যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি পোশাকের বাজারে একচেটিয়া প্রাধান্য বিস্তার করতে পারে ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’। গত শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প চীনা পণ্যের ওপর দ্বিতীয় দফা শুল্ক আরোপের যে ঘোষণা দিয়েছেন তা কার্যকর হলে তৈরি পোশাক রফতানিতে বাংলাদেশের অবস্থান সুদৃঢ় হবে বলে ইঙ্গিত দিয়েছে আন্তজার্তিক গণ্যমাধ্যম।
বিনিয়োগ বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, প্রায় সব চীনা পণ্যে আমদানিতে শুল্ক বসাতে প্রস্তুত ট্রাম্প। নতুন দফায় শুল্ক আরোপের ফলে প্রায় ২৫ হাজার কোটি ডলার মূল্যের চীনা পণ্য ওয়াশিংটনের শাস্তিমূলক শুল্কের আওতায় পড়বে। এতে গেল বছরে যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি হওয়া প্রায় অর্ধেক চীনা পণ্যই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। নতুন দফা শুল্ক আরোপ প্রসঙ্গে আলোচনার সময়সীমা গত বৃহস্পতিবার শেষ হয়েছে। এর মানে দাঁড়াচ্ছে, যেকোনো মুহূর্তে ওই শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিতে পারবেন ট্রাম্প।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের সূত্রগুলোর দাবি, যদি ট্রাম্পের নতুন পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয় তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে চীনের পোশাক রফতানির পরিমাণও কমে আসবে। আর তখন সেখানে বাংলাদেশের শীর্ষস্থানে ওঠার সুযোগ থাকবে।
বিজেএমইএ’র সভাপতি মো. সিদ্দিকুর রহমান ইনকিলাবকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র যদি চীনের পোশাকখাতে শুল্ক আরোপ করে তা হবে বাংলাদেশের জন্য বড় একটি সুযোগ। তবে পোশাকখাতের ওপর শুল্ক বসাচ্ছে কিনা তার উপর নির্ভর করতে হচ্ছে আমাদের। এখনও সুনির্দিষ্ট ধারণা পাইনি। এ জন্য আরও কিছুদিন আমাদের অপেক্ষা করতে হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
এক জরিপে জানানো হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র-চীনের মধ্যকার বাণিজ্য দ্ব›দ্ব বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমেরিকার ফ্যাশন শিল্পগুলোতে বাংলাদেশে তৈরি পোশাকের আমদানি অনেক বেড়ে যাবে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের পোশাক তৈরি ও বিক্রেতাদের সংগঠন ইউএস ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি অ্যাসোসিয়েশন-ইউএসএফআইএ পরিচালিত এক জরিপে এই তথ্য জানা গেছে। জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ৬৭ শতাংশই মনে করেন, আগামী দুই বছরের মধ্যে চীন থেকে পোশাক আমদানি কমে যাবে। ফলে বাংলাদেশ থেকে পোশাক আমদানি রেকর্ড মাত্রায় বাড়বে। ‘ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি বেঞ্চমার্কিং স্টাডি-২০১৮’ নামে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের ফ্যাশন শিল্পগুলোতে পোশাক সরবরাহকারী দেশের তালিকায় গত বছর বাংলাদেশের অবস্থান ছিল সপ্তম, যা এ বছর হয়েছে পঞ্চম।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, জরিপের উত্তরদাতারা চীনের বিকল্প হিসেবে আগামী দুই বছরে বাংলাদেশ থেকে পোশাক আমদানি করতে বেশি আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এখনই পোশাক আমদানিতে শীর্ষ স্থান থেকে চীনকে সরানো সম্ভব নয়। কিন্ত এশিয়ার অন্য অনেক সরবরাহকারীর চেয়ে ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ পণ্য অনেক বেশি গুরুত্ব পাবে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- জরিপের প্রায় অর্ধেক উত্তরদাতা মনে করেন, ২০২০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে পোশাক আমদানি আরও বাড়বে। যা ২০১৭ সালে কাপড় আমদানির তুলনায় ৩২ শতাংশ বেশি হতে পারে। তবে বাংলাদেশের ‘কমপ্লায়েন্স ঝুঁকি’ উদ্বেগের কারণ হিসেবে এখনও রয়ে গেছে এবং এটাকে বড় ধরনের দুর্বলতা হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। জানা গেছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চীন বছরে প্রায় ১১ দশমিক ৪০ বিলিয়ন ডলারের পোশাক সামগ্রী রফতানি করে। যেখানে বাংলাদেশ প্রায় ৫ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার এবং ভিয়েতনামের প্রায় ১১ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলার রফতানি করে।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ট্রাম্প চীনের পোশাক রফতানির উপর ট্যারিফ বসানোর যে ঘোষণা দিয়েছে, তা বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের সুবিধা বাড়বে তবে এটাকে তিনি সাময়িক হিসেবে দেখছেন এই অর্থনীতিবিদ। কারণ কোনও বাণিজ্য যুদ্ধ বিশ্ব অর্থনীতির জন্য ভাল নয় বলে মন্তব্য করেন তিনি।
