Home Bangla Recent আইন অনুযায়ী লভ্যাংশ পাচ্ছে না পোশাক শ্রমিকরা

আইন অনুযায়ী লভ্যাংশ পাচ্ছে না পোশাক শ্রমিকরা

একের পর এক দেশের তৈরি পোশাক শিল্পের সাফল্যগাঁথা। মালিকের ভাগ্য পরিবর্তন হলেও শ্রমিকরা রাজপথ ছাড়তে পারছে না। ৩০ লাখ শ্রমিকের কর্মসংস্থানের দোহাই দিয়ে সরকারের কাছ থেকে একের পর এক সুযোগ সুবিধা আদায় করে নিচ্ছে মালিকরা। এবার গেল ৫ বছরের বকেয়া ভ্যাট দিতে চান না দেশের তৈরি পোশাক মালিকরা। সম্প্রতি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাছে এমন দাবি জানিয়েছে পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ।

শ্রম আইন অনুযায়ী কোন কারখানার বছর শেষে লাভ হলে সে লাভের একটি অংশ পায় শ্রমিকরা। কিন্তু বাংলাদেশের পোশাক খাতের শ্রমিক এ লভ্যাংশ পায় না। শ্রম আইনে দুই থেকে ৫ শতাংশ লভ্যাংশ দেয়ার নিয়ম রয়েছে। তারা জানতেও পারে না তাদের কোম্পানি কত শতাংশ লাভ করেছে অথবা কত শতাংশ লোকসান করেছে। তবে মালিকরা বলছেন, চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে এ সব শর্ত উল্লেখ্য থাকতে হবে। তারা জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত শ্রমিক হিসেবেই কাজ করে যান। তাদের ভাগ্যও পরিবর্তন হয় না।

গতকাল শুক্রবার জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে পোশাক শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ১৬ হাজার টাকা নির্ধারণের দাবি জানিয়েছে বিপ্লবী গার্মেন্টস শ্রমিক সংহতি। আয়োজিত প্রতিনিধি সম্মেলনের উদ্বোধনী সমাবেশে এ দাবি জানানো হয়। সংগঠনটি শ্রমিক ছাঁটাই, নির্যাতন, মিথ্যা মামলা, হয়রানি বন্ধেরও আহ্বান জানিয়েছে।

সমাবেশে বিপ্লবী গার্মেন্টস শ্রমিক সংহতির সভাপতি মীর মোফাজ্জল হোসেন মোস্তাক, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, শ্রমজীবী নারী মৈত্রী সভাপতি শিখা জামালী, শ্রমিক নেতা আবু হাসান টিপু প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

সমাবেশে বক্তারা বলেন, পোশাক শ্রমিকরা সরকার আর মালিকের রোষানলের শিকার। ৮ হাজার টাকা মজুরি দিয়ে পাঁচজনের সংসার মাসের ১০ দিনও চলে না। তাই মানবিক কারণেই পোশাক শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ১৬ হাজার টাকা করা উচিত।

তারা বলেন, এক মাসে ৮ থেকে ১০ হাজার শ্রমিককে গার্মেন্টস থেকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। অথচ কোনো সচেতন শ্রমিক এখন আর কারখানা ভাঙচুর করে না। কারণ, তারা জানে, কারখানা না থাকলে তাদের জীবন বাঁচবে না। তারা এখন শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করে। আমরা বলতে চাই, আগামী ৭২ ঘণ্টার মধ্যে মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার ও শ্রমিক ছাঁটাই বন্ধ করুন। তা না হলে শ্রমিক অসন্তোষের দায় আপনাদেরকেই নিতে হবে।

রানা প্লাজা ধ্বসের পর তৈরি পোষাক শিল্পে নেমে আসে আন্ধকার যুগ। সারা বিশ্ব মুখ ফিরিয়ে নিতে থাকে। এমতাবস্থায় নতুন বাজার তৈরিতে মনোযোগী হয় বাংলাদেশ। একই সাথে সারা বিশ্বে রোর্ড শো করে বাংলাদেশ। পোষাকের মান আর মজুরির কারণে বাংলাদেশ আবারও তার বাজার ফিরে পায়। শুধু তাই না বাজার আরও সম্পাসারন হয়েছে। এতে করে বাংলাদেশে অনেক বিশ্বমানের কারখানা তৈরি হয়েছে।

