চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে গেলেও কয়েকটি দেশে পোশাক রপ্তানিতে নেতিবাচব প্রভাব পড়েছে। তার মধ্যে তুরস্কে পোশাক রপ্তানিতে ভাটা পড়েছে গত চার বছরে। ২০১৩-১৪ অর্থবছর থেকে দেশটি বাংলাদেশর পোশাকের ওপর শুল্ক চাপ বাড়িয়ে। দেশটি অবশ্য এক্ষেত্রে নিজের দেশের পোশাক শিল্প বাঁচাতে এই পন্থা অবলম্বন করছে বলে জানা গেছে।
২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে দেশটিতে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি কমেছে ১৯.৩৫ শতাংশ। অর্থের হিসেবে ৪৪৮.৯৩ মিলিয়ন ইউএস ডলার। যা কিনা আগের অর্থবছরে ছিল ৫৫৬.৬৬ মিলিয়ন ডলারে। বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন বু্যরোর (ইপিবি) প্রকাশিত তথ্যে এমনটি উঠে এসেছে।
ইপিবি কর্মকর্তারা বলছেন, গত ১০ মাসের পরিসংখ্যান এটিই প্রমাণ করে চার বছর যাবত তুরস্কের বাজার নিয়মিতভাবে হারাচ্ছে ্বাংলাদেশ। ৬৩১.৬৩ মিলিয়ন ডলারের লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও অনেক কম রপ্তানি হবে বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।
রপ্তানিকারকরা বলছেন, ২০১১ সাল থেকে তুরস্ক বাংলাদেশের পোশাক খাতে শুল্কহারে কড়াকড়ি আরোপ করায় বাংলাদেশ এই প্রতিযোগিতায় অনেক পিছিয়ে যাচ্ছে। তুরস্ক বাংলাদেশের জন্য একটি আস্থার জায়গা ছিলো। কেবল সরকারের রাজনৈতিক উদ্যোগই পারে তুরস্কের বাজার পুনোরম্নদ্ধার করতে।
বিজিএমইএর সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট শহিদুল আজিম বলেন, দেশটিতে প্রাথমিক সেফগার্ড ডিউটির পরও ২০১৩-১৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি বাড়ছিল। যেটির প্রভাব ২০১৪-১৫ অর্থবছরেও ছিল।
শহিদুল আজিম আরও বলেন, তুরস্ক বাংলাদেশের জন্য একটি বড় বাজার ছিল। দেশটি আমাদের দেশ থেকে অ্যাপারেল আমদানি করে সেটি প্রক্রিয়াজাত করার পর আবার সেটি রাশিয়ায় রপ্তানি করত। এখন দেশটি তাদের নিজেদের শিল্প বাঁচানোর কথা বলে বাংলাদেশ থেকে প্রায় সব ধরনের অ্যাপারেল পণ্য আমদানি বন্ধ করে দিয়েছে। বাংলাদেশসহ এলডিসি ভুক্ত দেশগুলো থেকে অ্যাপারেল আমদানির ক্ষেত্রে তুরস্ক ২০১১ সালের সেে ১৭ শতাংশ রেটে সেফগার্ড ডিউটি আরোপ করত।
কিন্তু বেশি শুল্কআরোপের কারণে ২০১২ সালে তুরস্কে বাংলাদেশের অ্যাপারেল পোশাক রপ্তানি ২৪.৩৩ শতাংশ কমে গিয়েছিল। ২০১১ সালে সেদেশে ৭২৪.৪৫ মিলিয়ন ডলারের পোশাক রপ্তানি হলেও ২০১২ সালে ৫৫১.৮৭ মিলিয়ন ডলারে এসে দাঁড়ায়। অবশ্য ২০১৩ সালে সে দেশে ফের ১৫.৫৭ শতাংশ বেড়ে হয় ৬৩৭.৮১ মিলিয়ন ডলার। সর্বশেষ সবচেয়ে ভালো পোশাক রপ্তানি হয়েছিল ২০১৪ অর্থবছরে। সে বছর দেশটিতে পোশাক রপ্তানি ৩৪.২৩ শতাংশ বেড়ে দাঁড়ায় ৮৫৬.১৯ মিলিয়ন ডলারে।
তুরস্কের বাজারে পোশাক খাতের পতন শুরম্ন হয় ২০১৫ সাল থেকে। ইপিবির দেয়া পরিসংখ্যান বলছে, ওই বছর দেশটিতে পোশাক রপ্তানি ১৫.৮০ শতাংশ কমে দাঁড়ায় ৭২০.৮৮ শতাংশে। যেটি আগের বছর ছিল ৮৫৬.১৯ ডলার। ২০১৬ সালে দেশটিতে রপ্তানির পরিমাণ আরও কমে যায়। এ বছর ৮.১৮ শতাংশ কমে দাঁড়ায় ৬৬১.৮৮ মিলিয়ন ডলারে। ২০১৭ সালে সেটি আরও ৪.৫৭ শতাংশ কমে সেটি গিয়ে দাঁড়ায় ৬৩১.৬৩ মিলিয়ন ডলারে।
