরি পরিস্থিতি বাংলাদেশে সবচেয়ে নাজুক। বৈশ্বিকভাবে পণ্যের ৪ শতাংশ মজুরিতে ব্যয় হয়। তবে বাংলাদেশে এর পরিমাণ ২ শতাংশের কম।
অক্সফাম অস্ট্রেলিয়ার প্রধান নির্বাহী হেলেন জোকি বলেন, ‘অস্ট্রেলিয়ার মানুষের পোশাক তৈরি করেন যে নারী, তিনি তাঁর জীবন চলার জন্য প্রয়োজনীয় মজুরি পান না। মেলে না তাঁর কঠোর শ্রমের মূল্য।’
‘মহিলা শ্রমিক যা তৈরি করেন’ বা ‘হোয়াট শি মেকস’ শিরোনামের প্রতিবেদনটি অক্সফামের হয়ে তৈরি করে ডেলোয়ট একসেস ইকনোমিকস নামের একটি প্রতিষ্ঠান।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অস্ট্রেলিয়ার প্রতিষ্ঠানগুলো চাইলে দারিদ্র্যপীড়িত শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানো সম্ভব। মজুরি বাড়লে শ্রমিকদের খাদ্য, বস্ত্র, স্বাস্থ্য পরিষেবা, যোগাযোগের ব্যয় বা অন্য যেকোনো প্রয়োজনীয় ব্যয় মেটানো সম্ভব হয়।
অক্সফাম, বাংলাদেশের উইন অ্যান্ড কমিউনিকেশনের ব্যবস্থাপক মণীষা বিশ্বাস জানান, এই গবেষণা পরিচালিত হয় এ বছরের এপ্রিল থেকে জুন মাসে। তিনি বলেন, ‘এ প্রতিবেদনে আমাদের শ্রমিকদের বঞ্চনার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। শ্রমিকদের জীবনমানের উন্নয়নে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পকারখানার মালিক এবং অস্ট্রেলিয়ার মালিকের যৌথ দায় রয়েছে।’ প্রতিবেদনের সূত্র ধরে তিনি বলেন, ‘অস্ট্রেলিয়ার বিক্রি হওয়া পণ্যের মূল্য মাত্র ১ শতাংশ বাড়ালেই এসব শ্রমিকের জীবনমানের উন্নয়ন সম্ভব। এর অর্থ হচ্ছে, ১০ ডলারের একটি টিশার্টে মাত্র ১০ সেন্ট বাড়ালেই চলবে।’
সারা বিশ্বের তৈরি পোশাকশিল্পের শ্রমিকদের মধ্যে ৮০ শতাংশই ১৮ থেকে ২৫ বছর বয়সী নারী। কারখানায় তাঁদের দীর্ঘ সময় ব্যয়, সীমাহীন পরিশ্রমে ফুলে-ফেঁপে উঠছে বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম, চীনের বড় বড় কারখানা আর এসব দেশের অর্থনীতি। অক্সফামের গবেষণায় বলা হয়েছে, এই ফুলে-ফেঁপে ওঠা অর্থনীতির সুফল এসব নারীর কপালে জোটে না।
শ্রমিকদের এই দুরবস্থার কারণ বিদেশি ব্র্যান্ড এবং এ-দেশীয় মালিকদের যোগসাজশ—এমনটাই মনে করেন শ্রমিক অধিকার নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংগঠন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, নিজেদের মধ্যে দাম কমানোর প্রতিযোগিতা করে এ দেশের মালিকেরা বোঝা চাপান শ্রমিকের ওপর। মূলত বাংলাদেশে জাতীয়ভাবে এমন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে যেখানে বাংলাদেশি মালিক, বিদেশি ব্র্যান্ডের জন্য সস্তায় পোশাক তৈরির চক্র তৈরি হয়েছে। একদল মানুষ তার জীবনকে নিঃশেষ করছে। আর ফায়দা নিচ্ছে ধনিক শ্রেণি।
যে প্রতিযোগিতার কথা সুলতান উদ্দিন আহমেদ বললেন তা স্বীকার করেন তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের প্রতিষ্ঠান বিজিএমইএর সহসভাপতি মোহাম্মদ নাছির। তবে তিনি এ জন্য বিদেশি ব্র্যান্ডগুলোকেই দায়ী করেন। নাসির প্রথম আলোকে বলেন, ব্র্যান্ডগুলো ১০ ডলারের পণ্য ৫০ ডলারে বিক্রি করে।
অক্সফামের গবেষণায় উল্লেখ আছে, বাংলাদেশে একজন শ্রমিকের প্রতি ঘণ্টার ন্যূনতম মজুরি অস্ট্রেলীয় ৩৯ সেন্টের সমান। এর পরিমাণ ভিয়েতনামে ৬৪ সেন্ট, চীনে ৯৩ সেন্ট। এ ক্ষেত্রেও পিছিয়ে আছে বাংলাদেশের শ্রমিক।
গবেষণায় অস্ট্রেলিয়ার বড় বড় ব্র্যান্ডের মধ্যে মায়ার, ডেভিড জোনস লিমিটেড, টার্গেট, বিগ ডব্লিউ, কেমার্টের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর বাড়তে থাকা আয়ের হিসাব তুলে ধরা হয়েছে। তিন বছরে এসব প্রতিষ্ঠানের আয় ঊর্ধ্বমুখী। ২০১৪ সালে কেমার্টের আয় ছিল ৪ দশমিক ২১ বিলিয়ন অস্ট্রেলীয় ডলার। ২০১৬-তে এসে এর পরিমাণ হয়েছে ৫ দশমিক ১৯ বিলিয়ন ডলার। ডেভিড জোনস লিমিটেড ২০১৪-তে আয় করে ১ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলার, দুই বছর পর এর পরিমাণ হয় ২ দশমিক ১৯ বিলিয়ন ডলার।
জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি আমিরুল হক আমিন মনে করেন, বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্প খাতের মূল নিয়ামক বহুজাতিক কোম্পানি। তিনি বলেন, এরাই দেশীয় মালিকদের ব্যতিব্যস্ত রাখে। প্রতিযোগিতা করে দাম কমায়। এক মালিক থেকে আরেক মালিকে যায়।