দেশের প্রধান রপ্তানি আয়ের খাত তৈরি পোশাকশিল্পের উন্নয়ন গত কয়েক বছর ধরে নানা কারণে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। রানা প্লাজাধস ও তাজরিন ফ্যাশন গার্মেন্টসে অগ্নিকা-ের পর বড় খাদের মুখে পড়ে এ খাত। মার্কিন ক্রেতাদের জোট অ্যাকর্ড ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর ক্রেতাদের জোট অ্যালায়েন্সের বেশ কিছু কঠিন শর্তারোপের পাশাপাশি কুচক্রীদের নেতিবাচক প্রচার বিশ্ববাজারে তৈরি পোশাক খাতের অবাধ বিচরণকে প্রশ্নের মুখে ফেলে। তদুপরি রয়েছে দেশি-বিদেশি চক্রান্ত, পর্যাপ্ত গ্যাস-বিদ্যুতের অভাব, ব্যাংকঋণের উচ্চ সুদহার ও অবকাঠামোগত সমস্যা; রয়েছে শ্রমিক বিক্ষোভও।
এত সব প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও এ খাতের উন্নয়নে সরকারের নানাবিধ পৃষ্ঠপোষকতা ও উদ্যোক্তাদের অবিচল প্রচেষ্টায় প্রতিবছরই বাড়ছে দেশের তৈরি পোশাক খাতের রপ্তানি। গত পাঁচ বছরে এ খাতে রপ্তানি বেড়েছে ২৫ শতাংশ। বর্তমানে রপ্তানি আয়ের ৮৩ শতাংশই আসে এ খাত থেকে। দেশের শিক্ষিত তো বটেই, অর্ধশিক্ষিত ও অশিক্ষিত বেকার নারী-পুরুষের কর্মসংস্থানেও তৈরি পোশাক খাতের অবদান অনস্বীকার্য হয়ে পড়েছে। তদুপরি আন্তর্জাতিক বাজার বিস্তৃতির লক্ষ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছুটছেন সংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তারা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘ভিশন-২০২১’ সামনে রেখে এ সময়কালের মধ্যে ৫০ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন তৈরি পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা। তারা বলছেন, ব্যাংকঋণের সুদহার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনার পাশাপাশি এ খাতকে করমুক্ত করা হলে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা অসম্ভব নয়। পাশাপাশি সরকারের তরফে ৫ শতাংশ প্রণোদনাও প্রত্যাশা করছেন তারা।
তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ সূত্রমতে, ২০১৩-১৪ থেকে ২০১৭-১৮ অর্থবছর পর্যন্ত পাঁচ অর্থবছরের হিসাবে তৈরি পোশাক খাতের রপ্তানি বেড়েছে ২৫ শতাংশ। এর মধ্যে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ওভেন ও নিটওয়্যার খাত মিলে রপ্তানি করে দুই হাজার ৪৪৯ কোটি ১৮ লাখ ডলারের পণ্য; প্রবৃদ্ধি হয় ১৩ দশমিক ৮৩ শতাংশ। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে এ দুই খাতের রপ্তানি আয় ছিল দুই হাজার ৫৪৯ কোটি ১৪ লাখ ডলার; প্রবৃদ্ধি ৪ দশমিক ৮ শতাংশ। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে মোট রপ্তানি আয় ছিল দুই হাজার ৮০৯ কোটি ৪১ লাখ ডলার; প্রবৃদ্ধি ১০ দশমিক ২১ শতাংশ। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে রপ্তানি আয় দুই হাজার ৮১৪ কোটি ৯৮ লাখ ডলার; প্রবৃদ্ধি শূন্য দশমিক ২০ শতাংশ। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে রপ্তানি আয় তিন হাজার ৬১ কোটি ৪৭ লাখ ডলার; প্রবৃদ্ধি ৮ দশমিক ৭৬ শতাংশ।
বিজিএমইএর সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান আমাদের সময়কে বলেন, তৈরি পোশাকশিল্পের উদ্যোক্তারা অনেক কষ্ট আর ত্যাগের বিনিময়ে এ খাতকে টিকিয়ে রেখেছেন। তিনি বলেন, বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার কারণে প্রতিনিয়ত আমাদের রক্তক্ষরণ হচ্ছে; নানা সমস্যার মধ্যেও দেশের উন্নয়নের দিকে তাকিয়ে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। কিন্তু এ খাতের প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে উন্নয়ন অব্যাহত রাখতে ঋণের সুদহার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনা বাঞ্ছনীয়, যা এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। এ ছাড়া সরকারের নীতি সহায়তাও আরও বাড়াতে হবে। রপ্তানিকারকদের সংগঠন এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইএবি) সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম আমাদের সময়কে বলেন, বিভিন্ন রকম সমস্যার মধ্যেও তৈরি পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা যেভাবে এ খাতকে ধরে রেখেছেন এবং কাজ করে যাচ্ছেন, তা প্রশংসার দাবি রাখে।
তিনি বলেন, রপ্তানি প্রবৃদ্ধি প্রত্যাশানুযায়ী হয়নি; কারণ এখনো অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা, অপর্যাপ্ত গ্যাস ও বিদ্যুৎ, অদক্ষ শ্রমিক, লাইসেন্স প্রাপ্তিতে দীর্ঘসূত্রতা, গভীর সমুদ্রবন্দর না থাকা, যে বন্দর রয়েছে সেখানেও নানারকম হয়রানিসহ বেশ কিছু সমস্যা রয়েছে। এগুলোর সমাধান হলে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি আরও অনেক বেড়ে যাবে; উন্নয়নের মাধ্যমে দেশকে নতুন এক দিগন্তে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে।