আশির দশকের প্রথমে যাত্রা শুরম্ন করা তৈরি পোশাক শিল্প এখন দেশের সিংহভাগ রপ্তানি আয়ের জোগান দিচ্ছে। শুরম্নতে মোট আয়ের ৪ শতাংশের কম অবদান রাখা এ খাতটির রপ্তানির অবদান ৮০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। তবে গত এক দশকের আগের চেয়ে এ খাতের রপ্তানি ও কর্মসংস্থানে প্রবৃদ্ধির গতি মন্থর হয়ে পড়ছে। রপ্তানি বৃদ্ধির হার এক অংকের ঘরেই সীমাবদ্ধ। একই সঙ্গে খাতটির মূল্যসংযোজনও সে হারে বাড়ছে না।
রপ্তানি উন্নয়ন বু্যরো সূত্র মতে, ১৯৮৪ সালে রপ্তানি আয়ের মধ্যে পোশাক থেকে আসে ৩ দশমিক ৮৯ শতাংশ। ছয় বছরের ব্যবধানে ১৯৯০ সালে যা দাঁড়ায় ৩২ দশমিক ৪৫ শতাংশ ২০১৬ সালে দাঁড়ায় ৮২ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশে।
রপ্তানি উন্নয়ন বু্যরোর তথ্য মতে, সর্বশেষ অর্থবছরেও তৈরি পোশাক খাতে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১ শতাংশেরও কম হয়েছে। ২০১৫-১৬ সালে পোশাকে আয় ছিল ২ হাজার ৮০৯ কোটি ডলার, যা গত বছর দাঁড়ায় ৩ হাজার ৩৭ কোটি ডলার। বেড়েছে মাত্র .০২ শতাংশ। এর আগের বছর ২০১৪-১৫ সালে প্রবৃদ্ধি ছিল ৪ শতাংশ। মাঝে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি কিছুটা বেড়ে ১০ শতাংশ হয়। তবে এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশের (ইএবি) সভাপতি সালাম মুর্শেদী মনে করেন টাকার অংকে রপ্তানি ও মূল্যসংযোজন না বাড়লেও প্রকৃত পক্ষে তা বেড়েছে। তিনি যায়যায়দিনকে বলেন, ওভেন খাতের ৩০ শতাংশ এবং নিট ওয়্যারের ৯০ শতাংশ কাঁচামাল দেশে তৈরি হচ্ছে। তাছাড়া ওয়াশিং, ডায়িং, প্রিন্টিং, অ্যাম্বয়ডারিসহ আনুষঙ্গিক জিনিস বা এক্সসোরিজ কাজ দেশেই করা হচ্ছে। এতে দেশের টাকা দেশেই থাকছে। তবে উচ্চমূল্যের পণ্যে আমদানির পরিমাণ বেশি। কিন্তু মূল কথা রপ্তানি বৃদ্ধি পেলেও আন্ত্মর্জাতিক বাজারে দরপতনের কারণে রপ্তানি আয় বেশি হচ্ছে না। এজন্যই প্রবৃদ্ধি কম হচ্ছে। অর্থাৎ, রপ্তানি সংখ্যায় বেশি, টাকার অংকে কম। রপ্তানি বাড়াতে উচ্চমূল্যের পণ্য রপ্তানি বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে এ সব উন্নত মানের কাপড় ও সুতো দেশে তৈরি করতে হবে। পাশাপাশি, টেনকোলজি সংযোজন, গ্রীন ফ্যাক্টরিসহ অন্যান্য বিষয় থাকতে হবে।
তিনি বলেন, গত তিন বছরে উৎপাদন খরচ ১৮ শতাংশ বেড়েছে, টাকার মান বাড়াসহ পণ্যের দাম কমায় রপ্তানি সক্ষমতা কমছে। এক্ষেত্রে প্রতিযোগী দেশগুলো এ খাতকে আন্ত্মর্জাতিক নীতি উপযোগী উপযুক্ত নীতি সহায়তা দিচ্ছে। এদেশেও রপ্তানিমুখী শিল্প বিশেষ করে পোশাক খাতের উপযোগী নীতি সহায়তা বাড়াতে হবে। বিশেষ করে বিশ্ব বাজারের সঙ্গে মিল রেখে জ্বালানি দাম কমানো, গ্যাস-বিদু্যতের নিরবচ্চিন্ন সরবরাহ ও ডলারের দাম সমন্বয় করে রপ্তানিমুখী শিল্পের জন্য রপ্তানি মুদ্রানীতি ঘোষণা করতে হবে।
