শতভাগ চীনা মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান জি জে ক্যাপস অ্যান্ড হেডওয়্যার লিমিটেড বাংলাদেশে বিনিয়োগের জন্য আসে ২০১৬ সালে। ২০১৭ সাল থেকে উৎপাদনে আসা প্রতিষ্ঠানটির বিনিয়োগ ছিল প্রাথমিকভাবে ৮-১০ কোটি টাকা। গত দুই বছরে কারখানা সম্প্রসারণের মাধ্যমে বিনিয়োগের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৫-৩০ কোটি টাকা।
জি জে ক্যাপস অ্যান্ড হেডওয়্যারের মতোই ২০১৬ সালে আসে বাংলাদেশ লঙ্গয়ী ইন্ডাস্ট্রি কোম্পানি লিমিটেড। পোশাকের অ্যাকসেসরিজ প্রস্তুত করে প্রতিষ্ঠানটি। ২০১৮ সালে আসে কিয়ং ইউ হং (বিডি) লিমিটেড। চলতি বছর বিনিয়োগ শুরু করেছে এমন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আছে ঝংজিন টেক্সটাইল (বিডি) লিমিটেড এবং হানটেক্স কো. বিডি লিমিটেড। গত পাঁচ বছরে দেশের বস্ত্র ও পোশাক খাতে বিনিয়োগ করেছে অনেকগুলো চীনা কোম্পানি।
জি জে ক্যাপস অ্যান্ড হেডওয়্যারের সাবেক সিইও মো. আবদুল মোতালেব বণিক বার্তাকে বলেন, পোশাক খাতে চীনা প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ কয়েক বছর ধরে দেখা যাচ্ছে। ব্যক্তিগত পর্যায়ে চীনা বিনিয়োগ আগ্রহের প্রতিফলন আমি দেখেছিলাম জি জে ক্যাপস অ্যান্ড হেডওয়্যারে। আরো বেশকিছু চীনা বিনিয়োগ প্রকল্প চালু হতে দেখেছি। নাম বলতে না পারলেও আশুলিয়া এলাকাতেই বেশকিছু কারখানা আছে, যেগুলো চীনা বিনিয়োগে চলছে।
বস্ত্র ও পোশাক খাতে চীনা বিনিয়োগ বৃদ্ধির প্রতিফলন দেখা গেছে দেশটির বাণিজ্য প্রতিনিধিদের বক্তব্যে। ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশ সফরে আসেন চায়না কাউন্সিল ফর দ্য প্রমোশন অব ইন্টারন্যাশনাল ট্রেডের (সিসিপিআইটি) প্রতিনিধিরা। সফরকালে বাংলাদেশী ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠকে সিসিপিআইটির পরিচালক যৌ শিয়া বলেন, চীনের সানডং প্রদেশের অনেক বিনিয়োগ আছে বাংলাদেশের টেক্সটাইল খাতে। এ ধরনের বিনিয়োগের মাধ্যমে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরো জোরদার করার আশা প্রকাশ করেন তিনি।
বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বিশ্লেষকরা বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের বস্ত্র ও পোশাক খাতে বিনিয়োগের আগ্রহ দেখাচ্ছে চীন। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধের মনস্তাত্ত্বিক চাপও বাংলাদেশের প্রতি চীনা বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ সৃষ্টি করেছে। এমনিতেই চীনে শ্রম ব্যয় বৃদ্ধির কারণে অন্যান্য দেশে উৎপাদন সরিয়ে নেয়ার কথা ভাবছিলেন বস্ত্র ও পোশাকের ক্রেতারা। এখন চীনারাও তৈরি পোশাকের প্রধান বাজার যুক্তরাষ্ট্রে নিজেদের পণ্যের ওপর বড় ধরনের শুল্কারোপের শঙ্কায় রয়েছেন। এ শুল্ক এড়াতে বাংলাদেশে কারখানা স্থাপন করতে চাইছেন দেশটির উদ্যোক্তারা। এতে করে চীনের অস্তগামী শিল্পগুলোর (সানসেট ইন্ডাস্ট্রিজ) গন্তব্য হয়ে উঠছে বাংলাদেশ। এরই ধারাবাহিকতায় বস্ত্র ও পোশাকের মতো স্বল্প মূল্য সংযোজনকারী পণ্যের উৎপাদন অন্যান্য দেশে সরিয়ে নিচ্ছেন তারা।
