লুজিন ফ্যাশন গ্রুপের ছয়টি পোশাক কারখানা নিজেদের সক্ষমতার পুরোটা ব্যবহার করে আগামী তিন মাসে ৩০ লাখ সোয়েটার তৈরি করবে। এসব পোশাকের রপ্তানিমূল্য প্রায় দেড় কোটি মার্কিন ডলার বা ১২৬ কোটি টাকা। অবশ্য গত বছরের এই সময়ে যে পরিমাণ ক্রয়াদেশ ছিল, তা দিয়ে সক্ষমতার ৮০ শতাংশের বেশি ব্যবহার করতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি।
গ্রুপের পরিচালক শ্যামল রায় বিষয়টি নিশ্চিত করে গতকাল রোববার বিকেলে প্রথম আলোর এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘বর্তমানে ভালো ক্রয়াদেশ আছে। আগামী আগস্ট পর্যন্ত আমাদের কারখানাগুলো সম্পূর্ণ বুকড। সে জন্য অনেক ব্র্যান্ডের পোশাকের ক্রয়াদেশ আমরা নিতে পারিনি।’
লুজিন ফ্যাশন গ্রুপের মতো দেশের অনেক তৈরি পোশাক কারখানায় বর্তমানে অর্ডার বা ক্রয়াদেশের বেশ চাপ। গত বছরের নভেম্বর থেকে ক্রয়াদেশের চাপ শুরু হয়। জানুয়ারি মাস থেকে তা আরও বাড়তে থাকে। ক্রয়াদেশ প্রাপ্তিতে উন্নত কর্মপরিবেশ বা কমপ্লায়েন্ট পোশাক কারখানাগুলো এগিয়ে। অনেক কারখানাই এখন সক্ষমতার চেয়ে বেশি ক্রয়াদেশ নিচ্ছে, যদিও তারা তা আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করছে না। অন্য কারখানায় ঠিকা বা সাব-কন্ট্রাকটিং করিয়ে সেসব বাড়তি ক্রয়াদেশের পোশাক তৈরি করা হবে।
এসব তথ্য দিয়ে কয়েকজন পোশাকশিল্প উদ্যোক্তা জানান, গত বছরের এই সময়ের তুলনায় এখন পোশাকের ক্রয়াদেশ কমপক্ষে ২০ শতাংশ বেশি। তবে অনেক ক্ষেত্রেই ক্রেতারা গত বছর পোশাকের যে দাম দিয়েছেন, তার চেয়ে এ বছর ৫-৭ শতাংশ কম দাম দিচ্ছেন। অনেকেই বাধ্য হয়ে সেই ক্রয়াদেশ নিচ্ছেনও।
পোশাক কারখানায় ক্রয়াদেশের ভালো চাপ থাকার বিষয়টি ইতিমধ্যে রপ্তানি আয়ের পরিসংখ্যানে কিছুটা প্রতিফলিত হয়েছে। অর্থাৎ পোশাক রপ্তানি আয় বাড়ছে। সামনের মাসগুলোতে এর প্রতিফলন আরও বেশি দেখা যাবে। কারণ পোশাক রপ্তানির পর বিভিন্ন প্রক্রিয়া শেষে বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আসতে সাধারণত ৩-৪ মাস লাগে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যানুযায়ী, গত জানুয়ারিতে ২৮৮ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়। ফেব্রুয়ারি ও মার্চে রপ্তানি হয় যথাক্রমে ২৬০ ও ২৫৭ কোটি ডলারের পোশাক। পোশাক রপ্তানিতে ফেব্রুয়ারিতে ১৬ দশমিক ৮৬ ও মার্চে ১২ দশমিক ৬০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়। গত এপ্রিলে ২৪৭ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানির বিপরীতে প্রবৃদ্ধি ছিল ১১ দশমিক ৮৯ শতাংশ। ফলে সামগ্রিকভাবে চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে পোশাক রপ্তানিতে ৯ দশমিক ৩৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