রানা প্লাজা ধ্বংসের পর বেশ ভালোভাবেই ঘুরে দাঁড়িয়েছে দেশের তৈরি পোশাক খাত। তৈরি হচ্ছে একের পর এক বিশ্বমানের কারখানা। এ সব কারখানা তৈরি হচ্ছে বিশ্বেও মানসম্মত পোষাক। কারখানা মালিকের ভাগ্যেও অনেক পরিবর্তন হলেও শ্রমিকরা তাদের দাবি আদায়ে এখনও রাজপথে দেখা মেলে। লাভ আর লোকসানের হিসাবে শ্রমিকের ভাগ্যে শূন্য। দাবি আদায়ে রাজপথে নামলেই চালানো হয় গুলি আর গ্রেফতার।

মালিকরা বলে আসছে শ্রমিকদের দাবি অনুযায়ী বেতন ভাতা দেয়া হলে অধিকাংশ কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে। শ্রমিকরা বেকার হয়ে পড়ছে। এসব আন্দোলনের পেছনে রয়েছে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র। দাবি আদায়ে শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করা হচ্ছে না। তাদের দাবি আদায়ে কেউ কথা বলছে না। চলতি অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসে শুধু যুক্তরাষ্ট্রের বাজারেই রপ্তানি বেড়েছে প্রায় ১৯ ভাগ, পুরো বিশ্বে যা ১৬ শতাংশের মত আর নতুন বাজারে তা ৩৬ শতাংশ।

সরকার নতুন বাজার তৈরি করতে সারা বিশ্বে রোড-শো করা হয়েছে। এতে করে বাজার বেড়েছে অনেক গুণ। বাজার বৃদ্ধিতে শ্রমিকের কর্মসংষÍানও বেড়েছে। তবে শ্রমিকের চাহিদা সৃষ্টি হলেও তাদেও দিন পরিবর্তন হচ্ছে না।

জানা গেছে, শ্রম বাজার বাংলাদেশের দখলে থাকলেও তৈরি পোষাক খাতে উচ্চপদস্থ সব পদ বিদেশিদের দখলে রয়েছে। শুধু শ্রম বিক্রি করে কেউ ধনী হতে পারে না। এ শ্রেনির লোকেরা কোন দুনীতি করার সুযোগও পায় না। পোষাক কারখানা আমাদের আর এখানে নিয়ন্ত্রন বাহিরের। তারা নানাভাবে দুর্নীতিও করছে।

সরকারও পোশাক খাতকে এগিয়ে নিতে দিচ্ছে একের পর এক নীতি সহায়তা। বাজেটে কমেছে কর্পোরেট কর, হাতে গোনা কয়েকটি সেবা বাদ দিয়ে সব পণ্য ও সেবার ক্ষেত্রেই দেওয়া হয়েছে ভ্যাট অব্যাহতি। তবে এতেও সন্তুষ্ট নন পোশাক মালিকরা।

গেল মাসেই এনবিআরের সাথে এক বৈঠকে দেশের বাজার থেকে নেওয়া যে কোন পণ্য ও সেবার ক্ষেত্রেই ভ্যাট না নেওয়ার দাবি জানায় বিজিএমইএ। পাশাপাশি গেল ৫ বছরের বকেয়া ভ্যাটও মওকুফের দাবি তাদের।

এব্যাপারে জানতে চাইলে, বিজিএমইএ’র সহ-সভাপতি মোহাম্মদ নাসির বলেন, সরকার সরাসরি ভ্যাট না নিলেও পরোক্ষভাবে ভ্যাট নিচ্ছে। এতে আমাদের অনেক ব্যবসায়ী হয়রানির শিকার হন। আমরা চাইনা এ খাতে কোন ভ্যাট থাকুক।

আমরা চাই গত পাঁচ বছরে বকেয়া ভ্যাট যাতে সরকার মওকূফ করে দেয়। সরকার চাই এটি কোন ব্যাপারই না। একই সাথে উৎসে আয় আয় যারা বেশি দিয়েছে তাদেও বর্ধিত টাকাও সরকার ফেরত দিতে পারে। এতে জটিলতার কিছু নেই।

সরকারের কাছে পোশাক মালিকদের দাবি দাওয়ার এখানেই শেষ নয়। এ বছরের শুরুতেই এ খাতের উৎসে কর দশমিক ৬ শতাংশ থেকে কমিয়ে করা হয় দশমিক ২৫ শতাংশ। আদেশ অনুযায়ি যা কার্যকরের কথা গেল বছরের জুলাই থেকেই। ফলে জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে যাদের উৎসে কর কাটা হয়ে গ্যাছে তারাও এখন সেই টাকা ফেরত চাচ্ছেন।

