দেশের ক্রমবিকাশমান শিল্প খাতে পোশাক কারখানার সংখ্যাই বেশি। ঢাকা ও চট্টগ্রামে কেন্দ্রীভূত পোশাক খাতে কাজ করেন বিপুলসংখ্যক শ্রমিক। রফতানিমুখী হওয়ায় এ খাতের শ্রম অধিকার নিয়ে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক উভয় পর্যায়ের চাপ ও তত্পরতাও বেশি। কর্মক্ষেত্রে ধারাবাহিক দুর্ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এ খাতে ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের উদ্যোগও বেড়েছে। শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, রাজধানী ঢাকায় পোশাক খাতের ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের আবেদন বাতিলের হার কমেছে। তবে বন্দরনগরী চট্টগ্রামের চিত্র বিপরীত। সেখানে ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের আবেদন বাতিলের হার বাড়ছে। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে উদ্বেগও প্রকাশ করা হয়েছে।
শ্রমিক প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, দেশের প্রচলিত শ্রম আইন অনুযায়ী অধিকার প্রতিষ্ঠায় কারখানাগুলোয় শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন থাকা বাধ্যতামূলক। শ্রমিক প্রতিনিধিদের অভিযোগ, পাট শিল্পে পূর্ব অভিজ্ঞতার দোহাই দিয়ে ও প্রভাব খাটিয়ে চট্টগ্রামে ট্রেড ইউনিয়ন কার্যক্রম শক্তিশালী হতে দিচ্ছে না মালিকপক্ষ। ফলে ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের জন্য আবেদন করার পর তা বাতিল হয়ে যাচ্ছে। নজরদারির অভাবেই চট্টগ্রামে এ প্রবণতা বেশি বলে মনে করেন তারা।
শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অধীন শ্রম অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ সালে চট্টগ্রামে ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের জন্য ১৯টি আবেদন করা হয়। এর মধ্যে বাতিল হয়ে যায় ১৫ দশমিক ৭৮ শতাংশ আবেদন। ২০১৬ সালে ৪০টি আবেদনের বিপরীতে বাতিল হয় ৫০ শতাংশ। গত বছর আবেদনের সংখ্যা ছিল ৩১, যার ৫৭ শতাংশ বাতিল হয়ে যায়।
ঢাকার চিত্রটি বিপরীত। ২০১৫ সালে ঢাকার পোশাক কারখানাগুলো থেকে ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের জন্য ২১৯টি আবেদন করা হয়। এর মধ্যে বাতিল হয় ৭৩ শতাংশ। ২০১৬ সালে মোট আবেদন জমা পড়ে ১০৭টি। বাতিল হয় ৩০ শতাংশ। আর গত বছর ১৩৩টি আবেদনের ১৫ শতাংশ বাতিল হয়। অর্থাত্ ঢাকায় ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের আবেদন বাতিলের হার কমছে, অন্যদিকে চট্টগ্রামে তা বাড়ছে।
এমনটি কেন হচ্ছে— জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বিভাগীয় শ্রম দপ্তরের পরিচালক মো. গিয়াস উদ্দীন বণিক বার্তাকে বলেন, শ্রম দপ্তর শ্রমিকদের জন্য কাজ করে। আমরা চাই ট্রেড ইউনিয়ন হোক। কিন্তু আবেদন অনুমোদন ও বাতিল দুটোই হয় শ্রম আইন অনুযায়ী। আইনের শর্ত পূরণ করতে না পারলে অথবা আবেদনে ভুলভ্রান্তি থাকলে আবেদন বাতিল হয়।
হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, সব খাত মিলিয়ে দেশে নিবন্ধিত ট্রেড ইউনিয়নের সংখ্যা ৮ হাজার ৪৬। পোশাক, চামড়াসহ বিভিন্ন খাতে ইউনিয়নগুলোর সদস্য সংখ্যা ২৮ লাখ ১৬ হাজার ৩৭৮। পোশাক খাতের ট্রেড ইউনিয়ন রয়েছে মোট ৬৩২টি। চিংড়ি খাতে ১৬টি ও চামড়া খাতে ট্রেড ইউনিয়ন সংখ্যা ১৩।
