Home Apparel বাংলাদেশের পোশাক খাত কেন বাণিজ্য যুদ্ধের সুফল নিতে পারলো না?

বাংলাদেশের পোশাক খাত কেন বাণিজ্য যুদ্ধের সুফল নিতে পারলো না?

নতুন অর্থ বছরের শুরু থেকেই বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রফতানি খাত তৈরি পোশাকের রফতানি প্রবৃদ্ধি ধারাবাহিকভাবে কমতে দেখা যাচ্ছে। অথচ চীন-মার্কিন বাণিজ্য যুদ্ধের ফলে পোশাক খাতের যেসব মার্কিন ক্রেতা চীন থেকে পোশাক কিনতেন, তাদের অনেকেই বাংলাদেশমুখী হবেন বলেই মনে করা হচ্ছিলো। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, সেটা হয়নি। চীন-মার্কিন বাণিজ্য যুদ্ধের সুফল বাংলাদেশ কেন নিতে পারলো না? আর সামগ্রিকভাবে পুরো খাতেই কেন রফতানি কমছে? সাভারের একটি পোশাক কারখানা। সোহেল ইন্টারন্যাশনাল মনিকা অ্যাপারেলস নামে এই কারখানাটিতে কাজ করেন প্রায় ২০০ শ্রমিক। এক যুগ আগে গড়ে ওঠা এই কারখানা শুরুতে ভালো ভালো চললেও গত একবছরে বিদেশি ক্রেতাদের কাছ থেকে কাঙ্ক্ষিত ক্রয়াদেশ আসছে না। প্রতিষ্ঠানটির পারিচালক আমিনুল ইসলাম জানাচ্ছেন, গেলো গ্রীষ্মের পুরোটাতেই কারখানায় কোনো কাজ হয়নি। শ্রমিকদের একরকম বসিয়ে রেখে তিন মাস বেতন গুনতে হয়েছে। এমনকি বড় বড় কারখানা থেকে সাব-কন্ট্রাক্টেও কোনো কাজ পাওয়া যাচ্ছিলো না। কারণ সেসব কারখানাতেও অর্ডার কমে যায়। ‘এই পরিস্থিতি আসলে গত কয়েক বছরে এবারই প্রথম ফেইস করলাম। ডিসেম্বরের দিকে আমরা বেশ কিছু অর্ডার পেয়েছি, কিন্তু এর আগেই যে ক্ষতিটা হয়ে গেছে সেটা কাটিয়ে ওঠা মুশকিল।’

রফতানি কি পুরো পোশাক খাতেই কমছে?

সাভারের আমিনুল ইসলাম তার কারখানার যে চিত্র তুলে ধরেছেন, সেটা অনেকের ক্ষেত্রেই ঘটছে। আমিনুল ইসলাম জানাচ্ছেন, তার কারখানার আশেপাশে থাকা ১০টি কারখানার মধ্যে তিনটি কারখানা গত একবছরে বন্ধ হয়ে গেছে। রফতানির চিত্রেও এর প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে। ২০১৯-২০২০ অর্থ বছরের প্রথম ছয় মাসেই ধারাবাহিকভাবে পোশাক রফতানি থেকে আয় কমেছে। এই ছয় মাসে পোশাক রফতানি হয়েছে ১ হাজার ৬০২ কোটি ৪০ লাখ ডলারের কিছু বেশি। এই আয় গত অর্থ বছরে একই সময়ের তুলনায় প্রায় আট শতাংশ কম। একই সাথে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় আয় কমেছে ১৩ দশমিক ৬৩ শতাংশ।

চীন-মার্কিন বাণিজ্য যুদ্ধের সুফল ঘরে তুলতে পারেনি বাংলাদেশ’

গেলো বছরের জুলাই থেকেই চীন-মার্কিন বাণিজ্য যুদ্ধ শুরুর পর ধারণা করা হয়েছিলো মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে মার্কিন ক্রেতারা চীন থেকে পোশাক কিনবেন না। অথবা কমিয়ে দেবেন। আর এতে করে লাভবান হবে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত। কিন্তু দেখা যাচ্ছে তা হয়নি। উল্টো বাংলাদেশের সামগ্রিক পোশাক রফতানিতেই নেতিবাচক ধারা দেখা যাচ্ছে। এসময়ের মধ্যে বিশ্বে পোশাক রফতানিতে তৃতীয় স্থানে থাকা ভিয়েতনাম বেশ লাভবান হয়েছে। তাদের পোশাক রফতানি বাড়ায় গেলো বছর দুইয়ে থাকা বাংলাদেশের আরো কাছে চলে আসে দেশটি। আর যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশকেও ছাড়িয়ে যায় ভিয়েতনাম। চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে বাংলাদেশের রফতানি আয় যেখানে ২৪১ কোটি ডলার। সেখানে একই সময়ে ভিয়েতনামের আয় দ্বিগুণেরও বেশি ৬৪৫ কোটি ডলার।

রফতানি কমে যাওয়ার কারণ কী?

পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ বলছে, ভিয়েতনাম যে মার্কিন ক্রেতাদের আকৃষ্ট করছে, সেটা মূলত হচ্ছে চীনা বিনিয়োগের কারণে। বিজিএমইএ সভাপতি রুবানা হক বিবিসিকে বলেন, ‘প্রথমত মার্কিন ক্রেতারা ভিয়েতনামের পোশাক পছন্দ করছে। আমরা যে ধরণের পোশাক বানাই, সেসব পোশাকের চাহিদা যুক্তরাষ্ট্রে কমেছে। এটা একটা দিক।’ তিনি বলেন, ‘আরেকটি দিক হচ্ছে, ভিয়েতনামে প্রচুর চীনা বিনিয়োগ আছে। ওদের স্থানীয় উদ্যোক্তা সেভাবে নেই আসলে। ফলে যখন চীনে ব্যবসা কমে গেছে, তারা সেটা পাশেই ভিয়েতনামে নিয়ে এসেছে। এমনও হয়েছে যে, চায়নায় কিছু অংশ করে পরে সেটা ভিয়েতনামে এনে শেষ করেছে। এবং ভিয়েতনাম থেকেই রফতানি করেছে। ভিয়েতনামের ক্যাপাসিটি কম থাকলেও যেহেতু প্রাথমিকভাবে পোশাকের কাজগুলো চায়নায় হচ্ছে, সে কারণেও তারা লাভবান হয়েছে।’ রুবানা হক জানাচ্ছেন, ভিয়েতনাম যেভাবে সেদেশে সরকারি সহায়তা পায়, বাংলাদেশ সেখানে পিছিয়ে আছে। তিনি বলছেন, এই মুহূর্তে ডলারের বিপরীতে টাকা শক্তিশালী থাকায় প্রতিযোগিতামূলক দরে পোশাক বিক্রি করা যাচ্ছে না। তবে অর্থনীতি বিশ্লেষক মামুন রশীদ আবার বলছেন, বাংলাদেশে মূল সমস্যাটা অন্য জায়গায়। তিনি বলছেন, চীন-মার্কিন বাণিজ্য যুদ্ধের মতো আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির সুযোগ বাংলাদেশ কিভাবে নেবে তা নিয়ে পূর্ব পরিকল্পনা ছিলো না। তিনি বলছেন, ‘নগদ প্রণোদনা, কর কমানো কিংবা ইনসেনটিভ বাড়ানো, টাকার অবমূল্যায়নের জন্য চাপ দেয়া এগুলোর দিকেই আমরা বিজিএমইএ’কে ইদানিং বেশি তৎপর দেখতি পাচ্ছি।’ ‘কিন্তু এ খাতে দক্ষতা বাড়ানো, গবেষণা এবং পণ্যে বৈচিত্র আনার জন্য যেরকম পরিকল্পনা দরকার ছিলো সেটা দেখা যায়নি।’ মামুন রশীদ বলছেন, বিদেশি ক্রেতাদের কেনার ধরণ পাল্টেছে। উচ্চমূল্যের, ভালো ডিজাইনের পোশাকের বিক্রি বাড়ছে। কিন্তু বাংলাদেশ সে ধরণের পোশাক বানায় না। এখানে মূলত সস্তা ধরণের পোশাক তৈরি হয়। সুতরাং পণ্যে বৈচিত্র্য আনতেই হবে।

বিজিএমইএ কী বলছে?

বিজিএমইএ সভাপতি রুবানা হক বলছেন, পোশাক খাতে যে কিছু হচ্ছে না তা নয়। তিনি বলছেন, ইতোমধ্যেই গবেষণা খাতে বিনিয়োগ হয়েছে। প্রতি সপ্তাহে কী কী ধরণের পণ্য, কী রকম দামে বিক্রি হচ্ছে সেসব তথ্য পোশাক কারখানা মালিকদের কাছে দেয়া হচ্ছে, যাতে তারা ট্রেন্ড বুঝতে পারেন। ‘খুব পড়াশোনা করে যে আমাদের সেক্টরটাকে বিবেচনা করেছি সেটা না। আমরা এখন এটাকে কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছি। নানারকম থিংক ট্যাংকের সাথে কাজ হচ্ছে। ইতোমধ্যেই ছয়টি গবেষণায় আমরা বিনিয়োগ করেছি।’ ‘আমরা আগামী পাঁচ বছরে কী করবো, ১০ বছরে কী করবো, সেগুলো ভাবা হচ্ছে। পণ্যে বৈচিত্র্য আনা একই সাথে উৎপাদনেও বৈচিত্র্য আনার চেষ্টা হচ্ছে। অর্থাৎ একই যন্ত্র ব্যবহার করে কিভাবে উৎপাদন বাড়বে, এফিশিয়েন্সি বাড়বে সেগুলো নিয়ে কাজ হচ্ছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here