মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ সত্ত্বেও ভিয়েতনাম ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) মধ্যে একটি মুক্তবাণিজ্য ও বিনিয়োগ চুক্তির অনুমোদন দিয়েছে ইউরোপের পার্লামেন্ট। ইভিএফটিএ নামের এ চুক্তির ফলে আগামী ১০ বছর ইইউভুক্ত দেশগুলোতে প্রায় বিনা শুল্কে পণ্য রপ্তানির সুবিধা পাবে ভিয়েতনাম। ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রভাবশালী সংসদীয় বাণিজ্য কমিটি গত মাসে এই চুক্তির পক্ষে সুপারিশ করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত বুধবার পার্লামেন্টের সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে এই চুক্তি অনুমোদন পায়। এতে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্প, এমন আশঙ্কার কথা বলছেন খাতটির উদ্যোক্তারা। মুক্তবাণিজ্য চুক্তিটি ইইউ ও ভিয়েতনামের মধ্যেকার ৯৯ শতাংশ কাস্টমস শুল্ক দূর করবে। তাতে দুই দেশের কোম্পানির জন্য বাজার প্রবেশাধিকার নিশ্চিত হবে। চুক্তি বাস্তবায়নের সঙ্গে সঙ্গে ভিয়েতনামে ইইউর ৬৫ শতাংশ পণ্যের রপ্তানি শুল্কমুক্ত হয়ে যাবে। বাকি পণ্যের শুল্ক ১০ বছর ধরে ক্রমান্বয়ে কমবে। একইভাবে ইইউতে রপ্তানি হওয়া ভিয়েতনামের ৭১ শতাংশ পণ্যের শুল্ক প্রত্যাহার হয়ে যাবে শুরুতেই। বাকিটা হবে সাত বছরে ধাপে ধাপে। ইইউর হিসাবে বাণিজ্য চুক্তিটির ফলে ২০৩৫ সাল নাগাদ ইইউতে ভিয়েতনামের বার্ষিক রপ্তানি বেড়ে ১ হাজার ৫০০ কোটি ইউরোতে দাঁড়াবে। অন্যদিকে ভিয়েতনামে ইইউর রপ্তানি ৮ গুণ বৃদ্ধি পেয়ে ২ হাজার ২০০ কোটি ইউরোতে পৌঁছাবে। এ ছাড়া চুক্তির ফলে ২০২৫ সাল নাগাদ ভিয়েতনামের জিডিপি ৪ দশমিক ৬ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করছে দেশটির পরিকল্পনা ও বিনিয়োগ মন্ত্রণালয়। ইভিএফটিএ নিয়ে ভিয়েতনাম ও ইইউ নিজেদের লাভ-লোকসান হিসাব–নিকাশ করলেও চুক্তিটির বিরোধিতা করে আসছিল বেশ কিছু এনজিও। ২৮টি এনজিওর একটি গ্রুপ ইইউ আইনপ্রণেতাদের বলেছে, শ্রম ও মানবাধিকার রক্ষায় ভিয়েতনাম প্রতিশ্রুতিবদ্ধ না হওয়া পর্যন্ত চুক্তিটি স্থগিত করা উচিত। তবে গতকাল পার্লামেন্টে তিনটি প্রধান রাজনৈতিক দল চুক্তিতে সমর্থন করেছে। চুক্তিটি কার্যকরে ইইউ কাউন্সিলের ও ইইউ সদস্য ২৭ দেশেরও অনুমোদন লাগবে। অবশ্য অতীতে মুক্তবাণিজ্য চুক্তির আলোচনায় ভিয়েতনামের কাছে শ্রম ও পরিবেশ মানদণ্ডের দাবি করেছে ইইউ। তবে শ্রম মানদণ্ড নির্ধারণে খুব একটা আগ্রহী নয় ভিয়েতনাম। তারপরও ইউরোপের পার্লামেন্টে অনুমোদন পেয়েছে এই চুক্তি। গত ২০ বছরে অসংখ্য মুক্তবাণিজ্য চুক্তি করেছে ভিয়েতনাম। তাদের রপ্তানিমুখী অর্থনীতি বছরের পর বছর ধরে মুক্তবাণিজ্যের ওপর নির্ভরশীল। চুক্তির অনুমোদন দিয়েছে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট তাতে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে বাংলাদেশের পোশাকশিল্প ভিয়েতনাম বিশ্বের অন্যতম উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোর একটি। দেশটির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ৬ থেকে ৭ শতাংশ। ভিয়েতনাম ইইউভুক্ত দেশে টেলিযোগাযোগ যন্ত্রপাতি, খাদ্য ও পোশাক রপ্তানি করে। অন্যদিকে ইইউর দেশগুলোর রপ্তানি পণ্যের তালিকায় আছে যন্ত্রপাতি, পরিবহন সরঞ্জাম, রাসায়নিক এবং কৃষিপণ্য।
বাংলাদেশের দুশ্চিন্তা