শ্রম অধিদপ্তর সূত্র অনুযায়ী, রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর শিল্প খাতে ট্রেড ইউনিয়ন আবেদন ও নিবন্ধন দুটোই বেড়েছে। বিশেষ করে পোশাক শিল্প খাতে অনেকগুলো ট্রেড ইউনিয়নের আবেদন ও নিবন্ধন হয়েছে। ২০১৩ সালে ঢাকায় ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের জন্য আবেদনের সংখ্যা ছিল ১৪৩। এর মধ্যে নিবন্ধন পেয়েছে ৬৫টি। ২০১৪ সালে ৩৭৯টি আবেদনের বিপরীতে ১৫১টি ইউনিয়ন নিবন্ধন পায়। অন্যদিকে ২০১৩ সালে চট্টগ্রাম বিভাগে মোট ট্রেড ইউনিয়ন আবেদন ছিল ২৭টি। এর মধ্যে অনুমোদন পায় ১৮টি। ২০১৪ সালে আবেদনের সংখ্যা ছিল ৫১টি, যার ১৩টি অনুমোদন পায়।
শ্রম অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, শ্রমিকপক্ষের ভুল বা অসচেতনতার প্রতিফলন দেখা যায় তাদের আবেদনে। তাই সব সময়ই আবেদনের বড় একটা অংশ বাতিল হচ্ছে। আবেদনে ভুলগুলোর ব্যাখ্যা দিয়ে কর্মকর্তারা জানান, ইউনিয়ন গঠনের শর্ত অনুযায়ী ৩০ শতাংশ শ্রমিকের প্রতিনিধিত্ব থাকতে হবে। অনেক ক্ষেত্রে এ শর্ত পূরণ হয় না। অনেক সময় একই ব্যক্তির একাধিক স্বাক্ষর থাকে। আবার অনেক সময় স্বাক্ষর মেলে না। পোশাক খাতের ক্ষেত্রে মাইগ্রেশনের প্রভাব পড়ে। দেখা যায়, আবেদনে শ্রমিকের স্বাক্ষর থাকলেও যাচাই-বাছাইয়ের সময় সে অন্য কারখানায় চলে গেছে। এসব কারণেই আবেদন বাতিল হচ্ছে।
এদিকে শ্রমিক প্রতিনিধিরা বলছেন, কারখানায় ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার চর্চা নিয়ে সবসময়ই মালিকদের মধ্যে অনীহা কাজ করে। আর এক্ষেত্রে পাট শিল্প ধ্বংসের জন্য ট্রেড ইউনিয়ন দায়ী ছিল বলে অজুহাত দেন তারা। যদিও বাস্তবে শিল্প টেকসই করতে ট্রেড ইউনিয়নের প্রয়োজন রয়েছে। তবে মালিকরা প্রভাব খাটিয়ে একে দমিয়ে রাখতে চান। এ কারণে শিল্প টেকসই হয় না। মালিকপক্ষ এখন পর্যন্ত এ মানসিকতা থেকে বের হতে পারেননি। ট্রেড ইউনিয়নের তত্পরতা দেখলেই ছাঁটাইসহ নানা কৌশল ও সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশে আবেদন বাতিল হয়।
বাংলাদেশ জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক-কর্মচারী লীগের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম রনি বলেন, অনেক সময় শ্রমিকদের অসচেতনতার কারণে আবেদনে ভুল থাকে। কিন্তু এ ভুল শোধরানোর পরামর্শ না দিয়ে এগুলো বাতিল করা হচ্ছে। তবে রানা প্লাজা ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে অনেক ট্রেড ইউনিয়ন হয়েছে। এর অনেকগুলোই শুধু নামেমাত্র ইউনিয়ন। চট্টগ্রামে নিবন্ধন বাতিলের হার বেশি হওয়ার মূল কারণ নজরদারির ঘাটতি আর শ্রমিকদের অসেচতনতা।
জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি নাজমা আক্তার বলেন, মালিকরা কখনই কারখানায় ট্রেড ইউনিয়নের চর্চা গড়ে উঠুক তা চান না। আর শ্রমিকদের তোড়জোড় দেখলে ছাঁটাইসহ নানা কৌশল অবলম্বন করেন। সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশ ও প্রভাব খাটানোর ঘটনাও আমরা জানি। ট্রেড ইউনিয়নের আবেদন বাতিলের বর্তমান ধারা মালিকদের অনীহারই প্রতিফলন। চট্টগ্রামে নিবন্ধন বাতিলের হার বেশি মূলত সরকারি নজরদারি ও তদারকির ঘাটতির কারণে।
শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশে মোট ৪১টি শিল্প খাত রয়েছে। পরিসংখ্যান ব্যুরোর লেবার ফোর্স সার্ভে ২০১৫-১৬ অনুযায়ী, এসব শিল্প খাতে নিয়োজিত ১৫ বছরের বেশি বয়সী শ্রমিকের সংখ্যা ১ কোটি ১০ লাখের বেশি। এর মধ্যে শুধু পোশাক শিল্পেই কর্মরত ৪০ লাখের বেশি শ্রমিক।