মূলত, ২০১৩ সালে রানাপস্নাজা ট্র্যাজেডি ও তাজরীন গার্মেন্টে অগ্নিকা-ের পর থেকে বড় ধরনের ধাক্কা খায় পোশাক খাত। এদিকে চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে তৈরি পোশাক খাতের পণ্য রপ্তানিতে আয় হয়েছে ৯৪৩ কোটি ৭৭ লাখ ৩০ হাজার মার্কিন ডলার বা প্রায় ৭৮ হাজার ৫৪০ কোটি টাকা; যা এ সময়ের রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ১ দশমিক ২৩ শতাংশ বেশি। একই সঙ্গে গত অর্থবছরের প্রথম চার মাসের তুলনায় এবার এ খাতের পণ্য রপ্তানি আয় ৬ দশমিক ৯৯ শতাংশ বেড়েছে।
সম্প্রতি প্রকাশিত বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) এক গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, নব্বইয়ের দশকের প্রথম পাঁচ বছরে পোশাক খাতের কর্মসংস্থান প্রবৃদ্ধিটা ভালো হলেও এর পরের ১০ বছরে গতিটা নিম্নমুখী হয়। তবে ২০০৫-১০ সময়ে এ গতি আগের ১০ বছরের তুলনায় শুধু উর্ধ্বমুখীই হয়নি, প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে যায়। তবে গতিটা একটা জায়গায় এসে আটকে যায় ২০১০ সালের পরে এবং সবচেয়ে খারাপ অবস্থা দাঁড়ায় ২০১৩-১৫ সময়ে।
‘বাংলাদেশে শ্রমবাজার এবং দক্ষ মানবসম্পদের ঘাটতি’ শীর্ষক প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, রপ্তানি প্রবৃদ্ধিসহ অন্যান্য উন্নতির জন্য দক্ষ শ্রমিকের বড় ঘাটতি রয়েছে পোশাক খাতে। এতে আরও বলা হয়, ভবিষ্যতে সস্ত্মা শ্রমের ওপর নির্ভর করে আর এগোনো সম্ভব হবে না। সরকারঘোষিত ৫০ বিলিয়ন ডলারের (পাঁচ হাজার কোটি ডলার বা চার লাখ কোটি টাকা) রপ্তানি লক্ষ্য পূরণ করতে গেলে তা আরও অসম্ভব হয়ে উঠবে। এ জন্য যে দক্ষ শ্রমশক্তির দরকার পড়বে, তা পাওয়াও একটা বড় চ্যালেঞ্জ।
এদিকে রপ্তানির মতোই স্থির হয়ে আছে পোশাকের মূল্যসংযোজনের বিষয়টি। আমদানি করা পণ্যের সঙ্গে স্থানীয় শিল্পের ব্যবহার বা মূল্য সংযোজন বাড়ছে না। গত এক দশকের বেশি সময় ধরে মূল্য সংযোজন ৭৪ থেকে ৭৬ শতাংশের ঘরে আটকে আছে। তিন বছর ধরে এ হার আরও কমেছে। সর্বশেষ গত অর্থবছরে (২০১৬-১৭) আগের অর্থবছরের তুলনায় মূল্য সংযোজন কম হয়েছে শূন্য দশমিক ২৮ শতাংশ। মোট মূল্য সংযোজন হয়েছে ৭৫ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ। অর্থাৎ পোশাকের কাঁচামাল আমদানি ও তৈরি পোশাক রপ্তানির মাধ্যমে অর্থনৈতিক সুফল কাঙ্ক্ষিত হারে হচ্ছে না। তৈরি পোশাকে মূল্য সংযোজন বলতে বোঝায় রপ্তানি মূল্য থেকে আমদানি করা কাঁচামালের মূল্য বাদ দিয়ে বাকি যে পরিমাণ স্থানীয়ভাবে জোগান দেয়া হয়। অর্থাৎ স্থানীয় কাঁচামাল ও সেবাকে মূল্যসংযোজন হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিদেশি ক্রেতা চাহিদা অনুযায়ী গুণগত মানের কাপড় দেশে উৎপাদন হচ্ছে না। স্থানীয় কাঁচামালের দাম বৃদ্ধির কারণেও মূল্য সংযোজন বাড়ছে না। আবার ইউরোপীয় ইউনিয়নে শুল্কমুক্ত সুবিধায় পোশাক রপ্তানিতে একসময় উৎসবিধিতে দ্বিস্ত্মরের শর্ত ছিল। রপ্তানিতে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত কাপড় ব্যবহারের শর্ত ছিল তখন। ২০১২ সালের জানুয়ারি থেকে উৎসবিধি শিথিল করে এক স্ত্মরে নামিয়ে আনা হয়। এখন যে কোনো দেশ থেকে কাপড় আমদানি করেই ইউরোপে রপ্তানিতে জিএসপি সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে। মূল্য সংযোজন কমার এটিও একটি বড় কারণ।
তৈরি পোশাক খাতের ওপর বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পর্যালোচনা প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছরে নিট এবং ওভেন মিলিয়ে তৈরি পোশাক খাতের মূল্য সংযোজন হয়েছে ৭৫ দশমিক ০৭ শতাংশ। ৭০১ কোটি ডলারের কাঁচামাল আমদানির বিপরীতে রপ্তানি হয়েছে ২ হাজার ৮১৪ কোটি ডলারের পণ্য। এর আগে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ২ হাজার ৮১০ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানির বিপরীতে আমদানি হয়েছে ৬৯২ কোটি ডলার। সংযোজন হয়েছে ৭৫ দশমিক ৩৫ শতাংশ। আর ২০১৪-১৫ অর্থবছরে মূল্য সংযোজন হয়েছিল ৭৫ দশমিক ৬৭ শতাংশ। যদিও এ মূল্য সংযোজনের হিসাব নিয়ে অর্থনীতিবিদদের মনে প্রশ্ন রয়েছে।
পোশাক খাত সংশিস্নষ্টরা বলছেন, বিশ্বে দামি পোশাকের চাহিদা বাড়ছে। এ ক্ষেত্রে কোনো কোনো ক্রেতা নির্দিষ্ট বিদেশি প্রতিষ্ঠান থেকে কাপড় বা সুতা আমদানির শর্ত দিয়ে থাকে। এ জন্যই ক্রেতাদের পছন্দ অনুযায়ী গুণগত মানের কাপড়-সুতা আমদানি করতে হচ্ছে। স্থানীয় পর্যায়ে এখনো এ ধরনের পোশাক তৈরির কাপড় ও সুতা উৎপাদন হচ্ছে না। এর মধ্যে নিটওয়্যার শিল্পের প্রধান কাঁচামাল তুলা আমদানির পর স্থানীয় পর্যায়ে সেটি থেকে প্রথমে সুতা এবং পরবর্তীতে কাপড় তৈরি করা হয়। এ কারণে নিট খাতে মূল্য সংযোজন বেশি। কিন্তু ওভেন খাতে বিদেশি ক্রেতাদের পছন্দ অনুযায়ী কাপড় ব্যবহার করে পোশাক বানিয়ে সেটি রপ্তানি করতে হয়। তাই আমদানি করা কাপড়ের কারণে বিদেশে টাকা চলে যাচ্ছে। আবার ভালো মান চাইলেও ক্রেতারা সে হারে পোশাকের দাম বাড়াচ্ছে না। কিন্তু অন্যদিকে কাপড়সহ অন্যান্য পণ্যের দাম বেড়েছে। এ ছাড়া গ্যাস-বিদু্যতের মূল্যবৃদ্ধির কারণে স্থানীয় কাঁচামালের দামও বেড়েছে। এসব কারণে তৈরি পোশাকের মূল্য সংযোজন কমেছে। তবে স্থানীয় কাপড় ব্যবহার করতে পারলে অনেক সুবিধা। সরকারের কাছ থেকে প্রণোদনা পাওয়া যায়। ইচ্ছা করলে একঘণ্টার ব্যবধানে কোনোরকম ঝামেলা ছাড়াই কাপড় সংগ্রহ করা সম্ভব হয়।