তুরস্ক বিশ্বের অন্যতম পোশাক রপ্তানিকারক দেশ। বাংলাদেশের অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবেও বিবেচনা করা হয় দেশটিকে। সারাবিশ্বে দেশটির ১৭ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রপ্তানির বাজার রয়েছে।
জানা গেছে, ধারাবাহিক এ পতনের পেছনে স্থানীয় শিল্প রক্ষায় তুরস্ক সরকারের নেয়া নীতি। বাংলাদেশসহ সব দেশ থেকে পোশাক আমদানিতে শুল্ক আরোপ করা হয় ২০১১ সালে। মূলত এ কারণেই তুরস্কে রপ্তানি কমছে ধারাবাহিকভাবে। এ ছাড়া বাংলাদেশের কাছে দ্বিতীয় রফতানিকারকের মর্যাদা হারানোর কারণে তৈরি হওয়া মনস্ত্মাত্ত্বিক দূরত্বও রফতানি কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ।
স্থানীয় পোশাক শিল্পের স্বার্থে ২০১১ সালে সুরক্ষা নীতি নেয় তুরস্ক সরকার। এ প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশসহ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে পোশাক আমদানিতে ২৭ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়। উন্নয়নশীল দেশের জন্য এ হার ৩৭ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত্ম। ওই বছরের ২২ জুলাই থেকে এ সিদ্ধান্ত্ম কার্যকর হওয়ার আগে তুরস্কে রফতানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা ভোগ করেছে বাংলাদেশ।
পোশাক ছাড়া অন্যান্য পণ্যের রফতানিও কমছে তুরস্কে। সার্বিক রপ্তানি ২০১৩-১৪ অর্থবছরের ৮৬ কোটি ডলারের রপ্তানি পরের অর্থবছর (২০১৪-১৫) ৭২ কোটি ডলারে নেমে আসে। গত অর্থবছরে ৬৬ কোটি ডলারে নেমে এসেছে। তৈরি পোশাকের বাইরে তুরস্কে রফতানি তালিকায় রয়েছে পাট, পাটের সুতা, চামড়া ও সিরামিক পণ্য।
২০১০ সালের নভেম্বরে ঢাকা সফরে তুরস্কের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী এবং বর্তমান প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়েপ এরদোয়ান বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য ৩০০ কোটি ডলারে উন্নীত করার ঘোষণা দেন। তবে পোশাক আমদানিতে শুল্ক আরোপের কারণে দুই দেশের বাণিজ্য তিন বছর আগের অবস্থানে থমকে আছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, দুই দেশের বাণিজ্য এখনো ১০০ কোটি ডলারের মধ্যেই সীমিত। তুলা এবং বস্ত্র খাতের যন্ত্রপাতি ও নির্মাণসামগ্রী আমদানি করা হয় তুরস্ক থেকে।
তুরস্কের সঙ্গে এফটিএ হলে বাংলাদেশের প্রধান পণ্য তৈরি পোশাকের রপ্তানি বর্তমানের দ্বিগুণ হবে বলে মনে করেন রপ্তানিকারকরা। প্রধান প্রধান অন্যান্য পণ্যও রপ্তানিতে বড় ধরনের সুবিধা পাবে। চার বছর আগে স্থানীয় শিল্পের স্বার্থে নেওয়া সুরক্ষানীতির কারণে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকে ২৭ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে দেশটি। এ কারণে রপ্তানিতে এক রকম ধস নামে।
২০১০ সালে তৈরি পোশাকের বিশ্ববাজারে তুর্কিকে পেছনে ফেলে দ্বিতীয় প্রধান রপ্তানিকারক দেশের মর্যাদা পায় বাংলাদেশ। এর পরের বছরই পোশাক আমদানিতে শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত্ম নেয় তুরস্ক।