পোশাক কারখানায় ক্রয়াদেশের বাড়তি চাপের কারণ কী—সে সম্পর্কে শিল্প উদ্যোক্তারা নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারেননি। তবে সম্ভাব্য দুটি কারণ হচ্ছে, প্রাইমার্ক, ভিএফ, ইন্ডিটেক্স, লি অ্যান্ড ফাংসহ কয়েকটি ব্র্যান্ড ও ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান নিজেদের ব্যবসা বাড়াচ্ছে। ফলে তারা গতবারের চেয়ে এবার ক্রয়াদেশ বেশি দিচ্ছে। ইউরোপের অর্থনৈতিক পরিস্থিতিও আগের চেয়ে ভালো হচ্ছে। তা ছাড়া চীনের পোশাক কারখানা থেকে অনেক ব্র্যান্ড ক্রয়াদেশের একাংশ সরিয়ে নিচ্ছে। বাংলাদেশ সেটির সুফল পাচ্ছে কিছুটা।
জানতে চাইলে তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সহসভাপতি মাহমুদ হাসান খান প্রথম আলোকে বলেন, বাড়তি ক্রয়াদেশ আসছে। গতবারের চেয়ে আনুমানিক ২০ শতাংশ ক্রয়াদেশ বেশি আসছে। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, সংস্কারকাজে বিপুল অর্থ ব্যয়ের সংস্থান করতে না পেরে অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। চীনের ক্রয়াদেশও আসছে। অনেক ব্র্যান্ডের ব্যবসা বেড়েছে। সব মিলিয়ে ক্রয়াদেশের চাপ বাড়ছে।
নারায়ণগঞ্জের পরিবেশবান্ধব নিট পোশাক কারখানা প্লামি ফ্যাশনস বিশ্বখ্যাত জারা, নেক্সট (ইউকে), পুল অ্যান্ড বিয়ার, আলদিসহ বিভিন্ন ব্র্যান্ডের কাজ করে। কারখানাটি আগামী তিন মাস পূর্ণ সক্ষমতায় পোশাক উৎপাদন করবে। বিষয়টি নিশ্চিত করে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ফজলুল হক গতকাল বিকেলে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের কারখানায় পর্যাপ্ত ক্রয়াদেশ আছে। আগস্টের পরের পোশাক তৈরির ক্রয়াদেশও নিয়ে আসছে অনেক ব্র্যান্ড ও ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান। সব মিলিয়ে বলা যায়, সামনের মাসগুলোতে ক্রয়াদেশের চাপ থাকবে বলেই মনে হচ্ছে।’
তৈরি পোশাকের ক্রয়াদেশ বৃদ্ধি পাওয়ায় সুতা, কার্টন, পলিব্যাগ, ব্যাক বোর্ড, বাটারফ্লাই, হ্যাঙ্গার, গামটেপসহ বিভিন্ন ধরনের সরঞ্জাম তৈরির কারখানায় চাপ বেড়েছে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ গার্মেন্টস এক্সেসরিজ অ্যান্ড প্যাকেজিং ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএপিএমইএ) সভাপতি আবদুল কাদের খান বলেন, গত জানুয়ারি মাস থেকে ক্রয়াদেশ প্রায় ২০ শতাংশ হারে বেড়েছে। প্রতিটি কারখানার হাতেই কাজ থাকলেও কমপ্লায়েন্ট কারখানাগুলো বেশি কাজ পাচ্ছে। তবে কাগজের দাম বেড়ে যাওয়ায় কার্টন উৎপাদকেরা খুব একটা সুফল পাচ্ছেন না। কারণ পোশাক কারখানার মালিকেরা খুব একটা দাম বাড়াচ্ছেন না।
এদিকে কারখানার মালিকদের কেউ কেউ বলছেন ক্রয়াদেশের চাপ থাকলেও দাম কমের কারণে এর সুবিধা পুরোপুরি নেওয়া যাচ্ছে না। নারায়ণগঞ্জের এমবি নিট ফ্যাশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘প্রতিদিনই পোশাক ক্রেতাদের অফার আসছে। তবে কিছু ক্রেতা যে দাম দিতে চাইছে তাতে আমাদের উৎপাদন খরচই উঠবে না। সে জন্য বর্তমানে আমার কারখানার উৎপাদন সক্ষমতার ৫০-৬০ শতাংশ বেশি ব্যবহার করতে পারছি না।’