তৈরি পোশাক শিল্পের নতুন গন্তব্যে রপ্তানি বাড়ছে। এ পোশাক শিল্প থেকে ২০২১ সালের মধ্যে ৫০ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা পূরণে নতুন বাজার সৃষ্টিতে বরাবরই জোর দিয়ে আসছিলেন প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে বিজিএমইএ। এ জন্য নতুন বাজারে পোশাক রপ্তানিতে ৪ শতাংশ নগদ প্রণোদনার ঘোষণাও রয়েছে। আর নতুন গন্তব্যের সুযোগ ভালোভাবেই কাজে লাগাতে পারছেন ব্যবসায়ীরা। চলতি অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবর পর্যন্ত চার মাসে জাপান, ভারত ও রাশিয়ার বাজারে তৈরি পোশাক রপ্তানি প্রবৃদ্ধিতে বেশ ভালো উল্লম্ফন হয়েছে। এই তিন দেশে গত চার মাসে রপ্তানিতে ৬৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। মূলত কারখানা কমপ্লায়েন্স ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির স্থিতিশীলতার কারণেই নতুন বাজারে এই সুফল পাওয়া গেছে বলে মনে করছেন তৈরি পোশাক খাতসংশ্লিষ্টরা।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো থেকে প্রাপ্ত তথ্য মতে, জাপান, ভারত ও রাশিয়ার বাজারে গত চার মাসে মোট ৬৭ কোটি ২৮ লাখ ডলার মূল্যের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে। গত অর্থবছরে একই সময়ে এই তিন দেশে রপ্তানি হয়েছিল ৪০ কোটি ৭২ লাখ ডলার। অর্থাৎ অর্থবছরের চার মাসেই রপ্তানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬৫.২ শতাংশ।
জাপান মার্কেটে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের প্রবৃদ্ধির উল্লম্ফনে বেশ স্বস্তি প্রকাশ করছেন তৈরি পোশাকসংশ্লিষ্টরা। গত ১ জুলাই ২০১৬ ঢাকার গুলশানে হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টের ভয়াবহ হামলায় একাধিক জাপানি নাগরিক নিহতের ঘটনায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পে। জাপান সরকার নাগরিকদের বাংলাদেশ সফরের ক্ষেত্রেও কড়াকড়ি আরোপ করে। এ কারণে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে জাপানে পোশাক রপ্তানি প্রবৃদ্ধিও নেতিবাচক অবস্থানে ছিল। তবে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে খারাপ সময় কাটিয়ে ওঠার ইঙ্গিত মেলে। গত অর্থবছরে প্রায় ১৪ শতাংশ রপ্তানি প্রবৃদ্ধিসহ তৈরি পোশাক রপ্তানি হয় ৮৪ কোটি ৬৭ লাখ ডলার। চলতি অর্থবছরে জুলাই-অক্টোবর পর্যন্ত প্রথম চার মাসে জাপানে ৩৬ কোটি ৭০ লাখ ডলার বা তিন হাজার ১৬৬ কোটি টাকা সমমূল্যের তৈরি পোশাক পণ্য রপ্তানি হয়েছে, যা আগের অর্থবছরের এই সময়ের ২৩ কোটি ৩৫ লাখ ডলারের চেয়ে ৫৭ শতাংশ বেশি। প্রবৃদ্ধির গতি অব্যাহত থাকলে চলতি অর্থবছরে প্রথমবারের মতো এক বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে। রপ্তানি পণ্যের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৯ কোটি ৭৬ লাখ ডলারের জার্সি রপ্তানি হয়েছে। টি-শার্ট রপ্তানি হয়েছে সাত কোটি ১৩ লাখ ডলারের।
জাপানের বাজারে তৈরি পোশাকের রপ্তানি প্রবৃদ্ধিকে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের ভাবমূর্তির সহায়ক হিসেবেই দেখছে ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস ফোরাম, চট্টগ্রাম চ্যাপ্টারের সভাপতি এবং বিজিএমইএর সাবেক প্রথম সহসভাপতি আবু তৈয়ব। কারণ হিসেবে তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘জাপানের বাজারে বাংলাদেশের পোশাকের আধিপত্য আমাদের সক্ষমতার প্রমাণ দেয়। কারণ জাপানিরা বিশ্বের সবচেয়ে নাক উঁচু জাতি। তাদের কোনো কিছু দিয়ে সন্তুষ্ট করতে পারার অর্থ হচ্ছে আপনার কাজ নিখুঁত।’
তিনি বলেন, ‘কষ্ট হলেও আমাদের কারখানাগুলো কমপ্লায়েন্স হয়ে যাওয়াটা কিন্তু বহির্বিশ্বে আমাদের জন্য সার্টিফিকেটের মতো কাজ করছে। আমাদের ভাবমূর্তি বেড়েছে। জাপানিরা যে ধরনের কমপ্লায়েন্স কারখানায় কাজ করতে চায় তেমন সার্টিফায়েড কারখানা আমাদের আছে।’
তবে প্রবৃদ্ধির হিসেবে দেড় বছর ধরেই প্রতিবেশী দেশ ভারতের বাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক নিজেদের অবস্থান শক্ত করে নিচ্ছে। গত অর্থবছরে ভারতের বাজারে তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে ২৭ কোটি ৮৬ লাখ ডলার, যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ১১৫ শতাংশ বেশি। তবে চলতি অর্থবছরের রপ্তানি প্রবৃদ্ধির গত বছরকেও ছাপিয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত মিলছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরের অক্টোবর পর্যন্ত চার মাসে ভারতে তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে ১৮ কোটি ৭৩ লাখ ডলারের, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার বেশি। গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ১৬৯ শতাংশ বেশি। এর মধ্যে নিট পণ্য পাঁচ কোটি সাত লাখ ডলার এবং ওভেন পণ্য ১৩ কোটি ৬৬ লাখ ডলার।
ভারতে রপ্তানি হওয়া তৈরি পোশাক পণ্যের মধ্যে সবচেয়ে বেশি গেছে জ্যাকেট। মোট রপ্তানির আট কোটি ৬৭ লাখ ডলারই ছেলে ও মেয়েদের জ্যাকেট। এ ছাড়া ছেলেদের শার্ট রপ্তানি হয়েছে তিন কোটি ৩৮ লাখ ডলার।
বেনাপোল কাস্টম হাউস থেকে প্রাপ্ত তথ্য মতে, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত চার হাজার ৪০ কোটি টাকা মূল্যের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। এর বড় অংশই তৈরি পোশাক। এসব পণ্যের মধ্যে উচ্চ মূল্যের তৈরি পোশাকের নামি ব্র্যান্ড জারা, সিএনএ, উমা, এফএইচএনএমের ট্রাউজার, টি-শার্ট, শার্ট-প্যান্ট উল্লেখযোগ্য।
ভারতের বাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের অবস্থানের ব্যাপারে জানতে চাইলে বিজিএমইএ পরিচালক ও মিরেজ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী মাহবুব উদ্দিন জুয়েল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ভারত বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের জন্য খুবই সম্ভাবনাময় বাজার। জনসংখ্যার বিচারে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে প্রায় পাঁচ গুণ মানুষের বাস ভারতে। দিন দিন তাদের ক্রয়ক্ষমতাও বেশ ভালোভাবেই বাড়ছে। সহযোগিতা পেলে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে বড় বাজার হবে ভারত।’