এ বছরের শুরুতেই শ্রমিক বিক্ষোভের জেরে সংশোধন করা হয়  তৈরি পোশাক খাতের জন্য প্রস্তাবিত ন্যুনতম মজুরি কাঠামো। নতুন মজুরি কাঠামো বাস্তবায়নের দাবিতে ঢাকার সাভারে বিক্ষুব্ধ পোশাক শ্রমিকদের সঙ্গে পুলিশের সংঘাতের মধ্যে একটি কারখানায় এক শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে।

নিহত সুমন মিয়ার (২২) আনলিমা টেক্সটাইলের এই শ্রমিক। তৈরি পোশাক শিল্পে শ্রমিকদের মজুরি সকার বাড়ালেও মালিক পক্ষ সে অনুযায়ী বেতন দিচ্ছে না বলে অভিযোগ তুলে গত প্রায় দুই মাস ধরে ঢাকার বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ করছেন শ্রমিকরা।

শ্রমিকদের এ আন্দোলন এক পর্যায়ে আশুলিয়ার শিমুলতলা, কাঠগড়া জিরাব এলাকার উত্তরা গাজিপুর,নরসিংদি,নারায়নগঞ্জ,মিরপুর বাড্ডা এলাকায় ছড়িয়ে পরে। এ আন্দোলনের প্রায় পাঁচ শতাধিক শ্রমিক আহত হয়। প্রায় দুই শতাধিক কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। তারপরেও গার্মেন্ট মালিকরা বলছেন,বেতন বাড়ানো হলে কারখানা বন্ধ হয়েে যাবে।

কোনভাবেই তারা আর শ্রমিকের বেতন ভাতা বাড়াতে পারবেনা। এক পর্যায়ে সরকার এবং শ্রমিকদের চাপে তারা কিছুটা নমোনিয় হয়েছে। বেতন কাঠামোতে তারা কিছুটা পরিবর্তন এনেছেন। পরে শ্রমিকরা তাদেও আন্দোলন থেকে সরে দাড়ায়। এর পরেই তারা জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এনবিআরের কাছে ৫ বছরের বকেয়া ভ্যাট আদায়ের দাবি জানান।

কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন,বকেয়া কোনভাবেই মওকুফ করা ঠিক হবে না। বকেয়া তাদের পরিশোধ করা উচিৎ।

এ ব্যাপারে টিআইবি’র রিসার্চ ফেলো ড. মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন,বকেয়া তাদের আদায় করা উচিত। এটি মওকুফ করা ঠিক হবে না। তবে যখন থেকে আইন করা হয়েছে তখন থেকেই এ সুবিধা দেয়া উচিত।

গত বাজেটে তাদের যে সুবিধা দেয়া হয়েছে তা বহাল থাকা উচিত। উৎসে আয় কর কমিয়ে তাদের যে সুবিধা দেয়া হয়েছে এ সুবিধা বহাল রাখা উচিত। তবে যারা পরিশোধ করেছে তা ফেরত দেয়া ঠিক হবে না।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন,মালিকরা বলছেন তাদের অবস্থা নাকি ভালো না। অথচ যে মালিক আগে একটি কারখানার মালিক ছিল সে এখন গ্রুপ কোম্পানির মালিক। তার এখন দশটি কারখানা রয়েছে। ব্যবসা খারাপ হলে এসব কারখানা কিভাবে হলো।

তারা বলেন, সারা বিশ্বে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের কদর রয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে এ শিল্প খাতটি বিশেষ অবদান রেখে চলছে। সরকার নানাভাবে এখাতে বিশেষ সুবিধা দেয়ায় বিশ্ব বাজাওে মজবুত অবস্থান করতে সক্ষম হয় বাংলাদেশ। প্রতিটি মালিকের ভাগ্যেও পরিবর্তন হলেও কোন শ্রমিকেরই ভাগ্যেও পরিবর্তন হয়নি। এ নিয়ে গত প্রায় দুই যুগ ধরেই আন্দোলন করে আসছে শ্রমিকরা। দ্রব্যমূল্য আর বাসা ভাড়া দিয়ে কোনভাবেই শ্রমিকরা সঞ্চয় করতে পারছে না। অনেকে উল্টো ঋনের জালে আটকে যাচ্ছে।

তারা আরও বলেন,মালিক পক্ষ কোনভাবেই স্বীকার করতে রাজি না যে তারা ভালো আছে। সারা বিশ্বে তারা নিজেদের সুনাম অর্জন করে চলছে। কিন্তু শ্রমিকদের দাবির সাথে তারা দিনই একমত প্রকাশ করেনি। আন্দোলনের মুখে তারা কারখানা বন্ধ করে নতুন কারখানা খুললেও শ্রমিকদের দাবি মানতে নারাজ। এভাবেই চলছে বাংলাদেশের তৈরি পোষাক শিল্প।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here