এদিতে গতকাল আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, চীনের ২০ হাজার কোটি ডলারের পণ্যে ওয়াশিংটন যদি নতুন করে শুল্ক আরোপ করে, তাহলে পাল্টা জবাব দেবে বেইজিং। অপরদিকে নতুন করে চীনা পণ্যে শুল্ক আরোপ বন্ধ করতে ট্রাম্পের কাছে আবেদন জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষস্থানীয় প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো। গত ৬ জুলাই থেকে ৫ হাজার কোটি ডলার মূল্যের চীনা পণ্যে বহাল ২৫ শতাংশ শুল্কের সঙ্গে চলতি সপ্তাহে আরো ২০ হাজার কোটি ডলার পণ্যে শুল্ক আরোপের কথা চলছিল। গত সপ্তাহে ব্লু মবার্গের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারেও চীনা পণ্যে নতুন করে শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্তের পক্ষে সাফাই গেয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ওই সাক্ষাৎকারে ট্রাম্প তার দীর্ঘদিনের অভিযোগগুলো পুনর্ব্যক্ত করেছেন। তিনি মনে করেন, চীন যুক্তরাষ্ট্র থেকে পাওয়া সুযোগের অপব্যবহার করেছে। তিনি বলেন, এখন সময় এসেছে, সেটি বন্ধ করার। আমরা এমনটি চলতে দিতে পারি না।
ট্রাম্প প্রশাসন কবে নাগাদ এ শুল্ক আরোপ করতে পারে তা নিয়ে বৃহস্পতিবার থেকেই কানাঘুষা চলছিল। ধারণা করা হচ্ছিল, গত শুক্রবারই এটা কার্যকর করবে ট্রাম্প কিন্ত গতকাল রোববার এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত সেটি আরোপ হয়নি।
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে তৈরি পোশাক (আরএমজি) রফতানিতে আগের বছরের নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি ছাপিয়ে সদ্য বিদায়ী অর্থবছরে তিন শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছে একসময়ের বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় তৈরি পোশাক রফতানিকারক দেশটিতে। তবে চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক রফতানিতে প্রধান প্রতিদ্ব›দ্বী জার্মানি নয় শতাংশ প্রবৃদ্ধি করে ছাড়িয়ে গেছে যুক্তরাষ্ট্রকে। একইভাবে পোশাক রপ্তানিতে তৃতীয় স্থানে থাকা যুক্তরাজ্যে রফতানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ১৩ শতাংশ। এই দুটি দেশকে বিবেচনায় নিলে গত অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি পোশাকের রফতানিতে প্রবৃদ্ধিতে মন্দা কাটলেও চাঙ্গাভাব ফিরে আসেনি। তবে সহসা আমেরিকার বাজারে বাংলাদেশি তৈরি পোশাক পণ্য আবারও প্রাধান্য বিস্তার করবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়া ইউনিভার্সিটির প্রফেসর মার্ক অ্যানার একটি গবেষণার উদাহরণ দিয়ে বলেন, এক গবেষণায় দেখা গেছে আমেরিকায় গত ২০ বছরে বাংলাদেশি তৈরি পোশাকের দাম ৪০ শতাংশ কমেছে। বায়াররা বিভিন্ন ইস্যুতে কারখানা মালিকদের খুঁত ধরতে ব্যস্ত থাকলেও পোশাকের দাম বাড়ানোর ব্যাপারে তাদের কোনো আগ্রহ নেই। কিন্ত এর মধ্যেও সে দেশে বাংলাদেশি পোশাক রফতানি বেড়েই চলেছে। এটা এককভাবে শ্রমিক-মালিকদের কাজের দক্ষতার প্রমাণ।
এক্সপোর্টাস এসোশিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইএবি) সভাপতি এবং বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি সংসদ সদস্য আবদুস সালাম মুর্শেদী বলেন, যে কোন ট্যারিফ সুবিধাই আমাদের জন্য ভালো। বর্তমান বাণিজ্য যুদ্ধ আমাদের গার্মেন্টসসহ রপ্তানিমুখী শিল্পের জন্য আর্শীবাদ হয়ে দেখা দিতে পারে। তিনি বলেন, এ ধরণের সুবিধা পেলে রপ্তানিমুখী শিল্পে গতিশীলতা আসে। তবে রপ্তানিমুখী শিল্পে নানা চ্যালেঞ্জও রয়েছে। অন্যান্য দেশগুলোর সাথে আমরা অনেক পিছিয়ে। কারণ প্রতিযোগী দেশগুলো আন্তর্জাতিক নীতি অনুসরণ করে দ্রুত তা সমন্বয় করে। যেটা আমরা করতে পারি না। তাই আমরা অনেক পিছিয়ে। সালাম মুর্শেদী ট্যারিফ সুবিধা সহ অন্যান্য সুবিধা কাজে লাগাতে সক্ষমতা বাড়ানোর তাগিদ দেন।