ভারতে কোভিড-১৯র বিরুদ্ধে লড়ার জন্য যখন গোটা দেশ জুড়ে লকডাউন চলছে, তারই মধ্যে দেশে একের পর এক রাজ্য শিল্প মালিকদের স্বার্থে শ্রম আইনে ব্যাপক পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। সবচেয়ে বড় পরিবর্তন এনেছে ভারতের সর্বাধিক জনবহুল রাজ্য উত্তরপ্রদেশ – তারা তিন বছরের জন্য সেখানে কার্যত সব শ্রম আইনই মুলতুবি করে দিয়েছে। ফলে সেখানে ইচ্ছেমতো শ্রমিক ছাঁটাই করা যাবে, এমন কী ন্যূনতম পারিশ্রমিক দিতেও মালিকরা বাধ্য থাকবেন না। রাজ্যগুলো যুক্তি দিচ্ছে, অর্থনীতির চাকা ঘুরিয়ে নতুন পুঁজি আনার জন্য শ্রমিকের অধিকারে এই ধরনের কাটছাঁট করা ছাড়া উপায় নেই – কিন্তু বিরোধীরা ও শ্রমিক সংগঠনগুলি এই পদক্ষেপের তীব্র সমালোচনা করছে। বস্তুত গত চার-পাঁচদিনের ভেতরে ভারতে মধ্যপ্রদেশ, গুজরাট, পাঞ্জাব, রাজস্থান বা ওড়িশার মতো একের পর এক রাজ্য তাদের শ্রম আইনে পরিবর্তন এনে শিল্প মালিকদের নানা সুবিধে করে দিয়েছে। তবে এখানেও সবাইকে ছাপিয়ে গেছে উত্তরপ্রদেশের যোগী আদিত্যনাথ সরকার।
যখন খুশি ছাঁটাই, যা খুশি পারিশ্রমিক
তারা এই লকডাউনের মধ্যেও এমন একটি অর্ডিন্যান্স এনেছে, যা সে রাজ্যে শ্রমিকদের প্রায় সব অধিকারই তিন বছরের জন্য স্থগিত করে দিয়েছে। এর ফলে সেখানে ‘মিনিমাম ওয়েজেস’ বা ন্যূনতম পারিশ্রমিক আইনও বলবৎ হবে না, ছাঁটাইয়ের বিরুদ্ধে কর্মীরা আপিল করতে পারবেন না। এমন কী কলকারখানায় নিরাপদ কর্মপরিবেশ সৃষ্টিরও কোনও দায় থাকবে না শিল্প মালিকদের। উত্তরপ্রদেশের শ্রমমন্ত্রী স্বামীপ্রসাদ মৌর্য বলছেন, “যারা শ্রমিকদের জন্য কুমীরের কান্না কাঁদছেন তাদের বোধহয় এটা জানা নেই যে রাজ্যের শ্রমিকদের কল্যাণে নতুন লগ্নি টানতেই আমরা এই পদক্ষেপ নিয়েছি।” “যাতে আরও বেশি সংখ্যায় মানুষ রোজগার পান, বন্ধ হয়ে যাওয়া পুরনো কলকারখানা আবার খোলে – এবং উত্তরপ্রদেশের মানুষকে রুটিরুজির সন্ধানে অন্য রাজ্যে যেতে না-হয় সেই জন্যই আমরা এই অর্ডিন্যান্স এনেছি।”
শ্রমিক সংগঠনগুলোর প্রতিবাদ
অনুরূপভাবে আর একটি বিজেপি শাসিত রাজ্য মধ্যপ্রদেশেও আগামী তিন বছর মালিকদের ‘ইচ্ছেমতো’ নিয়োগ ও ছাঁটাইয়ের স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে, বলা হয়েছে শ্রম দফতর এ ব্যাপারে কোনও হস্তক্ষেপ করবে না। ত্রিপুরাতে সরকার দৈনিক সর্বোচ্চ কাজের মেয়াদ বারো ঘন্টা করারও প্রস্তাব এনেছে। দেশের সবগুলো ট্রেড ইউনিয়ন এইসব পদক্ষেপের বিরুদ্ধে সরব হয়েছে। এমন কী আরএএসের শ্রমিক শাখা ‘ভারতীয় মজদুর সঙ্ঘ’ (বিএমএস) পর্যন্ত হুঁশিয়ারি দিয়েছে এই ধরনের ‘জঙ্গলরাজ’ মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। কংগ্রেস নেতা রাহুল ও প্রিয়াঙ্কা গান্ধীও এই পদক্ষেপের তীব্র নিন্দা করেছেন। উত্তরপ্রদেশে কংগ্রেসের পরিষদীয় দলনেতা অনুরাধা মিশ্রর কথায়, “হ্যাঁ, শিল্প অবশ্যই পুনস্থাপিত করতে হবে – কিন্তু সেটা কিছুতেই গরিব মজদুরদের রক্তের বিনিময়ে হতে পারে না!” “করোনাভাইরাস মহামারিতে সবচেয়ে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তারা আমাদের এই শ্রমিকরা – এখন উত্তরপ্রদেশ সরকার কি মরার ওপর খাঁড়ার ঘা দিতে চাইছে?” “তাদের সব অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে – কাজের সময়, সুরক্ষা কিছুরই বালাই নেই!”
স্বাগত জানাচ্ছে শিল্প মহল
কোভিড-১৯ বিপর্যয় শুরু হওয়ার অনেক আগে থেকেই ভারতের শিল্প মহল কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল – এখন সেই সঙ্কট আরও গভীর হয়েছে। ফলে দেশের বাণিজ্য ও শিল্প জগতের দিকপালরা কিন্তু এই সব পরিবর্তনকে স্বাগত জানাচ্ছেন – তারা যুক্তি দিচ্ছেন শ্রম আইনের পরিবর্তনের ফলে দেশের শিল্পজগৎ একটা ‘লাইফলাইন’ পেলেও পেতে পারে। দেশের শীর্ষ বণিক সংগঠন সিআইআই-এর সাবেক চেয়ার প্রদীপ ভার্গবের কথায়, “আমার ব্যবসায় ভাঁটা পড়লে আমি সাপ্লায়ারদের কাছ থেকে অর্ডার কমিয়ে দিতে পারি। ব্যবসায় সুদিন এলে ব্যাঙ্ক থেকে বাড়তি লোন চাইতে পারি।” “এমন কোনও আইন নেই যা বলে ব্যবসায় ভাল-মন্দ যা-ই হোক তোমাকে একই অর্ডার দিয়ে যেতে হবে, একই পরিমাণ ঋণ নিয়ে যেতে হবে।” “শুধু এই নিয়োগের ক্ষেত্রে এসে বলা হচ্ছে ব্যবসার অবস্থা যা-ই হোক, তোমার কর্মী কমানো চলবে না।” “তো এই বিচিত্র আইন তো পাল্টানোই দরকার, তাই না? শিল্প আগে বাঁচলে তবে না শ্রমিকদের বাঁচার প্রশ্ন আসে!” বিজেপিও যুক্তি দিচ্ছে, মহামারির পরে ভারতকে একটি সফল ‘ম্যানুফ্যাকচারিং হাব’ বা উৎপাদন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে হলে শ্রম আইনে এই ধরনের ‘সংস্কার’ অপরিহার্য। তবে শ্রমিক নেতারা মনে করছেন, রাতারাতি ভারতকে কখনওই চীনের মতো ম্যানুফ্যাকচারিং হাবে পরিণত করা সম্ভব নয় – আর সে চেষ্টা করতে হলে দেশের গরিব মজদুরদেরই তার মূল্য চোকাতে হবে।