পোশাক খাতসংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, কয়েক বছর ধরে চীনারা বাংলাদেশে অফশোরিংয়ের আগ্রহ দেখাচ্ছেন। একদিকে পোশাক ও বস্ত্রের মার্কিন ক্রেতারা চীনের বিকল্প উৎপাদন ক্ষেত্র হিসেবে বাংলাদেশসহ কয়েকটি দেশকে গুরুত্ব দিতে শুরু করেছেন। আবার চীনা প্রস্তুতকারকরাও নিজেদের বাজার টিকিয়ে রাখতে যৌথ ও শতভাগ বিনিয়োগের মাধ্যমে বাংলাদেশসহ কয়েকটি দেশে কারখানা স্থাপনের উদ্যোগ নিতে শুরু করেছেন। পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর তথ্যেও সাম্প্রতিক সময়ে একাধিক চীনা প্রতিষ্ঠানের সদস্য হওয়ার কথা নিশ্চিত হওয়া গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বলছে, বিগত অর্থবছরে দেশের বস্ত্র ও পোশাক খাতে চীনের প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ প্রবাহ ২৩০ শতাংশ বেড়েছে। গত পাঁচ অর্থবছরে দেশে চীনের নিট এফডিআইয়ের পরিমাণ ৬২ কোটি ৭০ লাখ ৮০ হাজার ডলার। এর মধ্যে বস্ত্র ও পোশাক খাতে চীনা এফডিআইয়ের পরিমাণ প্রায় সাড়ে ১৩ কোটি ডলার, যা মোট চীনা এফডিআইয়ের ২০ শতাংশের মতো।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত অর্থবছরে চীনা এফডিআই প্রবাহে বড় ধরনের উল্লম্ফন হয়েছে। এ উল্লম্ফন ছিল বস্ত্র ও পোশাক খাতেও। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে বস্ত্র ও পোশাক খাতে এফডিআই ছিল ৩ কোটি ৪২ লাখ ডলার। ২০১৫-১৬ সালে তা কমে গিয়ে হয় ২ কোটি ৩০ লাখ ৮০ হাজার। ২০১৬-১৭ সালে আরো কমে হয় ১ কোটি ৩৮ লাখ ৫০ হাজার ডলার। এরপর ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ২৩০ শতাংশ বেড়ে বস্ত্র ও পোশাক খাতে এফডিআই দাঁড়ায় ৪ কোটি ৫৪ লাখ ৮০ হাজার ডলারে।
খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশে বিদেশী বিনিয়োগ প্রয়োজন। কিন্তু চীন থেকে বিনিয়োগ প্রয়োজন ওভেন কাপড় উৎপাদনে। আবার পোশাকের ক্ষেত্রে বিনিয়োগ প্রয়োজন স্যুট, স্পোর্টসওয়্যার, লঞ্জারির মতো উচ্চমূল্য সংযোজন সক্ষম পণ্যগুলোর ক্ষেত্রে। তবে বর্তমানে চীন থেকে যে বিনিয়োগ আসছে, সেগুলো যথাযথ খাতে হচ্ছে না। ওভেন কাপড়ে বড় ধরনের চীনা বিনিয়োগ আসছে না। পোশাক তৈরিতে বিনিয়োগ এলেও তা উচ্চমূল্য সংযোজন সক্ষম পণ্যে নয়। গত পাঁচ বছরে চীনা বিনিয়োগের বেশির ভাগই হয়েছে পোশাকের অ্যাকসেসরিজ ও স্বল্পমূল্যের পোশাক উৎপাদনে।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিল্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন বণিক বার্তাকে বলেন, গত দুই-তিন বছরে দেশের বস্ত্র খাতে কোনো চীনা বিনিয়োগ প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে বলে আমার জানা নেই। তবে দেশটির বিনিয়োগকে আমি ব্যক্তিগতভাবে স্বাগত জানাই। কারণ তাদের বিনিয়োগের মাধ্যমে বাংলাদেশের বস্ত্র খাতের সক্ষমতা বাড়বে। আর ওভেন পণ্য উৎপাদনে স্থানীয় সক্ষমতায় এখনো গ্যাপ রয়ে গেছে, এ গ্যাপটা পূরণে চীনারা ভূমিকা রাখতে পারে।
বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, বাংলাদেশে পোশাক খাতে স্থানীয় উদ্যোক্তাদের সক্ষমতা এখন অনেক ভালো। পর্যায়ক্রমে আমাদের উচ্চমূল্য সংযোজন সক্ষম পণ্য তৈরিতে মনোনিবেশ করতে হবে। এক্ষেত্রে চীনা বিনিয়োগকে আমরা স্বাগত জানাই।