অগ্রাধিকারমূলক বাজার–সুবিধা বা জিএসপির কারণে ইইউ হচ্ছে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের বড় গন্তব্য। গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাংলাদেশ ইইউভুক্ত দেশগুলোতে ২ হাজার ১১৩ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করে। তার মানে বাংলাদেশি পোশাকের প্রায় ৬২ শতাংশ ইইউতে গিয়েছে। তবে ইভিএফটিএ বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের মতো শুল্কমুক্ত সুবিধা পাবে ভিয়েতনামের তৈরি পোশাকও। সেটিকেই বড় দুশ্চিন্তার কারণ হিসেবে দেখছেন পোশাকশিল্পের উদ্যোক্তারা। কয়েক মাস আগেই তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ বলেছে, ইইউতে রপ্তানি হওয়া বাংলাদেশের ১২ শতাংশ ও ভিয়েতনামের ১১ শতাংশ তৈরি পোশাক একই রকম। চুক্তিটি কার্যকর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এসব পণ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যাবে। আবার ধাপে ধাপে শুল্কমুক্ত হওয়ায় ৭ বছরের মধ্যে বাংলাদেশের ১ হাজার ৬০০ কোটি ডলারের পণ্যও ভিয়েতনামের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পড়ে যাবে। জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিচার্স ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, চুক্তিটির কারণে ভিয়েতনাম ইইউতে বাংলাদেশের সঙ্গে সম–অবস্থানে চলে এল, যা বাংলাদেশের জন্য বিরাট চ্যালেঞ্জ। কারণ, এত দিন ভিয়েতনামকে ১৫ শতাংশ শুল্ক দিয়ে পোশাক রপ্তানি করতে হতো। চুক্তি কার্যকর হলে সেটি আর লাগবে না। অন্যদিকে বাংলাদেশ ২০২৪ সালে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে পৌঁছালে ২০২৭ সাল থেকে ইউরোপের বাজারে শুল্কমুক্ত সুবিধা আর থাকবে না। কিন্তু ভিয়েতনামের ওটা থাকবে। তাই বোঝাই যাচ্ছে বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জটা এখন অনেক বড়। বিকেএমইএর সাবেক সভাপতি ফজলুল হক বলেন, ‘ভিয়েতনাম ও ইইউর চুক্তি আমাদের জন্য সতর্কবার্তা। কারণ, বর্তমানে আমাদের বড় প্রতিযোগী দেশ ভিয়েতনাম। তবে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। ইইউতে আমরা শুল্কমুক্ত সুবিধা পাচ্ছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘পোশাকশিল্পে বর্তমানে খারাপ সময় যাচ্ছে। তাই ইভিএফটিএ চুক্তির পর আমাদের বাড়তি সতর্কতা দরকার। ভিয়েতনামের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য দ্রুত আমাদের করণীয় ঠিক করে পদক্ষেপ নিতে হবে।’
কম্বোডিয়ার জিএসপিতে থাবা
গত বুধবার মানবাধিকার ইস্যুতে কম্বোডিয়ার বাণিজ্যসুবিধা কমিয়ে দিয়েছে ইইউ। তারা বলেছে, কম্বোডিয়াকে দেওয়া অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্যসুবিধা জিএসপি আংশিক স্থগিত করা হবে। এতে ইউতে দেশটির ২০ শতাংশ রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ইইউর পররাষ্ট্রনীতি–বিষয়ক প্রধান জোসেপ বোরেল এক বিবৃতিতে বলেছেন, গণতন্ত্র নষ্ট হচ্ছে, মানবাধিকার নষ্ট হচ্ছে, এমন কিছুর পাশে ইইউ দাঁড়াবে না। অন্যদিকে কম্বোডিয়ার শক্তিশালী বিরোধীদলীয় নেতা হুন সেন বলেন, ইইউর সমালোচনার মুখে এই দেশ মাথা নত করবে না। আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘কম্বোডিয়ার বিরুদ্ধে ইইউর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা থেকে আমাদের শিক্ষা নেওয়ার আছে। কারণ, শ্রম অধিকার ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্যই তাদের জিএসপির আংশিক বাতিল হয়েছে। অর্থাৎ কম্বোডিয়ার বিরুদ্ধে নেওয়া ব্যবস্থা থেকে আমরা বুঝতে পারি, এসব বিষয়ে আমরা যদি সাবধান না হই, তাহলে আকস্মিক খড়্গ নেমে আসতে পারে।’